‘সামান্য সামনাসামনি’র সূত্র ধরে ‘পথের পরিচয়ে চেনা’ মানুষরাই এক সময় হয়ে উঠতে পারে একান্ত আপন কেউ। এ প্রতিষ্ঠিত সত্য। সম্পর্ক সৃষ্টির ইতিকথাও বড় কম নয়। মানুষ যেদিন থেকে সাক্ষর হয়েছে, জ্ঞানের আলোকে ঋদ্ধ করতে শিখেছে নিজেকে; সেদিন থেকেই একদিকে যেমন ভাবনার অতলে তলিয়ে যেতে শিখেছে তেমনি অক্ষরমালায় সাজিয়ে রাখতে পেরেছে সম্পর্কের সাতকাহন, প্রবৃত্ত হয়েছে অন্তরের ভাবনাকে কাব্যগুণে ধরে রাখতে কাগজের পৃষ্ঠায়। আর এভাবেই কাগজের পর কাগজ জুড়ে সৃষ্টি হয়েছে এক একটি বই কিংবা গ্রন্থ। আপাতকথায় গ্রন্থ বলতে সাধারণত গায়ে-গতরে হৃষ্টপুষ্ট একটি বইকে বোঝায় যদিও আভিধানিক সূত্রে পুস্তক, বই ও গ্রন্থের মধ্যে বিশেষ কোনো পার্থক্য নেই। অভিধানে গ্রন্থকে বলা হয়েছে বই, বইকে গ্রন্থ এবং পুস্তককে বই, গ্রন্থ ইত্যাদি। তবে আলোচনা, সমালোচনার স্বার্থে গ্রন্থ শব্দটিই অধিক ব্যবহৃত হয় উচ্চারণ সৌকর্যের সূত্র ধরে।
উত্তরপূর্বের বরাক উপত্যকার বাসিন্দা কবি স্বাতীলেখা রায়ের সঙ্গে পাঠক, আলোচকের পরিচয় বেশি দিনের নয়। কোভিড সময়ে সামাজিক মাধ্যমের সূত্র ধরেই তাঁর আত্মপ্রকাশ বলা যায়। সম্প্রতি ২০২৫ এর গোড়ার দিকে একযোগে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর দুটি কাব্যগ্রন্থ। কয়েক দিনের ব্যবধানে তাঁর প্রথম ও দ্বিতীয় গ্রন্থ-প্রকাশ। এখন গ্রন্থ প্রকাশ, বিশেষ করে কাব্যগ্রন্থের প্রকাশকে সেভাবে আর ব্যতিক্রমী ঘটনা হিসেবে দেখা হয় না। এর কারণ হচ্ছে গ্রন্থ প্রকাশের বর্ধিত পরিমাণ। তবু, রাশি রাশি গ্রন্থ প্রকাশের মধ্যেও কিছু গ্রন্থ আপন স্বকীয়তায় জায়গা করে নেয় গ্রন্থালোকে। সেক্ষেত্রে বইটি বা গ্রন্থটির কলেবর বা মোদ্দা কথায় পৃষ্ঠা সংখ্যা কোনও প্রতিপাদ্য বিষয় হয়ে থাকে না। স্বাতীলেখার দুটি কাব্যগ্রন্থ কেন, কোন সুবাদে উঠে এল আলোচনার টেবিলে সেখানে চোখ রাখা যাক তবে এই পরিসরে -
সামান্য সামনাসামনি
কবি স্বাতীলেখার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘সামান্য সামনাসামনি’। দুই ফর্মার পেপারব্যাক সংস্করণ। প্রকাশিত হয়েছে জানুয়ারি ২০২৫ -এ। শেষ মলাটে কবি পরিচিতি হিসেবে প্রকাশকের তরফে লেখা রয়েছে - ‘...কবিতার সাথে লুকোচুরি খেলা আশৈশব। তবে দীর্ঘদিন ধরে লিখলেও কখনোই প্রচারের আলোয় আসেননি স্বাতীলেখা। কবিতার নিভৃত জগৎ থেকে প্রথম নিজেকে প্রকাশ করেন সামাজিক মাধ্যমে, ২০২০-এ ঘোর করোনা কালে। ‘সামান্য সামনাসামনি’ তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ। সেভাবেই কবিতা সংগ্রহটিকে দেখতে চান স্বাতীলেখা, প্রকাশের পথ খোঁজা নতুন নতুন বাঁকে...।’ শেষের লাইনটি বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। লেখা রয়েছে কবি তাঁর প্রথম প্রকাশকে সেভাবেই অর্থাৎ ‘প্রথম’ হিসেবেই দেখতে চান - এমনকি বাঁক বদলে গেলেও। একজন গ্রন্থকারের প্রথম প্রকাশ যে এক সময় পড়ে থাকে ‘পুরাতন’ হয়ে - একদিকে সেই বোধ যখন খেলা করে কবিমনে; তখন আবার সন্তানসম ‘প্রথম’-এর প্রতি তার সৃষ্টিকারীর যে এক বিশেষ স্নেহ, মোহ ও আবেগ জড়িয়ে থাকে তারই বহি:প্রকাশ এই লাইনটি।
তবে একথাটিও ঠিক যে স্বাতীলেখার প্রথম কাব্যগ্রন্থের কবিতা একদিন ‘পুরোনো’ হয়ে গেলেও হারিয়ে যাওয়ার নয়। অনেকানেক কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থে সচরাচর এতটা কাব্যসুষমার প্রকাশ দেখতে পাওয়া যায় না। সেদিক থেকে বিচার করতে গেলে প্রথম কাব্যগ্রন্থ হিসেবে ব্যতিক্রমী হয়ে থাকার যথেষ্ট কারণ থেকেই যায় আলোচ্য গ্রন্থটির। সূচিপত্রহীম, ভূমিকাহীন গ্রন্থটিতে সন্নিবিষ্ট হয়েছে ৭ থেকে ২২ লাইনের মোট ২৬টি যতিচিহ্নবিহীন কবিতা এবং ২ থেকে ৫ লাইনবিশিষ্ট ৮টি অণুকবিতার একটি সংগ্রহ। রয়েছে গ্রন্থনাম শীর্ষক একটি অনবদ্য কবিতাও। কবিতাগুলো এবং অণুকবিতার আরক হিসেবে মূলত উঠে এসেছে অনুভব ও অনুভূতির প্রকাশ। স্বল্পকথায়, সযত্নে নিয়ন্ত্রিত ও সীমিত শব্দের নিপুণ প্রয়োগে কবি লিপিবদ্ধ করেছেন ভাব ও বোধের উচ্চারণ। মাঝে মাঝেই একেবারে অভাবিত, অকল্পনীয় এক একটি শব্দের সুনিপুণ প্রয়োগের মধ্য দিয়ে সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, স্বজন-সুজন, নিজের কাব্যপ্রেম, সম্পর্কের রসায়ন আর ভাবনা-যাপন আদিকে কবি প্রগাড় মায়ায়, যতনে গুছিয়ে রেখে দিতে চেয়েছেন তাঁর কবিতার প্রথম প্রয়াসে। শব্দব্রহ্মের ঘোর লাগা এই গন্তব্যহীন যাত্রাপথে কবি তাই লিখে যান -
মাঝেই মনে হয় চুপ করে থাকি
ভুলে যাই কথা বলা
তোমরা বলবে আমি শুনবো
তোমরা জানালে আমি জানবো
তোমরা চললে আমিও চলবো
শব্দ যদি ব্রহ্ম হয়
জানা যদি সত্য হয়
চলা যদি লক্ষ্য হয়
তবে আমিও সত্য ব্রহ্মে আপাতত গন্তব্যহীন
(কবিতা - গন্তব্যহীন)।
কবিতার এই গঠন, আদল, চিন্তন কবির পথ চলাকে দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর করে তুলবে এ প্রত্যয় জাগাতে তাই নিশ্চিত সমর্থ হয়েছে তাঁর এই প্রথম প্রকাশ। রাজেশ দেবনাথের প্রচ্ছদ নান্দনিক। কবি তাঁর প্রথম প্রয়াসকে উৎসর্গ করেছেন তাঁর ‘জন্ম জন্মান্তরের মা গীতা রায়’কে। কাগজের মান যথাযথ। বর্ণ সংস্থাপন উপযুক্ত হলেও গৃহীত ফন্ট অনেকের কাছে পঠনবান্ধব নাও লাগতে পারে। কিছু বানানবিভ্রাট রয়ে গেলেও সব মিলিয়ে কাব্যগুণে কবিতার পথে স্বকীয় চিহ্ন রেখে যেতে সক্ষম হয়েছে - এই ‘সামান্য সামনাসামনি’।
