Skip to main content

‘দক্ষিণের বারান্দা’ জুড়ে কবিতার ফুরফুরে হাওয়া


আমার ভাবনা রোজ তোমাতে মিশুক।
দ্বিধা নেই খুঁজুক না সে অন্তহীন পথ,
হয়তো মিলবে কোথাও মুক্ত আকাশ,
অথবা সুবর্ণের সেই দক্ষিণের বারান্দা...
তবু আমার একরাশ ভালোবাসা
আবারও সেই তোমাতেই মিশুক।
ঘটুক না ছন্দ পতন,
ভাঙুক না পুরোনো প্রেমের শ্যাওলাযুক্ত প্রাচীর...
তবু আমার খাপছাড়া আমি
নির্দ্বিধায় তোমাকেই আবার খুঁজুক।
(কবিতা - তোমাতে মিশুক)
 
হাল আমলে কবিতার পঙ্‌ক্তিসংখ্যা কমতে কমতে ১-এ এসে পৌঁছেছে। অর্থাৎ কিনা এক লাইনের কবিতা। মনে যা এল, সেই কথাটি কয়েকটি মাত্র শব্দে অবোধ্য করে পাঠকের দরবারে ছেড়ে দেওয়া। আবার শিরোনামবিহীন, যতিচিহ্নবিহীন কবিতারও প্রাচুর্য - বলা ভালো আতিশয্য। এবার সব দায় পাঠকের - আহা, আহা করার বাইরে যাঁদের গত্যন্তর নেই। এসব অক্ষম বাহাদুরি, লুকোচুরি কিংবা ধাঁধা-ধন্দ নয়, ১০ লাইন থেকে পৃষ্ঠা ছাড়ানো মাত্রই ১৪টি অনবদ্য কবিতার সমাহার - ইপ্সিতা দেব-এর ‘দক্ষিণের বারান্দা’। সহজ, সরল, সপাট শব্দে কীভাবে ভাবনাকে উন্মুক্ত করে কাব্যিক শব্দবন্ধনে বেঁধে রাখতে হয় তা বিলক্ষণ জানেন কবি। তাই প্রতিটি কবিতায় রয়েছে এক অনাবিল পঠনসুখ।
কবিতার প্রথম বই। স্বভাবতই এক শঙ্কা থেকে যায় মন জুড়ে। সম্ভবত সেই দ্বিধাতেই সাকুল্যে ১৪টি কবিতায় সাজিয়েছেন এই সংকলন। এও এক পরীক্ষা-নিরীক্ষা বলা যায়। অথচ পাঠকের দরবারে এই সংকলনটি নিশ্চিত নন্দিত হওয়ার যোগ্য। তবে কবিতার স্বল্পতাও নিশ্চিতই হতাশ করবে পাঠককুলকে। স্বল্প সংখ্যক কবিতায় আসলে কী বলতে চেয়েছেন কবি? মূলত প্রেম-ভালোবাসার সৌরভ এবং আহৃত অনুভবের প্রকাশই কবিতার মূল প্রতিপাদ্য। উভয় ক্ষেত্রেই এক নির্দিষ্ট ছক, সীমা এবং কাব্যকুশলতার পরিচয় রাখতে ষোলো আনা সফল হয়েছেন কবি। কিছু অনাবিল পঙ্‌ক্তি উদ্ধৃতিযোগ্য -
...মুক্ত বাতাস যখন কাশফুলে দোলা দেবে
প্রথম বারিধারায় যখন ধরণি নতুন প্রাণ পাবে,
যখন তোমার প্রতি আমার পূর্বরাগ জন্ম নেবে,
তোমার সাথে যখন আমার ভাবসম্মেলন হবে,
কথা দাও তখন তুমি আমায় রাধিকার মর্যাদা দেবে। ...
(কবিতা - কথা দাও)
 
একরাশ ডানাভাঙা স্বপ্ন
জানে সে ভাঙা, তবু উড়ছে...
 
