Skip to main content

বিবর্তন


তপ্ত দীর্ঘ ছুটির দিনের অবসরময় শেষবিকেলে উঠোনের এক ধারে পরিণত আমগাছটির বিলীয়মান ছায়ায় বসে নীরবে আকাশ পানে তাকিয়ে থাকে নম্রতাযাপিত জীবনের নানা কথা এসে জড়ো হয় মনের মধ্যে। এক একটি বিমূর্ত চরিত্র যেন মূর্ত হতে থাকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে। কিন্তু নম্রতার জীবনের সবচাইতে বর্ণিল, সবচাইতে আকর্ষণীয় চরিত্র কিছুতেই যেন মূর্ত হতে চায় না। সন্ধ্যা হতে না হতেই কালো হতে থাকা আকাশের লক্ষ কোটি উদীয়মান তারার মাঝে কিছুতেই খুঁজে পায় না তাঁকে। মনখারাপের ঘোর লাগা আবেশে শান্ত গগনে খুঁজে বেড়ায় সেই প্রশান্ত মুখচ্ছবিটা। কেমন করে যে হারিয়ে যায় সব ভালো লাগা মুখগুলো। বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারে না এভাবে। মনের অতল থেকে অশ্রুধারা ঝরতে থাকে দু'চোখ বেয়ে। ঝাপসা হয়ে যায় প্রকৃতি, আকাশ ধীরে ধীরে মনগগনে ভেসে ওঠে সেই প্রতিচ্ছবি, সেই আদুরে কণ্ঠস্বর
তোর সেই শৈশবের কবিতাগুলো সব কোথায় হারিয়ে গেল রে নমি ?”
ঘোরের মধ্যে থেকেও যেন চমকে ওঠে নম্রতাকবিতা ? তাই তো। কবে কোথায় কীভাবে যে হারিয়ে গেল দিনগুলো বোঝে উঠতে না উঠতেই তো শুরু হয়ে গেল মাটিতে দাঁড়ানোর লড়াই। এই পৃথিবীতে আজ যে দাঁড়াবার জায়গা নেই এতটুকু। চারদিকে শুধু অনি:শেষ ইঁদুরদৌড়। মা বলতেন - ‘তোকে নিজের পায়ে দাঁড়াতেই হবে রে মা। আমার মতো হলে চলবে না।’
নম্রতা বুঝত না মা’র কোথায় অতৃপ্তি। দিব্যি হেসেখেলেই তো চলে যাচ্ছে দিন। বাবার সঙ্গে মায়ের সম্পর্কটাও নম্রতার কাছে এক রহস্য হয়ে থাকত। সেই রহস্যের জাল ভেদ করার ইচ্ছে কিংবা ক্ষমতা কোনটাই অবশ্য ছিল না নম্রতার। দিন চলে যাচ্ছিল দ্রুতবেগে। নম্রতা এগোয়... দৌড়োয়... এগোতে এগোতে কখন যে হয়ে উঠেছে এক সার্থক নারী তা সে নিজেই জানে না। 
 
