প্রায় চল্লিশ বছর আগে গ্রামের সেই মায়াময় বাড়িটি ছেড়ে আসতে বেজায় কষ্ট পেয়েছিলেন মা ও বাবা। স্পষ্ট মনে আছে অর্ঘ্যর, এক অব্যক্ত অসহায় বেদনার ছাপ ছিল তাঁদের চোখেমুখে। চোখের কোণে টলটল করছিল অশ্রু হয়ে জমে থাকা যাবতীয় সুখ দুঃখের ইতিকথা। জীবনে চলার পথে গড়ে নিতে হয় অনেক কিছু, আবার ছেড়েও যেতে হয় একদিন। এই কঠোর বাস্তব সেদিন প্রথমবারের মতো উপলব্ধি করতে পেরেছিল অর্ঘ্যও। সিক্ত হয়ে উঠছিল তার চোখও। জন্ম থেকে এখানেই যে তার বেড়ে ওঠা। খেলাধুলা, পড়াশোনা সব তো এখানেই। দাদাদের বাইরে চলে যাওয়ার পর বারান্দাসংলগ্ন বাঁশের বেড়াযুক্ত কোঠাটিও একদিন তার একান্ত ব্যক্তিগত কক্ষ হয়ে উঠেছিল। শেষ কৈশোরে এই কোঠাতে বসেই তার শরীরচর্চা আর দেহজুড়ে বেড়ে-ওঠা লক্ষণের অবাক পর্যবেক্ষণ। আবার এখানে বসেই নিমগ্ন পড়াশোনার ফসল ম্যাট্রিকে এক চোখধাঁধানো ফলাফল। এরপর একদিন পড়াশোনার পাট চুকিয়ে উচ্চ পদে চাকরি পেয়ে দাদাদের মতোই বাইরে বেরিয়ে যায় অর্ঘ্য, স্বাভাবিক নিয়মে। ইতিমধ্যে বিয়ে হয়ে যায় দিদিরও।
সন্তানরা যখন বড় হয়ে বাইরে চলে যায় ততদিনে বয়সের ভারে ন্যুব্জ বাবা মায়ের পক্ষে আর ভিটেমাটি আঁকড়ে পড়ে থাকা সম্ভব হয়ে ওঠে না। বহু জল্পনা কল্পনার শেষে তাই একদিন মা-বাবাকে সঙ্গে করে নিজের কাছে নিয়ে যেতেই বহুদিন পর ফের বাড়িতে এল অর্ঘ্য। অতীতকে ফিরে পেতে কার না ভালো লাগে ? সে অতীতের যতই সুখদ যাপন হোক কিংবা জীবনসংগ্রাম। তবে সংগ্রামের মাঝেও অর্ঘ্য ভাগ্যবান ছিল এজন্যই যে সে ছিল সব ভাইবোনের মধ্যে কনিষ্ঠতম। তাই বেজায় আদরযত্নের মধ্যেই তার বেড়ে ওঠা। কথায় কথায় মা একদিন বলেছিলেন - ‘তুই আমার বহু কষ্টের ফসল। তোর জন্মের আগে আমাকে দেখে কেউ বলেনি আমি বাঁচব।’ কথাটি অন্তরে গেঁথে গিয়েছিল অর্ঘ্যর। আজ এই বাড়ি ছেড়ে চিরতরে চলে যাবেন মা-বাবা। এরপর অর্ঘ্যর পক্ষেও আর কতটুকু আসা সম্ভব হবে এই অনেকটাই দুর্গম, অনুন্নত জনপদে তা অর্ঘ্য নিজেও জানে না। এক বুকফাটা কান্না যেন দলা পাকাচ্ছিল তারও গলায়।
তবু নিজেকে যথাসম্ভব সামলে নিয়ে বলেছিল সেদিন -
– এই বাড়ি, মায় ঘরদোর তো রইলই বাবা। মা গো, ফিবছর একবার করে এখানে এসে থাকবে তোমরা, যে ক’দিন মন চায়।
