Skip to main content

আত্মবিশ্লেষণে এই দেশ - এই সময় ‘নগ্ন মানচিত্র পুড়ছে, পুড়ুক’


কবি রত্নদীপ দেব-এর সাম্প্রতিকতম কাব্যগ্রন্থ ‘নগ্ন মানচিত্র পুড়ছে, পুড়ুক’ প্রকাশিত হয়েছে এ বছরের গোড়ায়। রত্নদীপের কবিতায় সচরাচর যেসব বিষয় প্রাধান্য পায়, আলোচ্য গ্রন্থে তা বিকশিত হয়েছে রাখঢাকহীন কাঠিন্যে অথচ কাব্যিক সুষমামণ্ডিত হয়ে। এই দুইয়ের মধ্যে সামঞ্জস্য রাখা বড় সহজ কথা নয় যদিও সেটাই যথার্থ করে দেখিয়েছেন কবি আপন প্রতিভায়।
কবি রত্নদীপ মূলত কবিতাকে ব্যবহার করেন বা বলা যায় কবিতার সৃষ্টি করেন সমাজের অন্যায়, অনাচারকে উদ্‌ঘাটিত করে তার বিরুদ্ধে একদিকে তীব্র শ্লেষ ও অন্যদিকে সোচ্চার প্রতিবাদের ক্ষেত্র হিসেবে। কবিমননে ধরা দেয় যা কিছু অস্বাভাবিকতা তার বিরুদ্ধে শব্দের প্রহার। একজন প্রকৃত কবি কখনও দেশ, কাল, পাত্রের অনিয়মকে উপেক্ষা করে নীরোর মতো বেহালা বাজাতে পারেন না। রত্নদীপও পারেন না। পারিপার্শ্বিকতাকে উপেক্ষা করা একজন কবির শোভা পায় না। যেন সেই দায়িত্ব, সেই গরজ নিয়েই আলোচ্য গ্রন্থে একাধিক বিষয়ে কলম ধরেছেন কবি - যার মধ্যে মূলত আছে স্বদেশ, ছিন্নমূলের দু:খ দুর্দশা, অশান্ত পাহাড়ের গ্লানিময় বাস্তব ইত্যাদি। ৬৪ পৃষ্ঠার ভূমিকাহীন গ্রন্থের ৫৬ পৃষ্ঠা জুড়ে রয়েছে যে ৫৬টি কবিতা তার অধিকাংশই এই বিষয়ভাবনায় লেখা। ফলত একই বিষয়ে রয়েছে একাধিক কবিতা। একাধিক পঙ্‌ক্তি রয়েছে কবিতায় যা ভাবতে বাধ্য করে পাঠককে। ধ্বনিকাব্যের ব্যঞ্জনায় নানা অনুষঙ্গ, রূপক এসেছে স্বত:স্ফুর্তভাবেই। গ্রন্থের প্রথম কবিতা - ‘নিরুদ্দেশ নৌকা’র প্রথম লাইন থেকেই এর শুরু -
‘স্বদেশ’ কাকে বলে,
বোঝে না দাঁড়হীন নৌকাটি......
ওদিকে, সীমান্তঘেঁষা গাঙের পাড়ে
নি:সঙ্গ মাঝিকে কারা যেন বুঝিয়ে চলেছে
‘বিদেশি’ শব্দের ব্যাখ্যা...
‘শেকড়’ এবং ‘অভিশাপ’ কবিতায় লেখা হয়েছে নাগরিকত্বের বিড়ম্বনায় ধ্বংস হয়ে যাওয়া অর্জুন ও রহিম আলির অভিশপ্ত জীবনের গাথা। রাষ্ট্রহীনের বিড়ম্বিত জীবনের বিপ্রতীপে একজন কবির অবস্থান কোথায় ? ‘রাষ্ট্রহীন কবি’ কবিতায় কবি এক নিরপেক্ষ অবস্থানে থেকে বলছেন - ‘কবিদের কোনো দেশ হয় না। কবিরা আসলে রাষ্ট্রহীন’।
আবার কখনও ভিন্ন অবস্থান থেকে এক এক করে কবির নিজস্ব মননে বিশ্লেষিত হয়েছে দেশের হালহকিকত। কবির চোখে ধরা পড়েছে দেশের বর্তমান। নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গিতে উন্মোচিত হয়েছে অন্ধকার চিত্র। কবির মনে হয়েছে এক মিথ্যের মিথে ডুবে আছে দেশ, দেশের জনতা। নির্বাচিত রাষ্ট্রপরিচালককে কবির মনে হয়েছে এক মিথ্যা ঈশ্বর। ঠিকরে পড়েছে শ্লেষ -
‘…একটি নগ্ন মানচিত্র পুড়ছে, পুড়ুক
ধ্যানস্থ পরমাত্মা, পরোয়া কীসের ?
দেখি, একটা মিথ্যে মানুষ
ক্রমেই ঈশ্বর হয়ে উঠছেন। (কবিতা - ঈশ্বর)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন -‘মমতাবিহীন কালস্রোতে/ বাংলার রাষ্ট্রসীমা হতে/ নির্বাসিতা তুমি সুন্দরী শ্রীভূমি।’ সেই শ্রীভূমিরই একটি অংশ দক্ষিণ অসমের একটি জেলার নাম ‘করিমগঞ্জ’কে পরিবর্তন করে সম্প্রতি ‘শ্রীভূমি’ করার প্রতিবাদে কবির কবিতা ‘হিজ স্টোরি’তে কবি ভাষার গরিমা নয়, দেখছেন ধর্মভিত্তিক চক্রান্ত। লিখছেন - ‘…শতাব্দী পেরিয়ে কাল হল ‘করিম’ নামটাই।’
প্রতিবেশি রাজ্যে পুড়ছে পাহাড়। শান্তি দূর অস্ত্। বিচলিত কবিমনে সৃষ্টি হয়েছে একের পর এক কবিতা - ‘…বাতাসে বারুদের গন্ধ। ঘোলাটে জ্যোৎস্না…’।
এভাবেই আত্মবিশ্লেষণে কবির চোখে ধরা পড়েছে যত অনিয়ম, অশান্তি। সেসব থেকে বেরিয়ে আসার বাসনা কিংবা নিদান লেখা হয়েছে আপন শৈলীতে -
‘…অযুত হিংসার পর ক্ষমার আলিঙ্গনে
তৈরি হোক এবার যুদ্ধশেষের ছবি… (কবিতা - ক্ষমার আলিঙ্গন)।
‘আর কোনও আপস মীমাংসা নয়,
এখন ঝড় উঠুক
শুধুই ঝড় উঠুক
ঝড়ের তোড়ে কাঁটাতার-যন্ত্রণা তছনছ হয়ে
যুদ্ধভূমি ভেদ করে মাথা তুলে দাঁড়াক
কচি পাতা…’। (কবিতা - কচি পাতা)
এমনই সব পৃষ্ঠাজোড়া কবিতার সমাহারে প্রকাশিত কবির এই পঞ্চম কাব্যগ্রন্থে হার্ড বোর্ড বাঁধাই গ্রন্থের কাগজ ও ছাপার মান যথাযথ। কিছু বানান, বিশেষ করে প্রত্যয়-বিভক্তির ক্ষেত্রে কিছু বিসংগতি আছে যদিও অক্ষর ও পঙ্ক্তিবিন্যাস যথাযথ। সৌরভ দে’র প্রচ্ছদ প্রাসঙ্গিক ও নান্দনিক। দ্বিতীয় ব্লার্বে রয়েছে সংক্ষিপ্ত কবি-পরিচিতি যদিও অগতানুগতিকভাবে প্রথম ব্লার্বটি রয়ে গেছে খালি যদিও আলোচ্য গ্রন্থটির বিষয়ে লেখার ছিল অনেক কিছুই। কবি গ্রন্থটি উৎসর্গ করেছেন তাঁর সাতজন শ্রদ্ধাস্পদ প্রিয়জনদের। সব মিলিয়ে বিষয়ভিত্তিক এক কাব্যসুষমামণ্ডিত কবিতার সম্ভার আলোচ্য গ্রন্থটি।
বিদ্যুৎ চক্রবর্তী
প্রকাশক - নির্বাণ বুক্‌স
মূল্য - ১৭০ টাকা, যোগাযোগ - ৮৬৩৮৫১৬১০৬

