পুজো মানেই তো স্মৃতিচারণ। মানুষের বয়স যত বাড়ে ততই পুজোর বিবর্তন দেখে দেখে কৈশোরাভিমুখী হয় মন। ফেলে আসা দিন সততই সুখকর। তা সে যতই কঠিন হোক না কেন। কাঠিন্যও যে সদাই ঊর্ধ্বমুখী। পুরোনো কাঠিন্যকেই তাই অগ্রাধিকার দেয় মানুষ। একসময় ওটা আর কাঠিন্য হয়ে না থেকে এক প্রাপ্তি হিসেবে জায়গা করে নেয় অন্তরে। সেই যে কথায় আছে - Failure is the pillar of success. অর্থাৎ এক সময় যা ছিল অপ্রাপ্তি, পরবর্তীতে তাই যেন মনে হয় প্রাপ্তিসোপানের প্রথম ধাপ। এটা এক ধরনের প্রবৃত্তিগত অবস্থান।
মাইলের পর মাইল পায়ে হেঁটে পুজো দেখার ঝক্কিও তাই আজকের চারচাকার গাড়ি করে পুজো দেখার আরামের চাইতে ভালো বলে বোধ হয়। আমরা যারা ষাট থেকে আশির দশকে জন্মেছি, যারা গ্রাম এবং শহরের পুজোর তারতম্য উপলব্ধি করেছি, যারা সাত্ত্বিকতার অবনমন ও তামসিকতার বাড়বাড়ন্ত দেখে আসছি - আমাদের মননে অতীতের পুজোর গরিবি আয়োজনই ছিল অপেক্ষাকৃত সুখকর। সেই পুজোয় আড়ম্বর হয়তো ছিল না কিন্তু ভক্তি ছিল, পুণ্যার্জনের বাসনা ছিল। অনুভব যত বাড়ছে অনুভূতির পারদও বাড়ছে ততই। এহ বাহ্য।
আমাদের কাশফুল ছিল না, ছিল শিউলি বা শেফালি। ছিল ভোরের শিশিরকণায় স্নাত শিউলি কুড়োনোর আনন্দ। চর্চায় ছিল কাদের বাড়ির শিউলি বেশি সুন্দর। জবা, অপরাজিতা, গুলঞ্চরা তাদের নানাবিধ রূপের পসরা সাজিয়ে আমাদের অপেক্ষায় থাকত মণ্ডপাভিমুখী হতে। প্রতিবার পুজো এলেই বয়সটা যেন এক লহমায় পৌঁছে যায় সেই প্রাক যৌবনের দামাল বেলায়। সমগ্র সত্তার অনিবার্য গন্তব্য হয়ে উঠে গ্রামজীবনের সেই একমেবাদ্বিতীয়ম পূজামণ্ডপ। যার প্রতিটি স্মৃতিকণা বহন করে চলেছি এই পড়ন্ত বেলা অবধি।
পুজোর শুরু হতো মহালয়ার দিনদুয়েক আগে রেডিওর জন্য নতুন দুজোড়া ব্যাটারি কিনে। বলতে গেলে আমাদের আগেই রেডিওর ভাগ্যে জুটে যেত পুজোর উপহার। প্রতিটি মহালয়ার ভোরে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র এসে ঘুম ভাঙিয়ে দিতেন নিয়ম করে। ঢুলুঢুলু চোখে বাবার তত্ত্বাবধানে আমরা ভাইবোনরা বসে পড়তাম রেডিওকে কেন্দ্র করে। মা বিছানায় শুয়ে শুয়েই শুনতেন এবং মাঝে দু-একবার চোখ খুলে দেখে নিতেন ঘরে ধূপকাঠি জ্বালানো হয়েছে কিনা। শারদ আরাধনার সেই সূত্রপাত। আর সমাপ্তি হতো হাতে হলুদ রঙের অপরাজিতা, মাথায় শান্তিজলের ছিটে আর মুখে গরম গরম জিলাপির টুকরো দিয়ে।
