Skip to main content

‘স্রোত - ত্রিপুরার উপন্যাস সংখ্যা’ বিষয়ভিত্তিক এক উল্লেখযোগ্য সম্পাদনা গ্রন্থ


চর্যাপদ যুগ থেকেই বাংলা সাহিত্যে ত্রিপুরার অবস্থান সুস্পষ্ট। রাজন্য আমলে তা বিকশিত হয়েছে নিরন্তর। পরবর্তীতে রবীন্দ্র-সান্নিধ্যে গরিমান্বিত হয়েছে এই পথচলা। একটি ভাষাসাহিত্যের বয়োবৃদ্ধিতে লেগে যায় বহু কাল। সে ইতিহাস বড়ই সুখপাঠ্য। পদ, কাব্য, গদ্য থেকে শুরু করে কাহিনি ও উপন্যাসের সৃষ্টিকথা একদিকে যেমন অবশ্যজ্ঞাতব্য, অন্যদিকে এই ধারাবাহিকতার ইতিহাস নিজেই হয়ে ওঠে ভাষাসাহিত্যের এক অমূল্য সম্পদ। সেই সম্পদের পুনরাবলোকনের লক্ষ্যেই সম্প্রতি স্রোত সাহিত্য পরিবারের উদ্যোগে এবং কবি, লেখক, সম্পাদক গোবিন্দ ধরের সম্পাদনায় সংস্থার রজত জয়ন্তী বর্ষে পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরার কুমারঘাট থেকে একযোগে প্রকাশিত হয়েছে পাঁচশতাধিক পৃষ্ঠার সম্পাদনা গ্রন্থ - ‘স্রোত - ত্রিপুরার উপন্যাস সংখ্যা’।
ত্রিপুরা রাজ্যের উপন্যাস সৃষ্টির গোড়ার কথায় ‘স্রোতকথা’ শীর্ষক অবতরণিকায় রয়েছে সেই ইতিহাসকথা - ‘প্রায় শতবর্ষ আগে একটি উপন্যাস ছাপা হয়েছিল ত্রিপুরায়, এই কথা ভাবলেই ভালো লাগে। ….’রবি’ পত্রিকা সে দায়িত্ব নিয়ে ত্রিপুরাকে গৌরবান্বিত করল। আজও ‘রবি’র এই দায়িত্ব আমাদের সময়কে আলোকিত করে। ...১৮৯০ সালে ত্রিপুরার প্রথম লিটল ম্যাগাজিন ‘ত্রিপুরা জ্ঞান প্রসারিণী’ প্রকাশিত হয়। রাধাকিশোর মানিক্যের পৃষ্ঠপোষকতায় প্রকাশ হয় ‘বার্ষিকী’ ১৮৭৬ সালে। ১৮৯৩ সালে ‘পঞ্চপণ্ডিত’ আর ১৯০৩ সালে প্রকাশ হয় ‘ধূমকেতু’।
ত্রিপুরার সাহিত্যে ‘রবি’ মাইলফলক। নরেন্দ্রকিশোর দেববর্মা সম্পাদিত ‘রবি’তেই ত্রিপুরার প্রথম উপন্যাস ‘খাঁচার পাখি’ প্রকাশিত হয়। ‘রবি’র প্রথম বর্ষ বৈশাখ-চৈত্র সংখ্যা ১৯৩৪ সালে প্রকাশিত হয়। সেই সংখ্যায় পরিমলকুমার ঘোষের ‘খাঁচার পাখি’ প্রকাশিত হওয়ার মধ্য দিয়েই ত্রিপুরায় উপন্যাসের হাতেখড়ি...।’
সেই থেকে আজ অব্দি নিরন্তর প্রকাশিত হয়েছে উপন্যাস। সেই ধারাবাহিকতার এক তথ্যসমৃদ্ধ উপস্থাপন আলোচ্য গ্রন্থটি। পূর্ণাঙ্গ সূচি না হলেও শতাধিক উপন্যাসের এক সূচিও লিপিবদ্ধ হয়েছে অবতরণিকায়। বিন্যস্ত হয়েছে ত্রিপুরার উপন্যাস বিষয়ক মূল্যবান একাধিক নিবন্ধ এবং চারটি সম্পূর্ণ উপন্যাস।
প্রথম নিবন্ধ হিসেবে রয়েছে বিমল চক্রবর্তীর ‘ত্রিপুরার উপন্যাস শিল্প : পাঠপ্রতিক্রিয়ার সূচনাপর্ব। ত্রিপুরা, ত্রিপুরার সাহিত্য, গল্প উপন্যাস, গদ্যকার ঔপন্যাসিক এবং রচনাসমূহের পাঠপ্রতিক্রিয়া বিষয়ক ৫০ পৃষ্ঠার এক পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন। শ্যামল বৈদ্যের ‘ত্রিপুরার উপন্যাসে নদী’ শিরোনাম অনুযায়ী এক তথ্যভিত্তিক