Skip to main content

খয়েরি পাতার ভিড়ে ...... ‘টাপুর টুপুর ব্যথা’


ব্যথা যখন ঝরে পড়ে নিরলস তখনই বোধ করি সমান তালে পাল্লা দিয়ে ঝরে পড়ে কবিতারা আর না হলে একজন কবি ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর ব্যথাকেও কী করে ধরে রাখতে পারেন কবিতার পঙক্তি জুড়ে ? নষ্টনীড়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন - ‘মনে যখন বেদনা থাকে, তখন অল্প আঘাতেই গুরুতর ব্যথা বোধ হয়’। তাঁর অসংখ্য গান, কবিতা ও রচনায় তাই বেদনার মূর্ত প্রকাশ লক্ষ করা যায়।   
এমনই সব ব্যথা আর ভিন্ন ভিন্ন যাপনকথার কাব্যিক উপস্থাপন কবি বিশ্বজিৎ দেব-এর সদ্য প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ - ‘টাপুর টুপুর ব্যথা মোট ৫৬ পৃষ্ঠার এই কাব্যগ্রন্থের ৪৮ পৃষ্ঠা জুড়ে রয়েছে ৫৬ টি কবিতা। কিছু সংক্ষিপ্ত, কিছু পৃষ্ঠাজোড়া। ভূমিকায় বিশিষ্ট সাহিত্যিক রতীশ দাস লিখছেন - ... বিশ্বজিতের কবিতাগুলো অনেকটা তার কাঠখোদাই শিল্পের রিলিফ-এর মতোই উচ্ছ্বাসধর্মী - যেন উত্তলাবতল তক্ষণজনিত আলো-আঁধারি মায়াবিজড়িত, পঙক্তিগুলো পাঠক পাঠিকার মনোযোগ দাবি করতেই পারে...।
এখান থেকেই আলোচ্য গ্রন্থের কবিতাগুলোর বিষয়ে একটা ধারণা করা যেতে পারে। এখানে উচ্ছ্বাস অর্থে আমাদের ধরে নিতে হবে কবির ভাবনার উচ্ছ্বাস, সে বিষাদেই হোক আর তাৎক্ষণিক কোনও ঘটনার জের হিসেবেই হোক। তাই হয়তো কবি করোনার মতো অতিমারিকেও অনায়াসে বলতে পারেন - হিরণ্ময় হাতিয়ার। প্রসঙ্গত করোনার আবহে লিখা হয়েছে একাধিক কবিতা। গ্রন্থের অধিকাংশ কবিতার নেপথ্যে রয়েছে এক যন্ত্রণা, এক ফেলে আসা অতীতের তন্ময়তা, বিষণ্ণতা আর স্মৃতিচারণ। উল্লেখ্য -
আমার ভীষণ খিদে পেয়েছে
আগুনের শীর্ষে উড়ছে ছাই।
নীরব দুপুর পথের পাশে
জ্বলছে আবর্জনা পরিষ্কার চাই।
 
স্বচ্ছতার স্বচ্ছ ভাষায়
তখন ভীষণ খিদে পায়।
গুমরে কেঁদে উঠছে আমার
মনের ভিতর ভস্ম ছাই। (কবিতা - পরিষ্কার চাই)।
সে অর্থে কাব্যগ্রন্থটির নামকরণ যথার্থ। কবির শেষ কথা -
‘যা কিছু বলার সে তো কবিতা -
জ্বালা, ভালোবাসা, বিবাদ, প্রতিবাদ,
বিলাপ, প্রলাপ, স্বপ্ন, দুঃখ, ব্যথা,
সবই তো কবিতা।’ (কবিতা - সেও কি কবিতা)।
এক একটি ভিন্ন ভিন্ন আবহে - যেমন মেঘ, বৃষ্টি এমন কি ভিডিও কনফারেন্সিংয়ের মতো বাস্তব নিয়েও কবির কলমে প্রসবিত হয়েছে তাৎক্ষণিক কবিতা - চিন্তাধারার বহিঃপ্রকাশ। ভাবনা এসে আঘাত করে কবির মনের কোঠায়এক্ষেত্রে কবির উচ্চারিত একান্ত আপন কিছু স্মৃতিবিজড়িত শব্দ পাঠকের কাছে অজানা থাকায় সৃষ্টি হয়েছে কিছু ধোঁয়াশাও।
কবিতার ধারা যদি বিশ্লেষণ করা যায় তাহলে দেখা যাচ্ছে অধিকাংশ কবিতাই আধুনিক কবিতার ধাঁচে লিখিত। একটি গ্রন্থের সব কবিতা একই ধারায় লিখাই স্বাভাবিক। সেক্ষেত্রে গ্রন্থের কিছু কবিতায় সঘনে অনুপ্রাস ও অন্ত্যমিলের ব্যবহার না করলেও চলে যেত। যেমন অনবধানতায় ঢুকে গেছে কিছু তৎসম শব্দও। আধুনিক বানান যথাযথ ভাবে অনুসৃত হয়েছে গ্রন্থ জুড়ে - দু’একটি ছাড়া।
কবিতা কবির সহজাত যাপন। কবিতাগুলোর কবিতা পাঠ করলেই এই বোধ অনুভূত হয়। বিচিত্র অনুষঙ্গে, ভিন্ন ভিন্ন আবহে মূলত এক অপ্রাপ্তির বেদনা, হারানো দিনের বিষণ্ণতা কবিমনকে ছেয়ে গেলেও কবিতার আশায় অপেক্ষমান হয়ে থাকেন কবি। খয়েরি পাতার ভিড়ে সবুজের প্রতীক্ষায় তাই তিনি লিখেন -
... পারিনি তার কৃষ্ণচূড়া রঙকে
দুধ-সাদা কাগজে সাজিয়ে দিতে
তেমনি করে,
যেমন করে সে সাজিয়েছিল;
বলেছিল, ‘এখানে আসিও...
নির্জন পাহাড়ের সানুদেশে;
সবুজের নিমন্ত্রণ রইল;
অনুবাদ করব পাখিদের গান
আগামী বসন্ত-দিনে’
 