দীর্ঘ তিরিশ বছর পর আবারও একবার হারানো কৈশোর-যৌবনের ছোঁয়া গায়ে মাখব বলে সপরিবারে গিয়েছিলাম সেই আমার জন্মভূমির নিজের গ্রামের পুজোয় শামিল হতে। কিছু অজানা, অবাস্তব স্বপ্ন সবার জীবনে ফিরে ফিরে আসে একাধিক বার। আমারও তাই। তবে সেই স্বপ্ন হল ঘুমন্ত মননের স্বপ্ন। আমার জাগ্রত মননে যে স্বপ্ন ফিরে আসে বারবার তার মধ্যে আছে সেই আমার গাঁয়ের পুজো আর চারদিবসীয় পুজো পরিক্রমা। মহাষষ্ঠীর দিন কুমোরের ঘর থেকে কাঠ-বাঁশের মাচায় করে প্রায় এক কিলোমিটার পথ হেঁটে মণ্ডপে মূর্তিস্থাপন করা ছিল এক বিশাল ঝুঁকিপূর্ণ কাজ। বলাই বাহুল্য সেই কাজটি করতেন পূর্ণবয়স্করা আর আমরা চলতাম পিছনে পিছনে ‘দুর্গা মাঈকী জয়’ বলে বলে উদ্গ্রীব হয়ে। সন্ধ্যায় মণ্ডপের কাছে সদ্যপ্রোথিত বেলগাছের নীচে সম্পন্ন হতো বিল্বষষ্ঠীর পুজোআচ্চা। মণ্ডপে প্রতিষ্ঠিত মায়ের এক-কাঠামোর মূর্তির দিকে তাকিয়ে থাকতাম অবাক দৃষ্টিতে। কী সুন্দর মুখমণ্ডল। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতাম দুর্গা, কার্তিক, গণেশ, লক্ষ্মী, সরস্বতী মায় সিংহ-অসুরের মুখটিও। খুঁজে খুঁজে দেখতাম হাঁস, প্যাঁচা, ইঁদুর, ময়ূর এবং ভোলানাথ মহেশ্বররা নিজ নিজ জায়গায় সঠিক প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন কিনা। দেবতাদের পরনের ঝকঝকে উজ্জ্বল কাপড়চোপড়, মাথার পরতে পরতে সাজানো মুকুট, হাতের বরাভয় মুদ্রা আর অস্ত্রশস্ত্র সহ সবকিছু আসত আমাদের সরেজমিন তদন্তের আওতায়।
সপ্তমী, অষ্টমী, নবমীর ভোরে ঘুম থেকে উঠেই গ্রামের বাড়ি বাড়ি ঘুরে ফুল তোলে সাজি ভরে সেসব নিয়ে সকালেই ছুটে যেতাম মণ্ডপে। রোজ ভাবতাম বাবার কিনে দেওয়া সবেধন নীলমণি একটি মাত্র শার্ট কোনদিন পরব। অষ্টমীর অঞ্জলি আর নবমীর দুপুরে খিচুড়ি খাওয়া এবং খাওয়ানোর কাজে ব্যস্ত থাকতে হতো আমাদের। একবার অষ্টমীর সন্ধ্যারতির পরেই ঘটে গেল এক ঘটনা। হাওয়া বইছিল জোরে। আমরা বন্ধুস্থানীয় কয়েকজন তখন ভলন্টিয়ারের দায়িত্ব নিজেরাই তুলে নিয়েছিলাম আমাদের কাঁধে। উঠতি বয়স, তরুণ তুর্কির দল আমরা। দেহ মনে প্রচণ্ড উদ্দীপনা ও সাহস। একসময় শুরু হল বৃষ্টি। বৃষ্টির সে কী প্রকোপ। বাড়তেই থাকল যেন ক্রমান্বয়ে। সঙ্গে জোর তুফান। পূজামণ্ডপের বাঁশ দিয়ে বাঁধা অস্থায়ী টিনের ছাদ তখন উড়ে যাওয়ার উপক্রম। আমরা তৈরি হয়ে গেলাম বিপদকালকে সামাল দিতে। তিনজন মিলে উঠে গেলাম চালের উপরে। প্রাণপণে দুহাতে আগলে ধরে