মরুভূমির বালি, বিম্বিসার অশোকের দেশ,
দার্জিলিং-এর টাইগার হিল খুঁজছে সেই তাকে।
হ্যাঁ সেই মেয়ে, সেই ছেলে অথবা সেই মানুষ,
যে মানুষ জুড়ে দেবে ভাঙাডানা স্বপ্নকে।
আশ্চর্য, পুলকিত চাউনি খুঁজছে সেই মানুষকে,
সন্ধান, সন্ধান, পুনরানুসন্ধান...
(কবিতা - আশ্চর্য সন্ধান)
 
এক ‘তুমি’ জুড়ে রয়েছে কবির অধিকাংশ কবিতায়, যাকে সম্বোধন করে তিনি প্রকাশ করেছেন একের পর এক অনুভূতি - প্রেম, ভালোবাসা, হৃদয়ের আকুলতা, আশা, আকাঙ্ক্ষা, চাওয়া-পাওয়ার যাবতীয় খতিয়ান। স্বল্পকালীন পাঠশেষে বিমুগ্ধ পাঠকের অতৃপ্ত কাব্যতৃষ্ণা হয়তো হোঁচট খাবে, আবার জেগেও উঠবে এক নতুন আশায়, কাব্যপিপাসায়।
কবি এই গ্রন্থটি উৎসর্গ করেছেন ‘চামেলি কর (মা) ও রবি দেব (বাবা)’কে। বইয়ের কাগজ, ছাপা, অক্ষরবিন্যাস যথাযথ মানের। আশু চৌধুরীর প্রচ্ছদ বরাবরের মতোই প্রাসঙ্গিক ও অনবদ্য। বানান আধুনিক হলেও বিভ্রাটে আবদ্ধ হয়েছে বেশ কিছু। এগুলো শোধরাতে হবে। কবিতায় যতিচিহ্নের বাহুল্য পরিলক্ষিত হয়েছে। এসব কাটিয়ে ওঠে পরবর্তী সংকলনের আশায় যে পাঠক রইবেন পথ চেয়ে তা অনস্বীকার্য।

বিদ্যুৎ চক্রবর্তী

 

প্রকাশক - শীতালং পাবলিকেশন, শিলচর
মূল্য - ৬০ টাকা, যোগাযোগ - ৬০০১০৫০২৯২ 

Comments

Popular posts from this blog

শেকড়ের টানে নান্দনিক স্মরণিকা - ‘পরিযায়ী’

রামকৃষ্ণনগর । প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আবহে বরাক উপত্যকার এক ঐতিহ্যময় শহর । বিশেষ করে শিক্ষাদীক্ষার ক্ষেত্রে চিরদিনই এক অগ্রণী স্থান হিসেবে উচ্চারিত হয়ে আসছে এই নাম । বৃহত্তর রামকৃষ্ণনগরের গোড়াপত্তনের ইতিহাস বহুদিনের । দেশভাগের আগে ও পরে , উত্তাল সময়ে স্থানচ্যূত হয়ে এখানে থিতু হতে চাওয়া মানুষের অসীম ত্যাগ ও কষ্টের ফলস্বরূপ গড়ে ওঠে এক বিশাল বাসযোগ্য অঞ্চল । শুধু রুটি , কাপড় ও ঘরের স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রই নয় , এর বাইরে শিক্ষা অর্জনের ও শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে মমনশীলতার পরিচয় দিয়েছিলেন সেইসব মহামানবেরা । ফলস্বরূপ এক শিক্ষিত সমাজব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল যদিও উচ্চশিক্ষার জন্য পরবর্তী প্রজন্মকে বেরোতে হয়েছিল নিজ বাসস্থান ছেড়ে । শিলচর তখন এ অঞ্চলের প্রধান শহর হওয়ায় স্বভাবতই শিক্ষা ও উপার্জনের স্থান হিসেবে পরিগণিত হয় । এবং স্বভাবতই রামকৃষ্ণনগর ছেড়ে এক বৃহৎ অংশের মানুষ এসে পাকাপাকিভাবে থাকতে শুরু করেন এই শিলচরে । এই ধারা আজও চলছে সমানে । শিলচরে এসেও শেকড়ের টানে পরস্পরের সাথে যুক্ত থেকে রামকৃষ্ণনগর মূলের লোকজনেরা নিজেদের মধ্যে গড়ে তোলেন এক সৌহার্দমূলক বাতাবরণ । এবং সেই সূত্রেই ২০০০ সালে গঠিত হয় ‘ ...

