Skip to main content

শিশুসাহিত্যে নবতম সংযোজন, ছড়া সংকলন - ‘ধুৎতেরিকি’


লোকসাহিত্য বা লোকসংস্কৃতির অন্যতম অঙ্গ হচ্ছে ছড়া। ছড়ার প্রধান আঙ্গিক বা অনুষঙ্গ হচ্ছে তার ছন্দ এবং স্বল্প পরিসরে বৃহৎ ভাবনা-বোধের প্রকাশ। কবিতার সঙ্গে ছড়ার মূল ফারাকই হচ্ছে এই ছন্দের প্রয়োগ ও পরিসর। প্রাচীনকাল থেকেই ছড়ার নির্মাণ, প্রচার ও প্রসার চলে আসছে আজ অবধি। শিশুর মনোরঞ্জন, নীতিশিক্ষা, সমাজশিক্ষা তথা জনসাধারণের কাছে দেশ ও সমাজের হাল হকিকত পৌঁছে দেওয়া ও প্রশংসা-প্রতিবাদের এক অতীব সহজ ও কার্যকরী পন্থা হিসেবে তাই ছড়ার গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নাতীত।
প্রাচীন কাল থেকে শুরু করে আজকের দিনেও সাহিত্যের এই দিকটিতে তাই কবিতা, গল্পের পাশাপাশি ছড়াও লেখা হচ্ছে যদিও বিশেষত ছন্দনির্মাণে সাবলীলতার অভাবে এই নির্মাণ বা সৃষ্টির পরিসর সীমিত। বস্তুত ছড়া নয় শুধু, শিশু সাহিত্য বিষয়ক সৃষ্টির পরিসংখ্যানও তাই বলে। বাংলা সাহিত্যে বিশিষ্ট ছড়াকারের সংখ্যা আজকের দিনে নিতান্তই সীমিত। ছড়া বলা বা শোনা যতটা সহজ, ছড়া লেখা তার চাইতে বহুগুণ বেশি কঠিন।
সেই কঠিন কাজটিই করেছেন কবি ও লেখক হৃষিকেশ নাথ। দু:সাহসিক নাহলেও এই সাহসী সৃষ্টিকর্মের নিদর্শন হিসেবে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর ছড়া সংকলন - ‘ধুৎতেরিকি’। বিরক্তি বা আপশোশ প্রকাশজনক অব্যয় ‘ধুৎ’ বা ‘ধুত্তোর’ থেকেই আঞ্চলিক উচ্চারণে এসেছে এই শব্দটি। সঙ্গে যুক্ত হয়েছে হিন্দি ‘তেরি কি’ শব্দদ্বয়। সবটুকু মিলিয়ে বাংলায় বহুল কথিত হয়ে এক বিরক্তি, বিস্ময়সূচক অব্যয় হিসেবে এর প্রয়োগ।
ছড়া সাধারণত সংক্ষিপ্ত আকারের হয়ে থাকে যদিও খানিক প্রসারিত হতেও দেখা যায়। তবু সীমিত পঙ্‌ক্তির সমাহারেই ছড়া অধিকতর আকর্ষণীয় ও কার্যকর হতে দেখা যায়। ১১০ পৃষ্ঠার আলোচ্য গ্রন্থটিতে ছড়াকার হৃষিকেশ নাথের মোট ১০০টি ছড়া রয়েছে নানা বিষয় ও আঙ্গিকে। এ নিয়ে বিস্তৃত ভূমিকায় রবীন্দ্রনাথ মহিলা মহাবিদ্যালয়, করিমগঞ্জ-এর বাংলা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ড. তনুশ্রী ঘোষ লিখছেন - ‘...জীবন নিয়ে বড় সতর্ক আমাদের লেখক। প্রতিটি পঙ্‌ক্তি - তাই বুঝে কয়ে তৈরি করেছেন। এতবড় একখানি ছড়ার বই উপহার দিচ্ছেন দীক্ষিত পাঠকদের। আজকাল ডিজিটাল যুগে যখন সকলে মত্ত রীল বানাতে, ভিডিও বানাতে উদ্‌গ্রীব, তিনি কী সুন্দর একটি সৃষ্টিশীল জগৎ থেকে নতুন সাতরঙের আলপনার সন্ধান এঁকেছেন...।’
গ্রন্থকারের অধিকাংশ ছড়াই আবার প্রচলিত আঙ্গিকের বাইরে দীর্ঘ। এমনকী এক একটি ছড়া রয়েছে পৃষ্ঠাজোড়া। পরিসরের বাইরে, ছন্দের ক্ষেত্রেও বহুধাসজ্জিত এক একটি ছড়া। অর্থাৎ একই ছড়ায় একাধিক অক্ষরমাত্রাযুক্ত ছন্দের ব্যবহারও পরিলক্ষিত হয়েছে। ছন্দের সংজ্ঞায়িত ধারা সব ক্ষেত্রে কতটা রক্ষিত হয়েছে তা বিতর্কযোগ্য যদিও কিছুসংখ্যক ছড়ার অনাবিল ছন্দ পাঠকমনে দোলা দেবে নিশ্চিত -
আজব দেশ
মজার কথা
শুনেছ কখনও আগে ?
গোরুরা সব গাছে ছড়ে
পাখিরা হাঁটে মাঠে।