রাখলাম টিনগুলোকে। মণ্ডপে থাকা মহিলারা মা দুর্গাকে স্মরণ করছেন চিৎকার করে করে। মণ্ডপের একমাত্র হ্যাজাক বাতিটি নিভে গেছে অনেক আগেই। লোকজনের হাতে থাকা টর্চের ম্লান আলোয় দাঁড়িয়ে সবাই। কারও সাবধানবাণী শোনার কিংবা তার জবাব দেবার মতো ফুরসত তখন ছিল না আমাদের। তখন হাওয়ার এক একটি ঝাঁক যেন টিনশুদ্ধ আমাদের উড়িয়ে নেবে। প্রায় শুয়ে পড়ে আঁকড়ে ধরে রেখেছি টিনগুলোকে। ভিজে সারা গা-মাথা একেবারে একশা। হয়তো প্রায় ঘণ্টাখানেক ধরে চলল এই তাণ্ডব। আমাদের মনে হচ্ছিল বুঝি অনন্তকাল। এরপর একসময় ধীরে ধীরে শান্ত হল পরিবেশ। একে একে নেমে এলাম বীরপুরুষের মতো। সে রাতের মতো রক্ষা পেলেন উপস্থিত ভক্তবৃন্দ। সবই মায়ের ইচ্ছা।
পরদিন ‘ক্রমে ক্রমে সেই বার্তা রটি গেল গ্রামে’। আর বাইরে আমাদের মধ্যে এক হিরো হিরো ভাব থাকলেও আমার ঘরে সেই খবর পৌঁছানোর পর বলতে গেলে প্রায় লাঠিপেটা হবার উপক্রম। আজ সেসব কথা মনে পড়লে উদ্বুদ্ধ হই যতটা ততটাই আক্রান্ত হই নস্টালজিয়ায়। সেই রাতে আমার গ্রাম লক্ষ্মীনগর পূজা মণ্ডপের চিত্র আজ এত বছর পরেও কেমন হুবহু ধরে রেখেছি বুকে।
সেই পূজা মণ্ডপ থেকে ঢিল ছোড়া দূরত্বে বাসরাস্তার উপর ছিল একটি লোহার সেতু। নাম ছিল লালপুল। নিচ দিয়ে বয়ে যেত পাহাড় থেকে নেমে সমতল দিয়ে বয়ে যাওয়া একটি ছোট্ট নদী যাকে বলা হতো ছড়া। নামহীন অনামা এই ছড়া ফুলে ফেঁপে উঠত বর্ষায়। পুলের পাশেই ছিল একটি শ্মশান। শ্মশানের পাশ দিয়ে নদীবাঁধের মতো নদীর সমান্তরাল চলে গেছে যে পায়ে হাঁটা রাস্তা সেটি গিয়ে মিশেছে চামেলা বলে একটি জনপদে। সেখানেও আরেকটি সড়ক অতিক্রম করেছে সেই নদীটি যার শেষ গন্তব্য শনবিল তখন আর বেশি দূরে নয়। সেখানেও ছিল একটি লোহার পুল। চামেলা বাজারে দুর্গাপূজা হতো। তাই অনেক সময় সেই হাঁটাপথে লক্ষীনগর থেকে সৈয়জানগর হয়ে চলে যেতাম চামেলায়। একপাশে চলন্ত ‘আমাদের ছোটনদী চলে সোজাসুজি, আরদিকে সবুজাভ ধানি মাঠখানি’। কী অপরূপ সেই দৃশ্য। মাঝে মাঝেই নদীর উপর এক-বাঁশের হাতলবিহীন সাঁকো, যা অবলীলায় পেরিয়ে লোকজন চলে যাচ্ছে তাদের নিজ নিজ গ্রামে। সেই নদীই আমার জীবনের সবচাইতে কাছে থাকা নদী। কিন্তু হায় কোন নাম নেই তার আজও। কেউ কি ভাববেন এই নিয়ে কোনোদিন ? হোক না সেখানকার কোনও প্রাজ্ঞজন কিংবা বিশিষ্ট কারও নামে কিংবা তার অববাহিকার সৌন্দর্যের সাথে সামঞ্জস্য নিয়ে সেই ছড়াটির নামকরণ ?