ঘোরের মধ্যেই অস্ফুট আবেগে কাতর কণ্ঠে বলে - তুমিই বলো না বাবা। কোথায় হারিয়ে গেল ? তুমিই তো বলেছিলে এবিসিডির পাশাপাশি আমার অআকখরও হাতেখড়ি দিয়েছিলে তুমি নিজে। আমার সাত বছর বয়সে মুখে মুখে বলা কবিতা - সাত সাগরের সময় নেই - নাকি দারুণ লাগতো তোমার শুনতে। আমার শৈশব নাকি ছিল তোমার কাছে এক আকাশছোঁয়া প্রত্যাশা।
– তাই তো ছিল রে মা। আমার যত স্বপ্ন সবই তো রচে যেতাম তোকে ঘিরেই। যে ভাষায় মুখের কথা সেই ভাষাতেই তোর কত জারিজুরি। কী করে যে কী হয়ে গেল। দেশটাই আর নিজের যখন রইল না তখন ভাষা থাকে কী করে বল ?
নম্রতা বুঝতে পারে বাবার ব্যথা। চারদিকে বিদেশির নোটিশ আসছে দেদার। পুলিশ কিংবা প্রশাসনের কোন দায় নেই সত্যাসত্য যাচাইয়ের। যাকে ইচ্ছে নোটিশ ধরিয়ে দিলেই হল। এবার তারই যত দায় নিজেকে স্বদেশি প্রতিপন্ন করার। কোর্টে চাকরি করেন বলে বাবা এসব ভালো করেই জানেন, বোঝেন। সম্ভ্রান্ত লোকজনও এই অন্যায়ের আওতার বাইরে নয়। আইনের শাসন আর রইল না মনে হয়। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এমন তুঘলকি কাণ্ড কী করে ঘটতে পারে ভেবে পায় না নম্রতা।
সময় যেন কালচক্র হয়ে ঘিরে ধরেছে নম্রতার সকল অস্তিত্ব। বাবাকে চিন্তার ঘোর থেকে বের করতে নম্রতা বলে -
– সাত সাগরের সময় নেই - কথাটি তো বড্ড ভারিক্কি। তাই না বাবা ? সেই ছেলেবেলায় সেসব কী করে বলতাম আমি ?
- আমি আর তোর মাও তোর এসব কাণ্ডকারখানা দেখে অবাক হয়ে যেতাম। তবে বড্ড ভালো লাগত। নিজের মাতৃভাষায় এই বয়সে এমন সৃষ্টি আমাদের অন্তরে এক উচ্চাশার বীজ রোপণ করেছিল সেদিন। তোর অবাধ ছুটে চলা, তোর খিলখিল নিষ্পাপ হাসির ফোয়ারায় আমরা ভেসে যেতাম এক স্বর্গীয় ভালোলাগায়। তোর অর্থপূর্ণ স্বরচিত বাক্যে বিস্মিত হলেও দস্তরমতো গর্বিত বোধ করতাম।
– তোমরা বোধহয় ভেবেছিলে আমি বড় হয়ে একজন নামি কবি-সাহিত্যিক হব। তাই না বাবা?
– এমন একটি ধারণা যে গড়ে ওঠেনি তা অস্বীকার করি কীভাবে বল? তবে এ নিয়ে বেশি ভাবতাম না কেউই। কারণ মানুষের জীবন কীভাবে গড়ে উঠবে সে তো মানুষের হাতে নয় রে মা। এসব নির্ধারণ করেন একজনই। তিনিই উপর থেকে সব কিছু পরিচালনা করেন।
- শেষ পর্যন্ত তাই তো হল বাবা। বাংলাটা যে কেমন করে হারিয়ে গেল আমার জীবন থেকে তা নিজেই আর বুঝতে পারলাম কই ? আজও বড্ড আপশোশ হয় তাই।
- মাঝে মাঝে নিজে থেকেও তো চেষ্টা করতে পারিস। তোর ভিতরে যখন আছে তখন নিশ্চয়ই তুই পারবি।
– কী যে বলো বাবা। দেখছই তো দিন আমার কেমন করে কাটছে। ইংরেজিতে নোট্‌স লিখতে লিখতেই তো অফিসে শেষ হয়ে যায় দিন। আর এর বাইরে যা আছে সবটাই তো ছুটকির। আমার আজকের ছুটকি যে তোমার সেদিনের নমি বাবা।
- সে কি আর বুঝি না রে মা ? ছুটকির মাঝে তো আমি অহরহ তোকেই খুঁজে পাই। তোর সেই সরল চপল বেড়ে ওঠা। আমাদের জীবনে সেই এক সময়ই তো ছিল সোনায় মোড়া। সারা জীবনে যত সুখ কুড়িয়েছি তার মধ্যে আমাদের শ্রেষ্ঠ সুখ ছিল তোর শৈশব।
ভাবুক হয়ে ওঠে নম্রতা। মনে পড়ে যায় মায়ের কথা। মনে পড়ে যায় ছোট থাকতে কানে সামান্য একটি কাঠপেন্সিলের খোঁচা লেগে কেঁদে উঠতেই নিমেষে মায়ের চোখ ফেটে অঝোর ধারায় গড়িয়ে পড়েছিল অশ্রুধারা। মনে পড়ে একদিন স্কুল থেকে ফিরে আসতে একটু দেরি হওয়ায় কী করুণ দশাই না হয়েছিল তাঁর। পৃথিবীর সব মা-বাবারাই কী করে যে এতটা নি:স্বার্থ হন তা ভাবলেই অবাক হতে হয়। চোখের সামনে যেন ফ্ল্যাশব্যাকের মতো নিজের জীবনের দিনগুলোই ভাসতে থাকে জ্যান্ত হয়ে। মেয়ে থেকে মা হয়ে ওঠার এই বিবর্তনে সে নিজেও যে কেমন করে একটু একটু করে বদলে গেল আমূল তাও এক অবাক ঘটনা বইকী। আজ ছুটকি যেন তার নিজেরই প্রতিচ্ছবি। নিজের শৈশব-কৈশোরের ছবি, মায়ের অগাধ যত্ন, আদর আর বাবার নীরব প্রশ্রয় আর আজকের ছুটকির মায়াময় মুখ - সব যেন একাকার হয়ে যায় একসময়। চোখের সামনে এক বিশালাকায় বর্ণমালা যেন পৃথিবীর যাবতীয় রং নিয়ে মেঘপিণ্ডের আকার ধারণ করে গ্রস্ত করতে থাকে তাকে। ধীরে ধীরে। 
 