Comments

Popular posts from this blog

শেকড়ের টানে নান্দনিক স্মরণিকা - ‘পরিযায়ী’

রামকৃষ্ণনগর । প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আবহে বরাক উপত্যকার এক ঐতিহ্যময় শহর । বিশেষ করে শিক্ষাদীক্ষার ক্ষেত্রে চিরদিনই এক অগ্রণী স্থান হিসেবে উচ্চারিত হয়ে আসছে এই নাম । বৃহত্তর রামকৃষ্ণনগরের গোড়াপত্তনের ইতিহাস বহুদিনের । দেশভাগের আগে ও পরে , উত্তাল সময়ে স্থানচ্যূত হয়ে এখানে থিতু হতে চাওয়া মানুষের অসীম ত্যাগ ও কষ্টের ফলস্বরূপ গড়ে ওঠে এক বিশাল বাসযোগ্য অঞ্চল । শুধু রুটি , কাপড় ও ঘরের স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রই নয় , এর বাইরে শিক্ষা অর্জনের ও শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে মমনশীলতার পরিচয় দিয়েছিলেন সেইসব মহামানবেরা । ফলস্বরূপ এক শিক্ষিত সমাজব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল যদিও উচ্চশিক্ষার জন্য পরবর্তী প্রজন্মকে বেরোতে হয়েছিল নিজ বাসস্থান ছেড়ে । শিলচর তখন এ অঞ্চলের প্রধান শহর হওয়ায় স্বভাবতই শিক্ষা ও উপার্জনের স্থান হিসেবে পরিগণিত হয় । এবং স্বভাবতই রামকৃষ্ণনগর ছেড়ে এক বৃহৎ অংশের মানুষ এসে পাকাপাকিভাবে থাকতে শুরু করেন এই শিলচরে । এই ধারা আজও চলছে সমানে । শিলচরে এসেও শেকড়ের টানে পরস্পরের সাথে যুক্ত থেকে রামকৃষ্ণনগর মূলের লোকজনেরা নিজেদের মধ্যে গড়ে তোলেন এক সৌহার্দমূলক বাতাবরণ । এবং সেই সূত্রেই ২০০০ সালে গঠিত হয় ‘ ...