অবলোকন। ‘সাম্প্রতিকতার আলোয় ত্রিপুরার উপন্যাস’ - লিখেছেন সুস্মিতা দাস। সাহিত্য ও ত্রিপুরার উপন্যাসের চলমান ধারা ও বিবর্তন বিষয়ক এক মর্যাদাসম্পন্ন উপস্থাপন। বিমল চক্রবর্তীর ‘শ্যামল বৈদ্যের কথাশিল্পে বাস্তবতা’ শিরোনাম অনুযায়ী এক বিস্তৃত প্রতিবেদন। গ্রন্থে এর পরই রয়েছে এক এক করে চারটি উপন্যাস - ‘লালমাটির শিকারি’ - ঔপন্যাসিক শ্যামল বৈদ্য, অনুপ ভট্টাচার্যের ‘চেনা মানুষ অচেনা গল্প’, ‘ভালোবাসার কলাকৌশল’ - ঔপন্যাসিক কিশোররঞ্জন দে এবং পদ্মশ্রী মজুমদারের ‘দেওনদীর জল’।
‘ত্রিপুরার উপন্যাস’ বিষয়ের বাইরেও গ্রন্থটির শেষাংশে ব্যতিক্রমী সংযোজন হিসেবে রয়েছে ‘কথামুখ’ ও ‘শেষকথা’ সহ মধুমিতা দেবসরকারের ‘মুক্তিযুদ্ধের আলোকে বাংলাদেশের নির্বাচিত উপন্যাস’। ছয়টি অধ্যায়ে বিস্তৃত এই দীর্ঘ নিবন্ধমালায় রয়েছে যথাক্রমে - ‘মুক্তিযুদ্ধের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষিত’, ‘শওকত ওসমানের নির্বাচিত উপন্যাস : প্রেক্ষিত মুক্তিযুদ্ধ’, ‘মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে সৈয়দ সামসুল হকের নির্বাচিত উপন্যাস’, ‘মুক্তিযুদ্ধের আলোকে সেলিনা হোসেনের উপন্যাস’, ‘হুমায়ুন আহমেদ-এর নির্বাচিত উপন্যাস : বাঙালীর অন্বিষ্ট অর্জনের প্রেরণা’ ও ‘ইমদাদুল হক মিলনের নির্বাচিত উপন্যাসে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’। নি:সন্দেহে এক উল্লেখযোগ্য ও প্রয়োজনীয় সংযোজন যদিও ত্রিপুরার ভাষা সাহিত্য, উপন্যাস বিষয়ক সংকলনে তার প্রাসঙ্গিকতা আলোচনা সাপেক্ষ।
অনন্য এই সংকলনটির আদ্যন্ত নিবিড়পাঠে উঠে আসে ত্রিপুরার উপন্যাসের ধারাবাহিকতার খুঁটিনাটি। উপন্যাসে লিখিত গদ্যভাষা ও তার শৈলীর এক ধারাবাহিক বিবর্তন অবশ্য-লক্ষণীয়। এযাবৎ প্রকাশিত সব উপন্যাসের উপর হয়তো আলোকপাত করা হয়ে ওঠেনি এবং একটি গ্রন্থে তা হবার উপায়ও নেই। তবু বলতেই হয় খেই ধরিয়ে দেওয়ার পক্ষে, আগ্রহ সৃষ্টির লক্ষ্যে যথেষ্ট কষ্টবহুল এবং গরজে নিবেদিত এক গ্রন্থ। সার্বিক সম্পাদনা প্রশংসাযোগ্য। ছাপার মান, অক্ষরবিন্যাস, বানানের শুদ্ধতাই তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। পৃষ্ঠাসংখ্যার বিন্যাস এবং সূচিপত্রে পৃষ্ঠাসংখ্যার উল্লেখ না থাকাটা পঠনসুখের পরিপন্থী হয়েছে। পেপারব্যাক সংস্করণটির মলাটপৃষ্ঠা মানসম্পন্ন হয়নি। বিকাশ সরকার কৃত প্রচ্ছদ প্রাসঙ্গিক হলেও নামলিপির হরফ-আকার (ফন্ট সাইজ) ও রং যথাযথ মনে হয়নি। এসব ক্ষুদ্র অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে আলোচ্য গ্রন্থটি পাঠক-গবেষকের কাছে ভবিষ্যতের জন্য এক নির্দেশিকা গ্রন্থ হিসেবে গৃহীত হবে নিশ্চিতই।
বিদ্যুৎ চক্রবর্তী
প্রকাশক - সুমিতা পাল ধর
মূল্য - ৫০০ টাকা।