চামেলা বাজার থেকে এবার অন্য রাস্তা ধরে উলটো পথে কদমতলা হয়ে রামকৃষ্ণনগর - সেদিনের এক আধাশহর - আজকের উপজেলা সদর। সব মিলিয়ে হয়তো দশখানা পুজো। কিন্তু ওসব দেখতেই লেগে যেত তিনটি দিন। কারণ কতটা পথ আর হেঁটে যাওয়া যায় একদিনে ? গাড়িঘোড়া তো ছিলই না সেরকম আর থাকলেও সহজলভ্য নয় মোটেও। আজকের মতো সেদিনের সেইসব পুজোমণ্ডপে না ছিল বিজলি বাতি, না ছিল মাইকের কানফাটানো হইচই কিংবা প্রাচুর্যের আস্ফালন। কিন্তু ছিল শুদ্ধ মন্ত্রোচ্চারণে পুজো, অঞ্জলি আর বিসর্জন। ছিল নিমগ্ন আরতির আয়োজন, ছিল বিসর্জন আর শান্তিজলের শেষে বড়দের আশীর্বাদ নেওয়ার পালা আর বুকে বুক মিলিয়ে হৃদয়ের সম্পর্ককে আরও খানিকটা দৃঢ় করে নেওয়া।
সেই যে পুজো দেখার আনন্দ, উন্মাদনা সে তো আর ফিরে আসার নয়। নামহীন ছড়াটি ধরে প্রবাহিত হতে থাকা জলেরই মতো আমাদের জীবনপথ। একদিন সেই লালপুল সংলগ্ন শ্মশানেরই মতো কোনও এক নামি-অনামি ঠাঁইতেই হবে আমাদের যাবতীয় স্মৃতিকথার অবসান। নামহীন ছড়ার সব জলই যেমন একদিন নাহয় একদিন মিশে যায় শনবিলে তেমনি আমাদেরও জীবননদীর জলপ্রবাহ স্তব্ধ হবে একদিন আর ভাবীকালের হাতে পৌঁছে যাবে সেই নববার্তা যেখানে লেখা রবে সেইসব স্মৃতিকথা - মহাকালের মহাফেজখানায়।
মাইলের পর মাইল পায়ে হেঁটে পুজো দেখার ঝক্কিও তাই আজকের চারচাকার গাড়ি করে পুজো দেখার আরামের চাইতে ভালো বলে বোধ হয়। আমরা যারা ষাট থেকে আশির দশকে জন্মেছি, যারা গ্রাম এবং শহরের পুজোর তারতম্য উপলব্ধি করেছি, যারা সাত্ত্বিকতার অবনমন ও তামসিকতার বাড়বাড়ন্ত দেখে আসছি - আমাদের মননে অতীতের পুজোর গরিবি আয়োজনই ছিল অপেক্ষাকৃত সুখকর। সেই পুজোয় আড়ম্বর হয়তো ছিল না কিন্তু ভক্তি ছিল, পুণ্যার্জনের বাসনা ছিল। অনুভব যত বাড়ছে অনুভূতির পারদও বাড়ছে ততই। এহ বাহ্য।
আমাদের কাশফুল ছিল না, ছিল শিউলি বা শেফালি। ছিল ভোরের শিশিরকণায় স্নাত শিউলি কুড়োনোর আনন্দ। চর্চায় ছিল কাদের বাড়ির শিউলি বেশি সুন্দর। জবা, অপরাজিতা, গুলঞ্চরা তাদের নানাবিধ রূপের পসরা সাজিয়ে আমাদের অপেক্ষায় থাকত মণ্ডপাভিমুখী হতে। প্রতিবার পুজো এলেই বয়সটা যেন এক লহমায় পৌঁছে যায় সেই প্রাক যৌবনের দামাল বেলায়। সমগ্র সত্তার অনিবার্য গন্তব্য হয়ে উঠে গ্রামজীবনের সেই একমেবাদ্বিতীয়ম পূজামণ্ডপ। যার প্রতিটি স্মৃতিকণা বহন করে চলেছি এই পড়ন্ত বেলা অবধি।