কবির মজলিশ-গাথা

তুষারকান্তি সাহা   জন্ম ১৯৫৭ সাল৷ বাবা প্ৰয়াত নিৰ্মলকান্তি সাহা ও মা অমলা সাহার দ্বিতীয় সন্তান   তুষারকান্তির ৮ বছর বয়সে ছড়া রচনার মাধ্যমে সাহিত্য ভুবনে প্ৰবেশ৷ ‘ ছায়াতরু ’ সাহিত্য পত্ৰিকায় সম্পাদনার হাতেখড়ি হয় কলেজ জীবনে অধ্যয়নকালীন সময়েই৷ পরবৰ্তী জীবনে শিক্ষকতা থেকে সাংবাদিকতা ও লেখালেখিকেই পেশা হিসেবে গ্ৰহণ করেন৷ প্ৰথম ছড়া প্ৰকাশ পায় সাতের দশকে ‘ শুকতারা ’ য়৷ এরপর ‘ দৈনিক যুগশঙ্খ ’ পত্ৰিকার ‘ সবুজের আসর ’, দৈনিক সময়প্ৰবাহ ও অন্যান্য একাধিক কাগজে চলতে থাকে লেখালেখি৷ নিম্ন অসমের সাপটগ্ৰামে জন্ম হলেও বৰ্তমানে গুয়াহাটির স্থায়ী বাসিন্দা তুষারকান্তির এ যাবৎ প্ৰকাশিত গ্ৰন্থের সংখ্যা ছয়টি৷ এগুলো হচ্ছে নগ্ননিৰ্জন পৃথিবী (দ্বৈত কাব্যগ্ৰন্থ) , ভবঘুরের অ্যালবাম (ব্যক্তিগত গদ্য) , একদা বেত্ৰবতীর তীরে (কাব্যগ্ৰন্থ) , প্ৰেমের গদ্যপদ্য (গল্প সংকলন) , জীবনের আশেপাশে (উপন্যাস) এবং শিশু-কিশোরদের জন্য গল্প সংকলন ‘ গাবুদার কীৰ্তি ’ ৷ এছাড়াও বিভিন্ন পত্ৰপত্ৰিকায় প্ৰকাশিত হয়েছে শিশু কিশোরদের উপযোগী অসংখ্য অগ্ৰন্থিত গল্প৷ রবীন্দ্ৰনাথের বিখ্যাত ছড়া , কবিতা ও একাধিক ছোটগল্প অবলম্বনে লিখেছেন ...

শুদ্ধ বানানচর্চার প্রয়োজনীয়তা ও সচেতনতা

উত্তরপূর্বের বাংলা সাহিত্যচর্চার পরিসরকে কেউ কেউ অভিহিত করেন তৃতীয় ভুবন বলে , কেউ আবার বলেন ঈশান বাংলা । অনেকেই আবার এই জাতীয় ভুবনায়নকে তীব্র কটাক্ষ করে বলেন - সাহিত্যের কোনও ভুবন হয় না । সাহিত্যকে ভৌগোলিক গণ্ডির মধ্যে আটকে রাখা যায় না । কারও ব্যক্তিগত অভিমতের পক্ষে বা বিপক্ষে বলার কিছুই থাকতে পারে না । যে যেমন ভাবতে বা বলতেই পারেন । কিন্তু প্রকৃত অবস্থাটি অনুধাবন করতে গেলে দেখা যায় বাংলার এই যে অখণ্ড বিশ্বভুবন সেখানে কিন্তু কয়েকটি স্পষ্ট বিভাজন রয়েছে । আঞ্চলিক ভাষায় বাংলা সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রটি ধর্তব্যের মধ্যে না আনলেও মান্য বাংলা চর্চার ক্ষেত্রে আমরা প্রথমেই দেখব যে বাংলাদেশের বাংলা ও পশ্চিমবঙ্গের বাংলার মধ্যে শব্দরূপ তথা গৃহীত বানানের ক্ষেত্রেও বহু তারতম্য রয়েছে । সংলাপ বা প্রেক্ষাপট অনুযায়ী মান্য বাংলারও ভিন্ন ভিন্ন রূপের প্রয়োগ দেখতে পাওয়া যায় । যেমন পানি / জল , গোসল / স্নান , নাস্তা / প্রাত : রাশ ইত্যাদি । সেসবের উৎস সন্ধানে না গিয়ে শুধু এটাই বলার যে বাংলা সাহিত্য চর্চার ক্ষেত্রে আঞ্চলিকতা এক অমোঘ পর্যায় । বিহার / ঝাড়খণ্ডের বাংলা আর নিউইয়র্কের বাংলা এক হলেও সাহিত্যে তা...