মাম্মি” - সাত বছরের ছুটকির আচমকা ডাকে ঘোর কেটে যায় নম্রতার। চোখের সামনে থেকে নিমেষে হারিয়ে যায় সেই গোলাকার রঙিন মেঘপিণ্ড, হারিয়ে যায় এতদিনের তপস্যার পর দেখা মেলা বাবার অবয়বটা। বিদেশিবাবা এখন সাত সাগর পেরিয়ে মহাশূণ্যের মহা আঙিনায়, লক্ষ কোটি তারার মাঝে হয়তো খুঁজে পেয়েছেন আপন দেশ।
– একটা রাইমস্ বলবো ? - বিকেলের ঘুম সেরে আলতো পায়ে হেঁটে হেঁটে আমগাছের নীচে মাকে খুঁজে পেয়ে তাঁর গলা জড়িয়ে ধরে, তাঁকে খুশি করতে জিজ্ঞেস করে ছুটকি।
– না, একদম না !! - বলে নিজেরই অজান্তে চিৎকার করে উঠে নম্রতাপরমুহূর্তেই নিজেকে সামলে নিয়ে কোলে তোলে নেয় ছুটিকিকে। দু’গালে চুমু খেয়ে বলে - পারলে একটি ছড়া শোনা মা, একটি কবিতা...
ফ্যালফ্যাল করে মায়ের সিক্ত চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে ছুটকি। নম্রতা আবার ভাসে চোখের জলে।

বিদ্যুৎ চক্রবর্তী

Comments

Popular posts from this blog

শেকড়ের টানে নান্দনিক স্মরণিকা - ‘পরিযায়ী’

রামকৃষ্ণনগর । প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আবহে বরাক উপত্যকার এক ঐতিহ্যময় শহর । বিশেষ করে শিক্ষাদীক্ষার ক্ষেত্রে চিরদিনই এক অগ্রণী স্থান হিসেবে উচ্চারিত হয়ে আসছে এই নাম । বৃহত্তর রামকৃষ্ণনগরের গোড়াপত্তনের ইতিহাস বহুদিনের । দেশভাগের আগে ও পরে , উত্তাল সময়ে স্থানচ্যূত হয়ে এখানে থিতু হতে চাওয়া মানুষের অসীম ত্যাগ ও কষ্টের ফলস্বরূপ গড়ে ওঠে এক বিশাল বাসযোগ্য অঞ্চল । শুধু রুটি , কাপড় ও ঘরের স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রই নয় , এর বাইরে শিক্ষা অর্জনের ও শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে মমনশীলতার পরিচয় দিয়েছিলেন সেইসব মহামানবেরা । ফলস্বরূপ এক শিক্ষিত সমাজব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল যদিও উচ্চশিক্ষার জন্য পরবর্তী প্রজন্মকে বেরোতে হয়েছিল নিজ বাসস্থান ছেড়ে । শিলচর তখন এ অঞ্চলের প্রধান শহর হওয়ায় স্বভাবতই শিক্ষা ও উপার্জনের স্থান হিসেবে পরিগণিত হয় । এবং স্বভাবতই রামকৃষ্ণনগর ছেড়ে এক বৃহৎ অংশের মানুষ এসে পাকাপাকিভাবে থাকতে শুরু করেন এই শিলচরে । এই ধারা আজও চলছে সমানে । শিলচরে এসেও শেকড়ের টানে পরস্পরের সাথে যুক্ত থেকে রামকৃষ্ণনগর মূলের লোকজনেরা নিজেদের মধ্যে গড়ে তোলেন এক সৌহার্দমূলক বাতাবরণ । এবং সেই সূত্রেই ২০০০ সালে গঠিত হয় ‘ ...

