আড্ডা বা মুখোমুখি কথাবার্তা কিংবা সাক্ষাৎকারগুলো নিশ্চিতভাবে মাটিতে পা রেখেই হয়েছিল তবু তার নাম রাখা হয়েছে ‘হাওয়াই আড্ডা’। কেন ? আসলে একটি রচনা কিংবা গ্রন্থের শিরোনাম যথেষ্ট গুরুত্ব পায় পাঠকের মন-মননে। হিন্দিতে বহুল পরিচিত ‘হাওয়াই অড্ডা’ (অর্থাৎ বিমান বন্দর) শব্দটি আমাদেরও মগজস্থ হয়ে গেছে দেশীয় সূত্রে। আবার আড্ডা অর্থে একত্রবাসে উচ্চারিত কথোপকথন। এসব মিলিয়েই এক ব্যঞ্জনাত্মক নামকরণ। তবে এ শুধু এই গ্রন্থেরই শিরোনাম নয় এ হচ্ছে এই অঞ্চলের লেখালেখির ইতিহাস, সমাজ, দর্শন, রাজনৈতিক প্রেক্ষিত, এসব কিছুকে ইনডেপথ অ্যানালাইসিসের মাধ্যমে ঠিকঠাক তুলে ধরার লক্ষ্যে পূর্ব-প্রকাশিত সাক্ষাৎকার-পর্বেরও শিরোনাম।
প্রদীপ মজুমদার ত্রিপুরার এবং স্বভাবতই উত্তর-পূর্ব তথা এর বাইরেও সমকালিক কথাসাহিত্যিক মহলে এক পরিচিত এবং অপ্রতিহত নাম। তাঁর সম্পাদিত ‘হাওয়াই আড্ডা’ শীর্ষক সাক্ষাৎকার সংকলনটি সম্পর্কে প্রথম ব্লার্বে রয়েছে - ‘আজ থেকে প্রায় দুই দশক আগে ‘কাগজের নৌকা’র বিভিন্ন সংখ্যায় ‘হাওয়াই আড্ডা’ - এই শিরোনামে যে ইন্টারভিউগুলো প্রকাশিত হয়েছিল ‘হাওয়াই আড্ডা’ বইটি তারই সংকলিত রূপ। এই ইন্টারভিউগুলোর একটি লিটারারি ভ্যালু রয়েছে। উঠে এসেছে বহু অজানা তথ্য। দেখা গেছে একেকজন লেখকের স্ট্রাগল, ইন্টারডিসিপ্লিনারি পাঠ-প্রস্তুতি, ওয়র্ক-লাইফ ব্যালান্স, মনস্তত্ত্ব, দর্শন, রেজিস্টেন্স, প্যাশন ও সেলফ এডিটিং, একটি কনটিনিউয়াস প্রসেসের ভেতর দিয়ে তাদের যাত্রাপথ…।’
আগরতলার নীহারিকা প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত গ্রন্থটি উৎসর্গ করা হয়েছে সদ্য প্রয়াত কবি, সাহিত্যিক প্রবুদ্ধসুন্দর করের উদ্দেশ্যে যিনি গভীরভাবে জুড়ে রয়েছেন গ্রন্থের অভ্যন্তরে। ভেতরের ছয়টি সাক্ষাৎকারের সারমর্ম যেন পুরোটাই উঠে এসেছে এই গ্রন্থের দুই ভাগে লিখিত মোট ৩০ পৃষ্ঠার বিস্তৃত, ইন-ডেপ্থ এবং সচরাচর বিরল সম্পাদকীয়তে। বিদেশি সাহিত্য ও সাহিত্যিকদের সাক্ষাৎকার-সম্পর্কিত উদ্ধৃতিসম্বলিত বিবরণ পাঠক তথা ছাত্র-গবেষকদের জন্য খুবই ফলপ্রসূ হতে পারে। প্রসঙ্গত যে ছয়জন কবি সাহিত্যিকের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে তাঁদের মধ্যে দুজন জন্মসূত্রে না হলেও স্থায়ী/অস্থায়ী বসতি কিংবা আত্মার সূত্রে উত্তরপূর্বের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে আছেন গভীর ভাবে।