মাছ থাকে ডাঙায়
বাঘ সিংহ জলে
ডিম খেত মাটিতে
সবজি হয় চালে
আজব দেশ মজার কথা
শুনেছ কি আগে ?... (ছড়া - আজব দেশ-২)

ছড়ার সৃষ্টিতে ছন্দ নয়, ছড়াকার অধিক গুরুত্ব দিয়েছেন বিষয়বৈচিত্রে। অগুনতি বিষয়ের উপর শিক্ষণীয় ছড়ারই সমাহার আলোচ্য গ্রন্থটি যা শিশুকিশোরের অন্তরে বহু অজানা বিষয়ের জ্ঞানলাভে সহায়ক হবে। আঞ্চলিক ভাষার প্রয়োগ কিছুসংখ্যক ছড়ার রূপবৈচিত্র প্রকাশ করেছে। গ্রন্থের ছাপা, বাঁধাই অক্ষরবিন্যাস সবই যথাযথ। বানান ভুলের আধিক্য পরিলক্ষিত হয়েছে - এমনকী ছড়ার শিরোনামেও। ছড়াকার গ্রন্থটি উৎসর্গ করেছেন তাঁর ভ্রাতুস্পুত্রী ঐশী নাথ (সুইটি)কে। শুভ্রশংকর দাশের প্রচ্ছদ অনবদ্য যদিও প্রচ্ছদে প্রকাশনা সংস্থার লোগোর সংযুক্তি কতটা যুক্তিযুক্ত তা ভাবনার বিষয়। সব মিলিয়ে এক ব্যতিক্রমী প্রচেষ্টার ফল আলোচ্য গ্রন্থটি।
বিদ্যুৎ চক্রবর্তী
প্রকাশক - দিগন্ত প্রকাশনী, ধর্মনগর, উত্তর ত্রিপুরা
মূল্য - ২২০ টাকা, যোগাযোগ - ৮৮৩৭০৭৭২৫৮

Comments

Popular posts from this blog

শেকড়ের টানে নান্দনিক স্মরণিকা - ‘পরিযায়ী’

রামকৃষ্ণনগর । প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আবহে বরাক উপত্যকার এক ঐতিহ্যময় শহর । বিশেষ করে শিক্ষাদীক্ষার ক্ষেত্রে চিরদিনই এক অগ্রণী স্থান হিসেবে উচ্চারিত হয়ে আসছে এই নাম । বৃহত্তর রামকৃষ্ণনগরের গোড়াপত্তনের ইতিহাস বহুদিনের । দেশভাগের আগে ও পরে , উত্তাল সময়ে স্থানচ্যূত হয়ে এখানে থিতু হতে চাওয়া মানুষের অসীম ত্যাগ ও কষ্টের ফলস্বরূপ গড়ে ওঠে এক বিশাল বাসযোগ্য অঞ্চল । শুধু রুটি , কাপড় ও ঘরের স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রই নয় , এর বাইরে শিক্ষা অর্জনের ও শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে মমনশীলতার পরিচয় দিয়েছিলেন সেইসব মহামানবেরা । ফলস্বরূপ এক শিক্ষিত সমাজব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল যদিও উচ্চশিক্ষার জন্য পরবর্তী প্রজন্মকে বেরোতে হয়েছিল নিজ বাসস্থান ছেড়ে । শিলচর তখন এ অঞ্চলের প্রধান শহর হওয়ায় স্বভাবতই শিক্ষা ও উপার্জনের স্থান হিসেবে পরিগণিত হয় । এবং স্বভাবতই রামকৃষ্ণনগর ছেড়ে এক বৃহৎ অংশের মানুষ এসে পাকাপাকিভাবে থাকতে শুরু করেন এই শিলচরে । এই ধারা আজও চলছে সমানে । শিলচরে এসেও শেকড়ের টানে পরস্পরের সাথে যুক্ত থেকে রামকৃষ্ণনগর মূলের লোকজনেরা নিজেদের মধ্যে গড়ে তোলেন এক সৌহার্দমূলক বাতাবরণ । এবং সেই সূত্রেই ২০০০ সালে গঠিত হয় ‘ ...