পুজোর শুরু হতো মহালয়ার দিনদুয়েক আগে রেডিওর জন্য নতুন দুজোড়া ব্যাটারি কিনে। বলতে গেলে আমাদের আগেই রেডিওর ভাগ্যে জুটে যেত পুজোর উপহার। প্রতিটি মহালয়ার ভোরে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র এসে ঘুম ভাঙিয়ে দিতেন নিয়ম করে। ঢুলুঢুলু চোখে বাবার তত্ত্বাবধানে আমরা ভাইবোনরা বসে পড়তাম রেডিওকে কেন্দ্র করে। মা বিছানায় শুয়ে শুয়েই শুনতেন এবং মাঝে দু-একবার চোখ খুলে দেখে নিতেন ঘরে ধূপকাঠি জ্বালানো হয়েছে কিনা। শারদ আরাধনার সেই সূত্রপাত। আর সমাপ্তি হতো হাতে হলুদ রঙের অপরাজিতা, মাথায় শান্তিজলের ছিটে আর মুখে গরম গরম জিলাপির টুকরো দিয়ে।
দীর্ঘ তিরিশ বছর পর আবারও একবার হারানো কৈশোর-যৌবনের ছোঁয়া গায়ে মাখব বলে সপরিবারে গিয়েছিলাম সেই আমার জন্মভূমির নিজের গ্রামের পুজোয় শামিল হতে। কিছু অজানা, অবাস্তব স্বপ্ন সবার জীবনে ফিরে ফিরে আসে একাধিক বার। আমারও তাই। তবে সেই স্বপ্ন হল ঘুমন্ত মননের স্বপ্ন। আমার জাগ্রত মননে যে স্বপ্ন ফিরে আসে বারবার তার মধ্যে আছে সেই আমার গাঁয়ের পুজো আর চারদিবসীয় পুজো পরিক্রমা। মহাষষ্ঠীর দিন কুমোরের ঘর থেকে কাঠ-বাঁশের মাচায় করে প্রায় এক কিলোমিটার পথ হেঁটে মণ্ডপে মূর্তিস্থাপন করা ছিল এক বিশাল ঝুঁকিপূর্ণ কাজ। বলাই বাহুল্য সেই কাজটি করতেন পূর্ণবয়স্করা আর আমরা চলতাম পিছনে পিছনে ‘দুর্গা মাঈকী জয়’ বলে বলে উদ্গ্রীব হয়ে। সন্ধ্যায় মণ্ডপের কাছে সদ্যপ্রোথিত বেলগাছের নীচে সম্পন্ন হতো বিল্বষষ্ঠীর পুজোআচ্চা। মণ্ডপে প্রতিষ্ঠিত মায়ের এক-কাঠামোর মূর্তির দিকে তাকিয়ে থাকতাম অবাক দৃষ্টিতে। কী সুন্দর মুখমণ্ডল। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতাম দুর্গা, কার্তিক, গণেশ, লক্ষ্মী, সরস্বতী মায় সিংহ-অসুরের মুখটিও। খুঁজে খুঁজে দেখতাম হাঁস, প্যাঁচা, ইঁদুর, ময়ূর এবং ভোলানাথ মহেশ্বররা নিজ নিজ জায়গায় সঠিক প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন কিনা। দেবতাদের পরনের ঝকঝকে উজ্জ্বল কাপড়চোপড়, মাথার পরতে পরতে সাজানো মুকুট, হাতের বরাভয় মুদ্রা আর অস্ত্রশস্ত্র সহ সবকিছু আসত আমাদের সরেজমিন তদন্তের আওতায়।