প্রথম অধ্যায়ে শঙ্খপল্লব আদিত্যর মুখোমুখি হয়েছিলেন প্রবুদ্ধসুন্দর কর। দুর্ভাগ্যবশত অসম্পূর্ণ রয়ে যায় এই পর্বটি। অন্যথা এক নতুন ইতিহাস, এক নতুন দিগন্ত খুলে যাওয়ার পূর্ণ সম্ভাবনা ছিল ত্রিপুরা তথা উত্তর-পূর্বের বাংলা সাহিত্যাকাশে। কেন অসম্পূর্ণ ? নিরাশায় নিমজ্জিত সম্পাদক স্বভাবতই আপশোশ ও ক্ষোভের সঙ্গে লিখছেন - ‘...আজ থেকে প্রায় আঠারো বছর আগে কীরকম উৎসাহ ও উদ্দীপনার মধ্যে কঠোর পরিশ্রম ও প্রচুর পাঠে কবি শঙ্খপল্লব আদিত্যকে ধারণ করে প্রবুদ্ধ যে প্রশ্নপত্র সেট করেছিল তাতে ডাহা ফেল করেছেন শঙ্খপল্লব আদিত্য। তিনটের বেশি প্রশ্নের উত্তর তিনি আঠারো বছরের বেশি সময় ধরেও লিখতে পারেননি। …ক্লান্ত প্রবুদ্ধ অবশেষে চিরদিনের জন্য ফিরে গেলেও তাঁর বোধোদয় ঘটেনি...।’ অগত্যা বাকি অনুত্তরিত ২৪টি প্রশ্নকেই সংকলিত করা হয়েছে এজন্যই যে এই প্রশ্নগুলোই নিজে থেকে ধরে রাখে এক লিটারারি ভ্যালু। প্রশ্নের মধ্যেই নিহিত আছে যে সাহিত্যরস তা বোধ করি প্রবুদ্ধসুন্দর করের লেখালেখির মতোই প্রবুদ্ধকর এবং সুন্দর। অন্যদিকে যে তিনটে প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন শঙ্খপল্লব তাতেই আলোকছটার মতো বিচ্ছুরিত হয়েছে তাঁর সাহিত্যকৃতির বৈভব। ইচ্ছে হয় পুরো প্রশ্নোত্তরই যদি তুলে দেওয়া যেত। প্রতিটি অধ্যায়ে বিন্যস্ত আছে সাক্ষাৎকারদাতার সংক্ষিপ্ত পরিচয় এবং তাঁর লেখনী কিংবা মুখনিঃসৃত উত্তর থেকে উঠে আসা একটি করে ট্যাগলাইন। এই পর্বে যে ট্যাগলাইনটি উঠে এসেছে তা এরকম - ‘শঙ্খপল্লব আদিত্যের কবিতা প্রথমত ব্যক্তিগত, দ্বিতীয়ত সম্পাদক ও প্রকাশকের, তৃতীয়ত জীবনের অগ্নিযজ্ঞের শব্দস্তোত্র। কে আমার কবিতাকে এড়িয়ে গেছে, কে বা কারা আমার কবিতাকে জড়িয়ে ধরেছে তাতে আমার কি কোনও দায়বদ্ধতা আছে ?’