গভীর ক্ষতে এই একটুখানি মলম কতটা কাজ করল তা বোঝা গেল না যদিও নিশ্চুপে ঘরের বাইরে পা রাখলেন দুজন। বাবার হাতে ঠাকুরের আসনে থাকা নারায়ণের ছবি। মায়ের হাতে তাঁর সিঁদুরের কৌটো আর - অর্ঘ্য বিস্মিত হয়ে দেখল - কাগজে মোড়া একটি বহু পুরোনো তাল। অর্ঘ্য জানে এই তালের পেছনে থাকা কাহিনি। বহু বছর আগে কেউ একজন নাকি এসে বলেছিলেন - ‘তোমাদের সংসারের দৈন্যদশা কাটছে না কারণ তালবেতাল তোমাদের সহায় নন। ঘরের প্রবেশদ্বারের উপরে, বাইরের দিকে একটি আস্ত তাল ঝুলিয়ে রাখলে এর থেকে পরিত্রাণ সম্ভব। গ্রাম্য পরিবেশ। এসব তুকতাক প্রায়শই চলতে থাকে। মা-বাবাও এসবে বিশ্বাস করতেন না। কিন্তু সংসারের হাল যখন ক্রমেই বেহাল হয়ে যেতে থাকে তখন খড়কুটো আঁকড়েই বেঁচে থাকতে চায় মানুষ। যথারীতি কিছুদিন পর একটি তাল এনে ঝুলিয়ে রাখা হল দরজার উপর।
যারাই আসত ঘরে তাদেরই নজরে পড়ত ওই তাল। সবাই জিজ্ঞেস করত এর রহস্য। মা খুব সুন্দর করে তাদের বুঝিয়ে দিতেন ব্যাপারটা। অর্ঘ্যর কাছে এ ছিল একাধারে বিস্ময় ও একটি মজাদার ঘটনা। মায়ের কথাগুলো একসময় মুখস্থ হয়ে গেল অর্ঘ্যর। হাসি পেয়ে যায় তার। তবে কী যে হল এর পর থেকে - সত্যি সত্যিই যেন ক্রমশ হাল ফিরতে থাকল সংসারের। মেজ দাদার বহুপ্রতীক্ষিত চাকরি হল এবং এরও আগে থেকে প্রতীক্ষায় থাকা দিদির বিয়েটাও তো হয়েই গেল শেষ পর্যন্ত। অর্ঘ্যও চমৎকার ফল করে উচ্চশিক্ষার জন্য বাইরে পা রাখল।
ঘরের হাল অনেকটাই ফিরল। বোধ করি তাল-বেতাল জেগে উঠলেন প্রকৃতই। গাছগাছালি ভরন্ত হয়ে উঠল ফুল-ফল-সবজিতে। সবুজ হয়ে উঠল চৌপাশ। চাকরিতে উন্নতি হল বাবার। গোরু কেনা হল এবং সেই গোরুটির পর্যাপ্ত দুধ থেকে তৈরি দই, ঘিতে ভরন্ত হয়ে উঠল আপাতশূন্য হয়ে আসা ভাতের থালা।
বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার কথা উঠে আসার পরই মা তাই বলে দিয়েছেন - যেখানেই যাবেন, ঘরের বাইরে দরজার উপর রাখতে হবে এই তাল। মেনে নিয়েছিল অর্ঘ্য এক কথায়। তার মনে হয়েছিল পাকা ঘরের প্রবেশমুখে এই তাল যতই বেমানান হোক না কেন মা-বাবার আদেশের চাইতে বড় আর কিছুই হতে পারে না। গ্রামের দু-একজন দরিদ্র লোককে আগেই বলে রাখা হয়েছিল। তারা এই চলে যাওয়ায় দু:খিত হলেও কিছু প্রাপ্তির আশায় এসে জিনিসপত্রগুলো সব হাতে নিয়ে কোন পথ ধরে যাওয়া হবে জিজ্ঞেস করে এগোতে লাগল বাসরাস্তার দিকে। পেছনে পেছনে অর্ঘ্যরা তিনজন। মা-বাবার পাশাপাশি অর্ঘ্যও যেন ধীরে ধীরে ডুবে যেতে থাকল এক অমোঘ নস্টালজিয়ায়। বাসরাস্তার দিকে যাওয়া তিনটি পথের কোনটি ধরে এগোবে তারা ? মনে পড়ে গেল একটি ঘটনা।