প্রকাশক - রাজেশ চন্দ্র দেবনাথ, দৈনিক বজ্রকণ্ঠ, আগরতলা : মূল্য - ১২৫ টাকা
পথের পরিচয়ে চেনা
প্রথমের পিঠোপিঠি কবি স্বাতীলেখা রায়-এর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘পথের পরিচয়ে চেনা’। এখানে কবি তাঁর প্রথম প্রয়াসের সামান্য জড়তাকে কাটিয়ে ওঠে অনেকটাই সাবলীল, স্বত:স্ফুর্ত, সাহসী হয়ে উঠতে পেরেছেন। কবিতার সংখ্যা কমে গেলেও পথ চলার অভিজ্ঞতায় পুষ্ট হয়েছেন ভাবনা ও সম্পর্কের রসায়নকে আরও খানিকটা গাঢ় করে নিয়ে। গ্রন্থের অবয়ব এখানে আরও সীমিত। পেপারব্যাকে ১/৮ ক্রাউনে সন্নিবিষ্ট হয়েছে আবারও যতিচিহ্নবিহীন মোট ১৪টি কবিতা।
পথে চেনা মানুষদের সান্নিধ্য, জীবনপথে রকমারি আবহে মুখোমুখি মানুষদের সঙ্গে গড়ে ওঠা কিছু স্থায়ী, কিছু অস্থায়ী সম্পর্ককে বিস্তৃত ভাবনার বেড়াজালে আবদ্ধ করেছেন কবি সুনিপুণ শব্দের প্রয়োগে। কাটাছেঁড়া করেছেন বোধ ও বোধগম্যতার রসায়নকে। বিচিত্র সব অনুষঙ্গ এসেছে এখানে ব্যতিক্রমী কিছু চিন্তার ফসল হিসেবে। বদলে যাওয়া পৃথিবীর আবহকে কবি গভীর প্রত্যয়ের সঙ্গে চিত্রিত করেছেন আপন অনুভবের বদান্যতায় -
পথে যার সাথে রোজ দেখা হয়
তাকে কোনোদিন বাড়িতে আসতে বলিনি
পথের পরিচয়েই চেনা
স্মৃতিপথেই দীর্ঘ হয় হাসনুহানার গন্ধ
বাড়ি ফিরি
ধুলো ময়লা ঝেড়ে স্বচ্ছ আয়নার ঝাপসা ছবিতে
বিকেল ফিরে ফিরে আসে
(প্রথম কবিতা - পথের পরিচয়ে)
স্বল্পসংখ্যক কবিতায় কবি যেমন একাধারে ধরে রেখেছেন ঘোরলাগা পঙ্ক্তিসমূহের সেই আবেশ তেমনি কবিতার যাত্রাপথে পিছিয়ে থাকার বেদনা নিয়েই শত দ্বন্দের মধেও সুদৃঢ় করেছেন তাঁর সুদীর্ঘ পথ চলার অঙ্গীকার। প্রত্যয়ে কবি তাই লিখেন -
নিজের সাথে দ্বন্দ্বে আছি
ধন্দে আছি
সুখেই আছি অসুখেও
ভুলে আছি নির্ভুলেই
কাজেই আছি অকাজের
তবু ভেবে দেখি
তবু লিখে রাখি
কোথায় যাওয়ার কথা ছিলো কোথায় আছি
(কবিতা - তবু লিখে রাখি)
এভাবেই ছোট ছোট কবিতায় কবি অন্তরের যাবতীয় ভাবনাকে প্রকাশ করেছেন আপন নৈপুণ্যে। শব্দদ্বিত্বে, অনুষঙ্গে সুখপঠন করেছেন নিশ্চিত। ভবিষ্যতের বিপুল সম্ভাবনাকে করে রেখেছেন প্রত্যয়িত। ফন্ট এখানে যথাযথ। ফলত দৃষ্টিনন্দনও। বানান ভুল প্রায় নেই। ভূমিকা ও সূচিপত্রবিহীন গ্রন্থটিতে প্রচ্ছদশিল্পীর নাম অনুল্লেখিত। গ্রন্থটি উৎসর্গ করা হয়েছে কবির ‘ত্রয়ী জয়িষা, জয়রাজ ও যথার্থ’কে। সব মিলিয়ে স্বল্প পরিসরে, অনবদ্য শব্দবন্ধনে, কবিতার সংখ্যাস্বল্পতায় পাঠকের নৈরাশ্যকে পাশ কাটিয়ে - অনবদ্য ভাবনার প্রকাশ ‘পথের পরিচয়ে চেনা’।
বিদ্যুৎ চক্রবর্তী
মূল্য - ৫০ টাকা
Comments
Post a Comment