দ্বিতীয় অধ্যায়ে প্রস্নকর্তার ভূমিকায় ফের সেই প্রবুদ্ধসুন্দর। সাক্ষাৎকারদাতা হিসেবে মুখোমুখি হতে হয়েছে আরেক বিশিষ্ট কবি ও কথাকার পল্লব ভট্টাচার্যকে। সম্পাদকীয় থেকেই কিছুটা উদ্ধৃতি ধার নিয়ে বলা যায় - ‘প্রবুদ্ধর বিষাক্ত বোলিং অ্যাটাকের সামনে সাহসী ও সংযত ব্যাটিং ছিল পল্লবের…। প্রবুদ্ধর একটি প্রশ্নের দীর্ঘ উত্তরটি পল্লব শেষ করেছেন বা করেননি এই বলে - না প্রবুদ্ধ, আমি প্রতিষ্ঠান বিরোধী নই, আশরীর প্রতিষ্ঠানের দাস বলেই জানি এর স্বরূপ। তাই মগজ দিয়ে একে আমি স্বীকার করি। নৈ:শব্দ্যে একে আমি স্বীকার করছি। আবার নিজেও এর শিকার হচ্ছি। স্ববিরোধের এই আলো অন্ধকার ভাষাই আমাকে চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।’ সাক্ষাৎকারে পল্লব বলেছেন গুপ্তশব্দবীজের কথা, শব্দ ও ধ্বনির রসায়নের কথা। বলেছেন তিনি যে প্রাচীরটি তুলে রাখেন সেই প্রাচীরের কষ্টার্জিত কারুকাজের কথা। এসব কথা হয়তো সরাসরি লেখায় পাওয়া যাবে না যা অনুভূত হয় সাক্ষাৎকার পর্বে। এই পর্বের ট্যাগলাইন - ‘বাংলা কবিতার সবজি-মন্ডিতে আমি এক দাগি সবজি’।
তৃতীয় পর্বে মূলত কবি সেলিম মুস্তাফার (পীযূষকান্তি দাশ বিশ্বাস) সাক্ষাৎকার নিয়েছেন কবি সত্যজিৎ দত্ত। ‘বিগত কয়েক দশক ধরে বাংলা কবিতায় সেলিম মুস্তাফ্র প্রবল উপস্থিতি ও তাঁর রচনার বিষ মিশে গেছে পাঠকের রক্তে। সেলিমে টালমাটাল পাঠক যেটা জানেন না তাঁর আড়ালের শ্রম, অনুশীলন, জীবন-পাঠ, সংঘ-বিক্রম, সাইকোলজিক্যাল ডিস্ট্রাকশন, বিরক্তি ও প্রাতিভাসিক ব্যবধান। প্রাত্যহিকের ক্ষুদ্রতা, সমকালীন অপূর্ণতা যা তাঁর কবিতার বিষয়-আশয়; এখানে বহুভাবে উঠে এসেছে।’ বহু প্রশ্নের মুখোমুখি সেলিম সরাসরি জানিয়েছেন তাঁর অন্তরতম ভাবনা। তৃতীয় অধ্যায়ের ট্যাগলাইন - ‘আমার সমস্ত ভঙ্গিমাই আমার সহজাত। যা লিখেছি সবই দেয়ালে পিঠ দিয়ে।
চতুর্থ পর্বে সম্পাদক প্রদীপ মজুমদারের সামনে কবি, সাহিত্যিক অমিতাভ দেব চৌধুরী। সাহিত্যের একটি কম্পলিট প্যাকেজ যেন। কবি, গল্পকার, প্রাবন্ধিক, ফিচার লেখক, ঔপন্যাসিক এবং সর্বোপরি কিংবা পাশাপাশি দৈনিক কাগজের চাকরি। এহেন ব্যক্তির সাক্ষাৎকার যে দীর্ঘ হবে তাতে সন্দেহ থাকার কথা নয়। আলোচনায় সব কিছু উঠে আসা নিতান্তই অসম্ভব তবে প্রশ্নোত্তর পর্বে যে ধৈর্য, সংযম এবং এত কিছুর পরেও নিজেকে মাটির কাছাকাছি নিয়ে আসার প্রবণতা লক্ষণীয়। তিনি বলছেন - শক্তিপদর প্রভাব আমার কবিতায় এক বর্ণও নেই। যা আছে তা সম্ভবত অন্ত্যমিলের প্রতি একনিষ্ঠ ঝোঁক… পদ্যকার হিসেবে আমি শক্তিপদর চাকর হবারও যোগ্য নেই… যদি সরাসরি কবিতায় চলে আসো - আমার কবিতা তার মৌলিক গল্পবীজের কারণেই শক্তিপদর কবিতা-ভুবন থেকে বহু দূরে। ট্যাগলাইন - ‘মৃত্যু পরবর্তী আয়ুর জন্য শিল্পের কাছে প্রার্থনা করতে হয়।’
পঞ্চম অধ্যায়ে কবি, গল্পকার, অনুবাদক যশোধরা রায়চৌধুরীর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন অমিতাভ দেব চৌধুরী। যশোধরা আজকের দিনে অপার বাংলার প্রথম সারির কবি। কবিতা সম্বন্ধে বহু অকপট কথা বলেছেন তিনি। নির্মাণ - বিনির্মাণ করেছেন কবিতার রূপ রস গন্ধ। নিজেকে বিলীন করে দিয়েছেন কবিতার অন্দরে। এই যাপন, এই একাত্মতাই তাঁকে করে তুলেছে অনন্য। কবিতা তাঁর কাছে ‘একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ বুদবুদ’। তাঁর আক্ষেপ - ‘পাবলিক আসলে একটি মূর্খতার নাম’। এই পর্বটি খানিক প্রসারিত হতে পারত না ? ট্যাগলাইন - ‘ভেতরে একটা ব্ল্যাকহোল না থাকলে সেটাকে ভরাট করার জন্য এত কসরত করতাম না-কি ?’