কিন্তু এখনও খয়েরি পাতার ভিড়
পাহাড় থেকে পাহাড়ে।
(কবিতা - কিন্তু এখনও খয়েরি পাতার ভিড়)
জ্যাকেট কভারে হার্ড বোর্ড বাঁধাই তথা স্পষ্ট ছাপা, যথাযথ বর্ণ সংস্থাপন গ্রন্থের মান বাড়িয়েছে নিঃসন্দেহে। কবি এই গ্রন্থটি উৎসর্গ করেছেন তাঁর প্রিয়জনদের। কাঠখোদাই শিল্পী বিশ্বজিৎ একই আঙ্গিকে এঁকেছেন তাঁর মনের মতো প্রচ্ছদ যা শুধু নান্দনিকই নয়, প্রাসঙ্গিক এবং দৃষ্টিনন্দনও।
বিদ্যুৎ চক্রবর্তী
মূল্য - ১৫০ টাকা
প্রকাশক - আনন্দ প্রকাশ, নগাঁও
যোগাযোগ - ৮৬৩৮২৭৯৬৯৯

Comments

Post a Comment

Popular posts from this blog

শেকড়ের টানে নান্দনিক স্মরণিকা - ‘পরিযায়ী’

রামকৃষ্ণনগর । প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আবহে বরাক উপত্যকার এক ঐতিহ্যময় শহর । বিশেষ করে শিক্ষাদীক্ষার ক্ষেত্রে চিরদিনই এক অগ্রণী স্থান হিসেবে উচ্চারিত হয়ে আসছে এই নাম । বৃহত্তর রামকৃষ্ণনগরের গোড়াপত্তনের ইতিহাস বহুদিনের । দেশভাগের আগে ও পরে , উত্তাল সময়ে স্থানচ্যূত হয়ে এখানে থিতু হতে চাওয়া মানুষের অসীম ত্যাগ ও কষ্টের ফলস্বরূপ গড়ে ওঠে এক বিশাল বাসযোগ্য অঞ্চল । শুধু রুটি , কাপড় ও ঘরের স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রই নয় , এর বাইরে শিক্ষা অর্জনের ও শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে মমনশীলতার পরিচয় দিয়েছিলেন সেইসব মহামানবেরা । ফলস্বরূপ এক শিক্ষিত সমাজব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল যদিও উচ্চশিক্ষার জন্য পরবর্তী প্রজন্মকে বেরোতে হয়েছিল নিজ বাসস্থান ছেড়ে । শিলচর তখন এ অঞ্চলের প্রধান শহর হওয়ায় স্বভাবতই শিক্ষা ও উপার্জনের স্থান হিসেবে পরিগণিত হয় । এবং স্বভাবতই রামকৃষ্ণনগর ছেড়ে এক বৃহৎ অংশের মানুষ এসে পাকাপাকিভাবে থাকতে শুরু করেন এই শিলচরে । এই ধারা আজও চলছে সমানে । শিলচরে এসেও শেকড়ের টানে পরস্পরের সাথে যুক্ত থেকে রামকৃষ্ণনগর মূলের লোকজনেরা নিজেদের মধ্যে গড়ে তোলেন এক সৌহার্দমূলক বাতাবরণ । এবং সেই সূত্রেই ২০০০ সালে গঠিত হয় ‘ ...