Comments

Popular posts from this blog

উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বাংলা গল্প : বিষয়ে বিশ্লেষণে

একক কিংবা যৌথ সম্পাদনায় বিগত কয়েক বছরে উত্তরপূর্বের বাংলা লেখালেখি বিষয়ক একাধিক গ্রন্থ সম্পাদনা করে এই সাহিত্যবিশ্বকে পাঠকের দরবারে পরিচিত করিয়ে দেওয়ার এক প্রচেষ্টা করে যাচ্ছেন নিবেদিতপ্রাণ তরুণ লেখক ও সম্পাদক নিত্যানন্দ দাস । হালে এপ্রিল ২০২৪ - এ প্রকাশিত হয়েছে তাঁর সম্পাদনা গ্রন্থ ‘ উত্তর - পূর্বাঞ্চলের বাংলা গল্প : বিষয়ে বিশ্লেষণে ’ ( প্রথম খণ্ড ) । প্রকাশক - একুশ শতক , কলকাতা । আলোচ্য গ্রন্থটিতে দুই ছত্রে মোট ২৮ জন বিশিষ্ট প্রাবন্ধিকের ২৮টি প্রবন্ধ রয়েছে । উপযুক্ত বিষয় ও আলোচকদের নির্বাচন বড় সহজ কথা নয় । এর জন্য প্রাথমিক শর্তই হচ্ছে নিজস্ব জ্ঞানার্জন । কালাবধি এই অঞ্চল থেকে প্রকাশিত উৎকৃষ্ট সাহিত্যকৃতির সম্বন্ধে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল না হলে তা সম্ভব নয় মোটেও । নিত্যানন্দ নিজেকে নিমগ্ন রেখেছেন গভীর অধ্যয়ন ও আত্মপ্রত্যয়কে সম্বল করে তা বলার অপেক্ষা রাখে না । আলোচ্য গ্রন্থের ভূমিকা লিখেছেন প্রতিষ্ঠিত কথাকার রণবীর পুরকায়স্থ । বস্তুত সাত পৃষ্ঠা জোড়া এই ভূমিকা এক পূর্ণাঙ্গ আলোচনা । ভূমিকা পাঠের পর আর আলাদা করে আলোচনার কিছু থাকে না । প্রতিটি নিবন্ধ নিয়ে পরিসরের অভাবে সংক্ষিপ্ত হলেও ...