একবার খেলাধুলা নিয়ে এক বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছিল অর্ঘ্য অন্য ছেলেদের সঙ্গে। অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে ওরা শাসানি দিয়েছিল অর্ঘ্যকে - ‘দেখে নেব তোকে’। এরপর বেশ ক’দিন অর্ঘ্য বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় এক একদিন একেকটি রাস্তা ধরে এগোত খুব সতর্কতার সঙ্গে - যাতে আগে থেকে কেউ বুঝতে না পারে কোন পথে সে যাবে। এখন এসব ভেবে হাসি পাচ্ছে অর্ঘ্যর। আবার কষ্ট এসে পরক্ষণেই বাসা বাঁধছে বুকের মধ্যে। এ যাওয়া তো শুধু মা-বাবারই নয়, তার নিজের পক্ষেও তো এ এক মহানিষ্ক্রমণ। আর কি কখনও আসা হবে এই বাড়িতে ? হলে তা কবে ? মা-বাবা কি সত্যিই আসতে পারবেন ফি-বছর ? শরীর তা মানবে তো ? এমনই সব অথই চিন্তার ঘূর্ণাবর্তে পাক খেতে খেতে এগোয় অর্ঘ্য - সামনের দিকে।
###
সামনের দিকে এগোতে এগোতে আজ ষাটোর্ধ্ব অর্ঘ্য ভাবে, মা-বাবা তো কবেই পাড়ি দিয়েছেন আপন আপন পথে। তাঁদের মৃত্যুর পর বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে সেই বাড়ি। দাদারা নেই, দিদি বৃদ্ধাবস্থায়। জীবনের পথে ঘটে গেছে বহু বাঁকবদল।
দিদির বাইরে বড়রা প্রায় সবাই চলে গেছেন অচেনা অজানা পথে, নিজ নিজ অভিনয়ের পালা শেষে। ঘরে অকালেই হাজারটা ব্যামোয় আক্রান্ত স্ত্রী। পুত্রকন্যারা ঘরের বাইরে বেরিয়েছে জীবিকার কাজে। যেন সেই একই স্ন্যাপশট ফিরে আসে আবার। এবার কার পালা তবে ? কোন পথে এগোবে অর্ঘ্য ? গন্তব্য কোথায় ?
###
কর্মস্থল থেকে ছেলে এসেছে দুদিন হল। এরকম সময়ে গিন্নির অসুস্থতা যেন কেমন করে বেমালুম উবে যায়। চলাফেরা, কথাবার্তার সাবলীলতা ফিরে আসে পুরোদস্তুর। অবাক হয়ে যায় অর্ঘ্য। দুদিন যেন কেটে যায় ঘোরের মধ্যে। যাবার আগে ছেলে বলল -
– এরপর যখন আসব বাবা, তখন তোমাদের সঙ্গে করে নিয়ে যাব। এখন থেকে আমার ওখানেই থাকবে তোমরা। একা একা এখানে পড়ে আছ, মেনে নিতে পারছি না।
ছেলের আচমকা এ কথায় অর্ঘ্য যেন আকাশ থেকে পড়ে। আগে ঘুণাক্ষরেও টের পাননি তিনি - এই ছিল ছেলের পেটে পেটে। গিন্নির চোখেমুখেও হঠাৎ করেই কেমন যেন এক ফ্যাকাশে উদ্গ্রীবতা। কিছু বলতে যাওয়ার আগেই ছেলে ফের বলে ওঠে -
– এই ঘরদোর তো রইলই বাবা। মা গো, ফিবছর একবার করে এখানে এসে থাকবে তোমরা, যে ক’দিন মন চায়।
চমকে উঠল বিস্ময়াভিভূত অর্ঘ্য। জীবন যে একদিন হুবহু ফিরিয়ে দেবে এই সংলাপ তা কি সে জানত ?
কোথা কোন সুদূর থেকে যেন ভেসে আসে গানের কলি - ‘মন চলো নিজ নিকেতনে, সংসার-বিদেশে বিদেশীর বেশে ভ্রমো কেন অকারণে... মন চলো নিজ নিকেতনে...।
বিদ্যুৎ চক্রবর্তী।
খুব সুন্দর গল্প । "জীবন যে একদিন হুবহু ফিরিয়ে দেবে এই সংলাপ তা কি সে জানত ?" এই কথাগুলো পাঠকমনে রেখাপাত করে, পাঠককে ভাবায়।
ReplyDeleteধন্যবাদ অসংখ্য।
Delete