সপ্তমী, অষ্টমী, নবমীর ভোরে ঘুম থেকে উঠেই গ্রামের বাড়ি বাড়ি ঘুরে ফুল তোলে সাজি ভরে সেসব নিয়ে সকালেই ছুটে যেতাম মণ্ডপে। রোজ ভাবতাম বাবার কিনে দেওয়া সবেধন নীলমণি একটি মাত্র শার্ট কোনদিন পরব। অষ্টমীর অঞ্জলি আর নবমীর দুপুরে খিচুড়ি খাওয়া এবং খাওয়ানোর কাজে ব্যস্ত থাকতে হতো আমাদের। একবার অষ্টমীর সন্ধ্যারতির পরেই ঘটে গেল এক ঘটনা। হাওয়া বইছিল জোরে। আমরা বন্ধুস্থানীয় কয়েকজন তখন ভলন্টিয়ারের দায়িত্ব নিজেরাই তুলে নিয়েছিলাম আমাদের কাঁধে। উঠতি বয়স, তরুণ তুর্কির দল আমরা। দেহ মনে প্রচণ্ড উদ্দীপনা ও সাহস। একসময় শুরু হল বৃষ্টি। বৃষ্টির সে কী প্রকোপ। বাড়তেই থাকল যেন ক্রমান্বয়ে। সঙ্গে জোর তুফান। পূজামণ্ডপের বাঁশ দিয়ে বাঁধা অস্থায়ী টিনের ছাদ তখন উড়ে যাওয়ার উপক্রম। আমরা তৈরি হয়ে গেলাম বিপদকালকে সামাল দিতে। তিনজন মিলে উঠে গেলাম চালের উপরে। প্রাণপণে দুহাতে আগলে ধরে রাখলাম টিনগুলোকে। মণ্ডপে থাকা মহিলারা মা দুর্গাকে স্মরণ করছেন চিৎকার করে করে। মণ্ডপের একমাত্র হ্যাজাক বাতিটি নিভে গেছে অনেক আগেই। লোকজনের হাতে থাকা টর্চের ম্লান আলোয় দাঁড়িয়ে সবাই। কারও সাবধানবাণী শোনার কিংবা তার জবাব দেবার মতো ফুরসত তখন ছিল না আমাদের। তখন হাওয়ার এক একটি ঝাঁক যেন টিনশুদ্ধ আমাদের উড়িয়ে নেবে। প্রায় শুয়ে পড়ে আঁকড়ে ধরে রেখেছি টিনগুলোকে। ভিজে সারা গা-মাথা একেবারে একশা। হয়তো প্রায় ঘণ্টাখানেক ধরে চলল এই তাণ্ডব। আমাদের মনে হচ্ছিল বুঝি অনন্তকাল। এরপর একসময় ধীরে ধীরে শান্ত হল পরিবেশ। একে একে নেমে এলাম বীরপুরুষের মতো। সে রাতের মতো রক্ষা পেলেন উপস্থিত ভক্তবৃন্দ। সবই মায়ের ইচ্ছা।
পরদিন ‘ক্রমে ক্রমে সেই বার্তা রটি গেল গ্রামে’। আর বাইরে আমাদের মধ্যে এক হিরো হিরো ভাব থাকলেও আমার ঘরে সেই খবর পৌঁছানোর পর বলতে গেলে প্রায় লাঠিপেটা হবার উপক্রম। আজ সেসব কথা মনে পড়লে উদ্বুদ্ধ হই যতটা ততটাই আক্রান্ত হই নস্টালজিয়ায়। সেই রাতে আমার গ্রাম লক্ষ্মীনগর পূজা মণ্ডপের চিত্র আজ এত বছর পরেও কেমন হুবহু ধরে রেখেছি বুকে।
সেই পূজা মণ্ডপ থেকে ঢিল ছোড়া দূরত্বে বাসরাস্তার উপর ছিল একটি লোহার সেতু। নাম ছিল লালপুল। নিচ দিয়ে বয়ে যেত পাহাড় থেকে নেমে সমতল দিয়ে বয়ে যাওয়া একটি ছোট্ট নদী যাকে বলা হতো ছড়া। নামহীন অনামা এই ছড়া ফুলে ফেঁপে উঠত বর্ষায়। পুলের পাশেই ছিল একটি শ্মশান। শ্মশানের পাশ দিয়ে নদীবাঁধের মতো নদীর সমান্তরাল চলে গেছে যে পায়ে হাঁটা রাস্তা সেটি গিয়ে মিশেছে