নিবেদিত সাহিত্যচর্চার গর্বিত পুনরাবলোকন - ‘নির্বাচিত ঋতুপর্ণ’

সাধারণ অর্থে বা বলা যায় প্রচলিত অর্থে একটি সম্পাদনা গ্রন্থের মানে হচ্ছে মূলত অপ্রকাশিত লেখা একত্রিত করে তার ভুল শুদ্ধ বিচার করে প্রয়োজনীয় সংশোধন ও সম্পাদনার পর গ্রন্থিত করা । যেমনটি করা হয় পত্রপত্রিকার ক্ষেত্রে । অপরদিকে সংকলন গ্রন্থের অর্থ হচ্ছে শুধুই ইতিপূর্বে প্রকাশিত লেখাসমূহ এক বা একাধিক পরিসর থেকে এনে হুবহু ( শুধুমাত্র বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে ন্যূনতম সংশোধনসাপেক্ষে ) একত্রীকরণ । সেই হিসেবে আলোচ্য গ্রন্থটি হয়তো সম্পাদনা গ্রন্থ নয় , একটি সংকলন গ্রন্থ । বিস্তারিত জানতে হলে যেতে হবে সম্পাদক ( সংকলক ) সত্যজিৎ নাথের বিস্তৃত ভূমিকায় । পুরো ভূমিকাটিই যদি লেখা যেতো তাহলে যথাযথ হতো যদিও পরিসর সে সায় দেয় না বলেই অংশবিশেষ তুলে ধরা হলো এখানে - ‘ সালটা ১৯৯০ । ‘ দৈনিক সোনার কাছাড় ’- এ একবছর হল আসা - যাওয়া করছি । চাকরির বয়স হয়নি তাই চাকরি নয় , এই ‘ আসা - যাওয়া ’ । …. হঠাৎ করেই একদিন ভূত চাপল মাথায় - পত্রিকা বের করব । ‘… সেই শুরু । অক্টোবর ১৯৯০ সালে শারদ সংখ্যা দিয়ে পথচলা শুরু হল ‘ঋতুপর্ণ’র। পরপর দুমাস বের করার পর সেটা হয়ে গেল ত্রৈমাসিক। পুরো পাঁচশো কপি ছাপাতাম ‘মৈত্রী প্রকাশনী’ থেকে।...

মহানিষ্ক্ৰমণ

প্রায় চল্লিশ বছর আগে গ্রামের সেই মায়াময় বাড়িটি ছেড়ে আসতে বেজায় কষ্ট পেয়েছিলেন মা ও বাবা। স্পষ্ট মনে আছে অর্ঘ্যর, এক অব্যক্ত অসহায় বেদনার ছাপ ছিল তাঁদের চোখেমুখে। চোখের কোণে টলটল করছিল অশ্রু হয়ে জমে থাকা যাবতীয় সুখ দুঃখের ইতিকথা। জীবনে চলার পথে গড়ে নিতে হয় অনেক কিছু, আবার ছেড়েও যেতে হয় একদিন। এই কঠোর বাস্তব সেদিন প্রথমবারের মতো উপলব্ধি করতে পেরেছিল অর্ঘ্যও। সিক্ত হয়ে উঠছিল তার চোখও। জন্ম থেকে এখানেই যে তার বেড়ে ওঠা। খেলাধুলা, পড়াশোনা সব তো এখানেই। দাদাদের বাইরে চলে যাওয়ার পর বারান্দাসংলগ্ন বাঁশের বেড়াযুক্ত কোঠাটিও একদিন তার একান্ত ব্যক্তিগত কক্ষ হয়ে উঠেছিল। শেষ কৈশোরে এই কোঠাতে বসেই তার শরীরচর্চা আর দেহজুড়ে বেড়ে-ওঠা লক্ষণের অবাক পর্যবেক্ষণ। আবার এখানে বসেই নিমগ্ন পড়াশোনার ফসল ম্যাট্রিকে এক চোখধাঁধানো ফলাফল। এরপর একদিন পড়াশোনার পাট চুকিয়ে উচ্চ পদে চাকরি পেয়ে দাদাদের মতোই বাইরে বেরিয়ে যায় অর্ঘ্য, স্বাভাবিক নিয়মে। ইতিমধ্যে বিয়ে হয়ে যায় দিদিরও। সন্তানরা যখন বড় হয়ে বাইরে চলে যায় ততদিনে বয়সের ভারে ন্যুব্জ বাবা মায়ের পক্ষে আর ভিটেমাটি আঁকড়ে পড়ে থাকা সম্ভব হয়ে ওঠে না। বহু জল্পনা কল্পনার শেষে ত...