ষষ্ঠ অধ্যায়ে উত্তর-পূর্বের প্রথম সারির কবি বিকাশ সরকার যিনি একাধারে নাট্যকার, গল্পকার এবং ঔপন্যাসিক নিজেকেই নিজে করেছেন কাটাছেঁড়া। আত্মসাক্ষাৎকারে উন্মোচিত করেছেন তাঁর ব্যথা, সংগ্রামের প্রেক্ষিত এবং সেখান থেকে উদ্গিরিত সাহিত্যসম্ভার। ‘পড়তে পড়তে মাঝে মাঝে মনে হয়েছে কে কার সাক্ষাৎকার নিচ্ছে। দুইজন বিকাশ। একজন আরেকজনের ছায়া।‘ ট্যাগলাইন - ‘আমি আমি আমি - এত আমিত্ব কি আত্মরতিরই নামান্তর নয় ? তুমি যে শুধুই তুমি তা তো নয়; তোমার মধ্যে আমিও রয়েছি। তুমি আমাকে বাদ দিতে পার না বিকাশ, অবহেলা করতে পার না। যদি আমি না থাকি তোমারই মধ্যে তবে এ সাক্ষাৎকারই তো হয় না।’
একজন ব্যক্তি, একজন কবি কিংবা সাহিত্যিক-শিল্পীকে জানতে ক্ষণিকের আলাপচারিতা কি কখনও সম্পূর্ণ হতে পারে ? জীবনের অসংখ্য অনুভব অনুভূতি নিয়ে অজস্র প্রশ্ন যেখানে প্রয়োজন সেখানে একটি সাক্ষাৎকার পর্ব কখনও পূর্ণতা পেতে পারে না। তাই হয়তো আরো বহু কথা, বহু প্রশ্ন থেকে গেছে যা সাক্ষাৎকারদাতাকে আরোও কাছে নিয়ে আসতে পারত সাক্ষাৎকারগ্রহীতা কিংবা পাঠকের। তবু এই যে এই গ্রন্থিত প্রশ্নোত্তর পর্ব এই বা কম কীসে ? এত গরজ, এত স্থৈর্য, ধৈর্যের ফল এই গ্রন্থ তাই অবিসম্বাদিতভাবেই গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠা উচিত। সিন্ধুতে বিন্দুর মতো কিছু বানান, কিছু ছাপা-বিভ্রাট, কিছু যতিচিহ্নের বিসঙ্গতিকে পাশ কাটিয়ে রাখলে পাঠক-বান্ধব বড় হরফ, স্পষ্ট ঝরঝরে ছাপা, অক্ষরবিন্যাস, কাগজের উপযুক্ত মান, চারু পিন্টুর ছিমছাম প্রচ্ছদ সব মিলিয়ে এক অবশ্যপাঠ্য এবং সংগ্রহযোগ্য সংকলন ‘হাওয়াই আড্ডা’। কাগজের নৌকায় চলুক অবিরাম যাত্রী পারাপার, নিজেদের সাহিত্য জগৎকে কাছে থেকে জানুক নবীন প্রজন্ম। ঋদ্ধ হোক পাঠকমহল।
বিদ্যুৎ চক্রবর্তী
মূল্য - ৪০০ টাকাযোগাযোগ - ৯৪৩৬৪৮৬৪০০

Comments
Post a Comment