নিবেদিত সাহিত্যচর্চার গর্বিত পুনরাবলোকন - ‘নির্বাচিত ঋতুপর্ণ’

সাধারণ অর্থে বা বলা যায় প্রচলিত অর্থে একটি সম্পাদনা গ্রন্থের মানে হচ্ছে মূলত অপ্রকাশিত লেখা একত্রিত করে তার ভুল শুদ্ধ বিচার করে প্রয়োজনীয় সংশোধন ও সম্পাদনার পর গ্রন্থিত করা । যেমনটি করা হয় পত্রপত্রিকার ক্ষেত্রে । অপরদিকে সংকলন গ্রন্থের অর্থ হচ্ছে শুধুই ইতিপূর্বে প্রকাশিত লেখাসমূহ এক বা একাধিক পরিসর থেকে এনে হুবহু ( শুধুমাত্র বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে ন্যূনতম সংশোধনসাপেক্ষে ) একত্রীকরণ । সেই হিসেবে আলোচ্য গ্রন্থটি হয়তো সম্পাদনা গ্রন্থ নয় , একটি সংকলন গ্রন্থ । বিস্তারিত জানতে হলে যেতে হবে সম্পাদক ( সংকলক ) সত্যজিৎ নাথের বিস্তৃত ভূমিকায় । পুরো ভূমিকাটিই যদি লেখা যেতো তাহলে যথাযথ হতো যদিও পরিসর সে সায় দেয় না বলেই অংশবিশেষ তুলে ধরা হলো এখানে - ‘ সালটা ১৯৯০ । ‘ দৈনিক সোনার কাছাড় ’- এ একবছর হল আসা - যাওয়া করছি । চাকরির বয়স হয়নি তাই চাকরি নয় , এই ‘ আসা - যাওয়া ’ । …. হঠাৎ করেই একদিন ভূত চাপল মাথায় - পত্রিকা বের করব । ‘… সেই শুরু । অক্টোবর ১৯৯০ সালে শারদ সংখ্যা দিয়ে পথচলা শুরু হল ‘ঋতুপর্ণ’র। পরপর দুমাস বের করার পর সেটা হয়ে গেল ত্রৈমাসিক। পুরো পাঁচশো কপি ছাপাতাম ‘মৈত্রী প্রকাশনী’ থেকে।...

মহানিষ্ক্ৰমণ

প্রায় চল্লিশ বছর আগে গ্রামের সেই মায়াময় বাড়িটি ছেড়ে আসতে বেজায় কষ্ট পেয়েছিলেন মা ও বাবা। স্পষ্ট মনে আছে অর্ঘ্যর, এক অব্যক্ত অসহায় বেদনার ছাপ ছিল তাঁদের চোখেমুখে। চোখের কোণে টলটল করছিল অশ্রু হয়ে জমে থাকা যাবতীয় সুখ দুঃখের ইতিকথা। জীবনে চলার পথে গড়ে নিতে হয় অনেক কিছু, আবার ছেড়েও যেতে হয় একদিন। এই কঠোর বাস্তব সেদিন প্রথমবারের মতো উপলব্ধি করতে পেরেছিল অর্ঘ্যও। সিক্ত হয়ে উঠছিল তার চোখও। জন্ম থেকে এখানেই যে তার বেড়ে ওঠা। খেলাধুলা, পড়াশোনা সব তো এখানেই। দাদাদের বাইরে চলে যাওয়ার পর বারান্দাসংলগ্ন বাঁশের বেড়াযুক্ত কোঠাটিও একদিন তার একান্ত ব্যক্তিগত কক্ষ হয়ে উঠেছিল। শেষ কৈশোরে এই কোঠাতে বসেই তার শরীরচর্চা আর দেহজুড়ে বেড়ে-ওঠা লক্ষণের অবাক পর্যবেক্ষণ। আবার এখানে বসেই নিমগ্ন পড়াশোনার ফসল ম্যাট্রিকে এক চোখধাঁধানো ফলাফল। এরপর একদিন পড়াশোনার পাট চুকিয়ে উচ্চ পদে চাকরি পেয়ে দাদাদের মতোই বাইরে বেরিয়ে যায় অর্ঘ্য, স্বাভাবিক নিয়মে। ইতিমধ্যে বিয়ে হয়ে যায় দিদিরও। সন্তানরা যখন বড় হয়ে বাইরে চলে যায় ততদিনে বয়সের ভারে ন্যুব্জ বাবা মায়ের পক্ষে আর ভিটেমাটি আঁকড়ে পড়ে থাকা সম্ভব হয়ে ওঠে না। বহু জল্পনা কল্পনার শেষে ত...