কবির মজলিশ-গাথা

তুষারকান্তি সাহা   জন্ম ১৯৫৭ সাল৷ বাবা প্ৰয়াত নিৰ্মলকান্তি সাহা ও মা অমলা সাহার দ্বিতীয় সন্তান   তুষারকান্তির ৮ বছর বয়সে ছড়া রচনার মাধ্যমে সাহিত্য ভুবনে প্ৰবেশ৷ ‘ ছায়াতরু ’ সাহিত্য পত্ৰিকায় সম্পাদনার হাতেখড়ি হয় কলেজ জীবনে অধ্যয়নকালীন সময়েই৷ পরবৰ্তী জীবনে শিক্ষকতা থেকে সাংবাদিকতা ও লেখালেখিকেই পেশা হিসেবে গ্ৰহণ করেন৷ প্ৰথম ছড়া প্ৰকাশ পায় সাতের দশকে ‘ শুকতারা ’ য়৷ এরপর ‘ দৈনিক যুগশঙ্খ ’ পত্ৰিকার ‘ সবুজের আসর ’, দৈনিক সময়প্ৰবাহ ও অন্যান্য একাধিক কাগজে চলতে থাকে লেখালেখি৷ নিম্ন অসমের সাপটগ্ৰামে জন্ম হলেও বৰ্তমানে গুয়াহাটির স্থায়ী বাসিন্দা তুষারকান্তির এ যাবৎ প্ৰকাশিত গ্ৰন্থের সংখ্যা ছয়টি৷ এগুলো হচ্ছে নগ্ননিৰ্জন পৃথিবী (দ্বৈত কাব্যগ্ৰন্থ) , ভবঘুরের অ্যালবাম (ব্যক্তিগত গদ্য) , একদা বেত্ৰবতীর তীরে (কাব্যগ্ৰন্থ) , প্ৰেমের গদ্যপদ্য (গল্প সংকলন) , জীবনের আশেপাশে (উপন্যাস) এবং শিশু-কিশোরদের জন্য গল্প সংকলন ‘ গাবুদার কীৰ্তি ’ ৷ এছাড়াও বিভিন্ন পত্ৰপত্ৰিকায় প্ৰকাশিত হয়েছে শিশু কিশোরদের উপযোগী অসংখ্য অগ্ৰন্থিত গল্প৷ রবীন্দ্ৰনাথের বিখ্যাত ছড়া , কবিতা ও একাধিক ছোটগল্প অবলম্বনে লিখেছেন ...

নিবেদিত সাহিত্যচর্চার গর্বিত পুনরাবলোকন - ‘নির্বাচিত ঋতুপর্ণ’

সাধারণ অর্থে বা বলা যায় প্রচলিত অর্থে একটি সম্পাদনা গ্রন্থের মানে হচ্ছে মূলত অপ্রকাশিত লেখা একত্রিত করে তার ভুল শুদ্ধ বিচার করে প্রয়োজনীয় সংশোধন ও সম্পাদনার পর গ্রন্থিত করা । যেমনটি করা হয় পত্রপত্রিকার ক্ষেত্রে । অপরদিকে সংকলন গ্রন্থের অর্থ হচ্ছে শুধুই ইতিপূর্বে প্রকাশিত লেখাসমূহ এক বা একাধিক পরিসর থেকে এনে হুবহু ( শুধুমাত্র বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে ন্যূনতম সংশোধনসাপেক্ষে ) একত্রীকরণ । সেই হিসেবে আলোচ্য গ্রন্থটি হয়তো সম্পাদনা গ্রন্থ নয় , একটি সংকলন গ্রন্থ । বিস্তারিত জানতে হলে যেতে হবে সম্পাদক ( সংকলক ) সত্যজিৎ নাথের বিস্তৃত ভূমিকায় । পুরো ভূমিকাটিই যদি লেখা যেতো তাহলে যথাযথ হতো যদিও পরিসর সে সায় দেয় না বলেই অংশবিশেষ তুলে ধরা হলো এখানে - ‘ সালটা ১৯৯০ । ‘ দৈনিক সোনার কাছাড় ’- এ একবছর হল আসা - যাওয়া করছি । চাকরির বয়স হয়নি তাই চাকরি নয় , এই ‘ আসা - যাওয়া ’ । …. হঠাৎ করেই একদিন ভূত চাপল মাথায় - পত্রিকা বের করব । ‘… সেই শুরু । অক্টোবর ১৯৯০ সালে শারদ সংখ্যা দিয়ে পথচলা শুরু হল ‘ঋতুপর্ণ’র। পরপর দুমাস বের করার পর সেটা হয়ে গেল ত্রৈমাসিক। পুরো পাঁচশো কপি ছাপাতাম ‘মৈত্রী প্রকাশনী’ থেকে।...