নিবেদিত সাহিত্যচর্চার গর্বিত পুনরাবলোকন - ‘নির্বাচিত ঋতুপর্ণ’

সাধারণ অর্থে বা বলা যায় প্রচলিত অর্থে একটি সম্পাদনা গ্রন্থের মানে হচ্ছে মূলত অপ্রকাশিত লেখা একত্রিত করে তার ভুল শুদ্ধ বিচার করে প্রয়োজনীয় সংশোধন ও সম্পাদনার পর গ্রন্থিত করা । যেমনটি করা হয় পত্রপত্রিকার ক্ষেত্রে । অপরদিকে সংকলন গ্রন্থের অর্থ হচ্ছে শুধুই ইতিপূর্বে প্রকাশিত লেখাসমূহ এক বা একাধিক পরিসর থেকে এনে হুবহু ( শুধুমাত্র বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে ন্যূনতম সংশোধনসাপেক্ষে ) একত্রীকরণ । সেই হিসেবে আলোচ্য গ্রন্থটি হয়তো সম্পাদনা গ্রন্থ নয় , একটি সংকলন গ্রন্থ । বিস্তারিত জানতে হলে যেতে হবে সম্পাদক ( সংকলক ) সত্যজিৎ নাথের বিস্তৃত ভূমিকায় । পুরো ভূমিকাটিই যদি লেখা যেতো তাহলে যথাযথ হতো যদিও পরিসর সে সায় দেয় না বলেই অংশবিশেষ তুলে ধরা হলো এখানে - ‘ সালটা ১৯৯০ । ‘ দৈনিক সোনার কাছাড় ’- এ একবছর হল আসা - যাওয়া করছি । চাকরির বয়স হয়নি তাই চাকরি নয় , এই ‘ আসা - যাওয়া ’ । …. হঠাৎ করেই একদিন ভূত চাপল মাথায় - পত্রিকা বের করব । ‘… সেই শুরু । অক্টোবর ১৯৯০ সালে শারদ সংখ্যা দিয়ে পথচলা শুরু হল ‘ঋতুপর্ণ’র। পরপর দুমাস বের করার পর সেটা হয়ে গেল ত্রৈমাসিক। পুরো পাঁচশো কপি ছাপাতাম ‘মৈত্রী প্রকাশনী’ থেকে।...

মহানিষ্ক্ৰমণ

প্রায় চল্লিশ বছর আগে গ্রামের সেই মায়াময় বাড়িটি ছেড়ে আসতে বেজায় কষ্ট পেয়েছিলেন মা ও বাবা। স্পষ্ট মনে আছে অর্ঘ্যর, এক অব্যক্ত অসহায় বেদনার ছাপ ছিল তাঁদের চোখেমুখে। চোখের কোণে টলটল করছিল অশ্রু হয়ে জমে থাকা যাবতীয় সুখ দুঃখের ইতিকথা। জীবনে চলার পথে গড়ে নিতে হয় অনেক কিছু, আবার ছেড়েও যেতে হয় একদিন। এই কঠোর বাস্তব সেদিন প্রথমবারের মতো উপলব্ধি করতে পেরেছিল অর্ঘ্যও। সিক্ত হয়ে উঠছিল তার চোখও। জন্ম থেকে এখানেই যে তার বেড়ে ওঠা। খেলাধুলা, পড়াশোনা সব তো এখানেই। দাদাদের বাইরে চলে যাওয়ার পর বারান্দাসংলগ্ন বাঁশের বেড়াযুক্ত কোঠাটিও একদিন তার একান্ত ব্যক্তিগত কক্ষ হয়ে উঠেছিল। শেষ কৈশোরে এই কোঠাতে বসেই তার শরীরচর্চা আর দেহজুড়ে বেড়ে-ওঠা লক্ষণের অবাক পর্যবেক্ষণ। আবার এখানে বসেই নিমগ্ন পড়াশোনার ফসল ম্যাট্রিকে এক চোখধাঁধানো ফলাফল। এরপর একদিন পড়াশোনার পাট চুকিয়ে উচ্চ পদে চাকরি পেয়ে দাদাদের মতোই বাইরে বেরিয়ে যায় অর্ঘ্য, স্বাভাবিক নিয়মে। ইতিমধ্যে বিয়ে হয়ে যায় দিদিরও। সন্তানরা যখন বড় হয়ে বাইরে চলে যায় ততদিনে বয়সের ভারে ন্যুব্জ বাবা মায়ের পক্ষে আর ভিটেমাটি আঁকড়ে পড়ে থাকা সম্ভব হয়ে ওঠে না। বহু জল্পনা কল্পনার শেষে ত...