শেকড়ের টানে নান্দনিক স্মরণিকা - ‘পরিযায়ী’

রামকৃষ্ণনগর । প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আবহে বরাক উপত্যকার এক ঐতিহ্যময় শহর । বিশেষ করে শিক্ষাদীক্ষার ক্ষেত্রে চিরদিনই এক অগ্রণী স্থান হিসেবে উচ্চারিত হয়ে আসছে এই নাম । বৃহত্তর রামকৃষ্ণনগরের গোড়াপত্তনের ইতিহাস বহুদিনের । দেশভাগের আগে ও পরে , উত্তাল সময়ে স্থানচ্যূত হয়ে এখানে থিতু হতে চাওয়া মানুষের অসীম ত্যাগ ও কষ্টের ফলস্বরূপ গড়ে ওঠে এক বিশাল বাসযোগ্য অঞ্চল । শুধু রুটি , কাপড় ও ঘরের স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রই নয় , এর বাইরে শিক্ষা অর্জনের ও শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে মমনশীলতার পরিচয় দিয়েছিলেন সেইসব মহামানবেরা । ফলস্বরূপ এক শিক্ষিত সমাজব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল যদিও উচ্চশিক্ষার জন্য পরবর্তী প্রজন্মকে বেরোতে হয়েছিল নিজ বাসস্থান ছেড়ে । শিলচর তখন এ অঞ্চলের প্রধান শহর হওয়ায় স্বভাবতই শিক্ষা ও উপার্জনের স্থান হিসেবে পরিগণিত হয় । এবং স্বভাবতই রামকৃষ্ণনগর ছেড়ে এক বৃহৎ অংশের মানুষ এসে পাকাপাকিভাবে থাকতে শুরু করেন এই শিলচরে । এই ধারা আজও চলছে সমানে । শিলচরে এসেও শেকড়ের টানে পরস্পরের সাথে যুক্ত থেকে রামকৃষ্ণনগর মূলের লোকজনেরা নিজেদের মধ্যে গড়ে তোলেন এক সৌহার্দমূলক বাতাবরণ । এবং সেই সূত্রেই ২০০০ সালে গঠিত হয় ‘ ...

প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'স্বপ্নতরী'

  স্বপ্নতরী                         বিদ্যুৎ চক্রবর্তী   গ্রন্থ বিপণী প্রকাশনা  বাবা - স্বর্গীয় সুধীর চন্দ্র চক্রবর্তী মা - শ্রীমতী বীণাপাণি চক্রবর্তী               জনম দিয়েছ মোরে এ ভব ধরায় গড়েছ সযতনে শিক্ষায় দীক্ষায় জীবনে কখনো কোথা পাইনি দ্বন্দ্ব দেখিনি হারাতে পূত - আদর্শ ছন্দ বিন্দু বিন্দু করি গড়ি পদ্য সংকলন তোমাদেরই চরণে করি সমর্পণ প্রথম ভাগ ( কবিতা )   স্বপ্নতরী ১ স্বপ্ন - তরী   নিটোল , নিষ্পাপ কচিপাতার মর্মর আর কাঁচা - রোদের আবোল - তাবোল পরিধিস্থ নতুন আমি ।   আনকোরা নতুন ঝরনাবারি নিয়ে এখন নদীর জলও নতুন বয়ে যায় , তাই শেওলা জমে না ।   দুঃখ আমার রয়ে গেছে এবার আসবে স্বপ্ন - তরী চেনা পথ , অচেনা ঠিকানা ।         ২ পাখমারা   সেই উথাল - পাথাল পাখশাট আজও আনে আরণ্যক অনুভূতি । একটু একটু হেঁটে গিয়ে বয়সের ফল্গুধারায় জগৎ নদীর দু ’ পার ছাড়ে দীর্ঘশ্বাস - সময়ের কাঠগড়াতে আমি বন...