চামেলা বলে একটি জনপদে। সেখানেও আরেকটি সড়ক অতিক্রম করেছে সেই নদীটি যার শেষ গন্তব্য শনবিল তখন আর বেশি দূরে নয়। সেখানেও ছিল একটি লোহার পুল। চামেলা বাজারে দুর্গাপূজা হতো। তাই অনেক সময় সেই হাঁটাপথে লক্ষীনগর থেকে সৈয়জানগর হয়ে চলে যেতাম চামেলায়। একপাশে চলন্ত ‘আমাদের ছোটনদী চলে সোজাসুজি, আরদিকে সবুজাভ ধানি মাঠখানি’। কী অপরূপ সেই দৃশ্য। মাঝে মাঝেই নদীর উপর এক-বাঁশের হাতলবিহীন সাঁকো, যা অবলীলায় পেরিয়ে লোকজন চলে যাচ্ছে তাদের নিজ নিজ গ্রামে। সেই নদীই আমার জীবনের সবচাইতে কাছে থাকা নদী। কিন্তু হায় কোন নাম নেই তার আজও। কেউ কি ভাববেন এই নিয়ে কোনোদিন ? হোক না সেখানকার কোনও প্রাজ্ঞজন কিংবা বিশিষ্ট কারও নামে কিংবা তার অববাহিকার সৌন্দর্যের সাথে সামঞ্জস্য নিয়ে সেই ছড়াটির নামকরণ ?
চামেলা বাজার থেকে এবার অন্য রাস্তা ধরে উলটো পথে কদমতলা হয়ে রামকৃষ্ণনগর - সেদিনের এক আধাশহর - আজকের উপজেলা সদর। সব মিলিয়ে হয়তো দশখানা পুজো। কিন্তু ওসব দেখতেই লেগে যেত তিনটি দিন। কারণ কতটা পথ আর হেঁটে যাওয়া যায় একদিনে ? গাড়িঘোড়া তো ছিলই না সেরকম আর থাকলেও সহজলভ্য নয় মোটেও। আজকের মতো সেদিনের সেইসব পুজোমণ্ডপে না ছিল বিজলি বাতি, না ছিল মাইকের কানফাটানো হইচই কিংবা প্রাচুর্যের আস্ফালন। কিন্তু ছিল শুদ্ধ মন্ত্রোচ্চারণে পুজো, অঞ্জলি আর বিসর্জন। ছিল নিমগ্ন আরতির আয়োজন, ছিল বিসর্জন আর শান্তিজলের শেষে বড়দের আশীর্বাদ নেওয়ার পালা আর বুকে বুক মিলিয়ে হৃদয়ের সম্পর্ককে আরও খানিকটা দৃঢ় করে নেওয়া।
সেই যে পুজো দেখার আনন্দ, উন্মাদনা সে তো আর ফিরে আসার নয়। নামহীন ছড়াটি ধরে প্রবাহিত হতে থাকা জলেরই মতো আমাদের জীবনপথ। একদিন সেই লালপুল সংলগ্ন শ্মশানেরই মতো কোনও এক নামি-অনামি ঠাঁইতেই হবে আমাদের যাবতীয় স্মৃতিকথার অবসান। নামহীন ছড়ার সব জলই যেমন একদিন নাহয় একদিন মিশে যায় শনবিলে তেমনি আমাদেরও জীবননদীর জলপ্রবাহ স্তব্ধ হবে একদিন আর ভাবীকালের হাতে পৌঁছে যাবে সেই নববার্তা যেখানে লেখা রবে সেইসব স্মৃতিকথা - মহাকালের মহাফেজখানায়।
বিদ্যুৎ চক্রবর্তী
খুব সুন্দর। তোর লিখাটা পড়ে ছোটবেলার পূজোর কথা মনে পড়লো।তবে তোর ঝড় বৃষ্টির সঙ্গে লড়াই করে পাণ্ডল বাঁচানোর ঘটনা টা আমার কাছে সম্পুর্ণ নুতুন।এত কাছে থেকেও এটা জানা ছিল না ।
ReplyDelete😊😊
ReplyDelete