Skip to main content

হ্যাঙারে ঝুলে আছে আমার শার্ট...... এক কাকতাড়ুয়া জীবন ‘এখানে দিনের রং বদলায়’


প্রথমেই যে কথাটি বলে নিতে ইচ্ছে হয় তা হল নির্ভুল বানানের আস্ত একটি গ্রন্থ যা উত্তর-পূর্বের এই সাহিত্যবিশ্বে নিতান্তই বিরল সেখানে দাঁড়িয়ে বলতে গেলে এক অসাধ্য সাধন করেছে নতুন প্রকাশনী সংস্থা - শীতালং পাবলিকেশন, শিলচর। গোটা গ্রন্থে দু-একটি শব্দের বাইরে বানান ভুল তো বাদ, একটি ছাপার ভুলও খুঁজে পাওয়া যাবে না - এ এক চরম উৎকর্ষ, পরম প্রাপ্তি।
আশিসরঞ্জন নাথ কবি কিংবা লেখক হিসেবে যতটুকু পরিচিত তার চেয়ে ঢের বেশি করে পরিচিত একজন সফল সম্পাদক হিসেবে। তাঁর সম্পাদিত গবেষণাধর্মী পত্রিকা ‘প্রবাহ’ আজ নির্বিবাদে উত্তর-পূর্বের গর্ব। সেখান থেকে সরে এলে আলোচ্য গ্রন্থ ‘এখানে দিনের রং বদলায়’ কবি আশিসরঞ্জনের এযাবৎ প্রকাশিত দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ। প্রতিটি গ্রন্থের বাইরে ও ভিতরে একটি বিশেষ নির্যাস থাকে যে নির্যাস নাসারন্ধ্র নয় ধরা পড়ে রেটিনায়। একটি ছিমছাম প্রাসঙ্গিক প্রচ্ছদ, স্পষ্ট ছাপা, যথাযথ অক্ষরবিন্যাস, ভাব ও লিখনশৈলী একটি গ্রন্থকে করে তোলে পঠনীয়, দর্শনীয়, নয়নশোভন। কবি-প্রকাশকের যুগলবন্দিতে এর সবকটি গুণই বিদ্যমান আলোচ্য গ্রন্থে।
কবিতার গভীরে অবগাহন করলে কেমন অনুভব অনুভূত হয় ? সেই চেষ্টাই করা যাক তবে। আশিসের কবিতায় আগেও এমন অনুভব দেখা গেছে। কবির কবিতার উল্লেখযোগ্য দিক হল সহজভাবে সহজ কথাটি বলার ধরন। অকারণে তৎসম শব্দের ঝংকার তুলে কাব্যিকতা সৃষ্টির অহেতুক ঝঞ্ঝাট পোহাতে রাজি নন কবি। পাশাপাশি আবার দ্যোতনা ও ব্যঞ্জনার দিকটিকে লালন করেন সজ্ঞানে, সাবধানতায়। ফলে হারিয়ে যায় না কাব্যসুষমা। তবে এটাও ঠিক - কথায় বলে হাতের পাঁচ আঙুল সমান হয় না। তাই সেই সূত্রে বলাই যেতে পারে - একজন কবির সব কবিতাই যে একই রসায়ন বা একই ছন্দ, ধারায় প্রসবিত বা প্রবাহিত হবে এমন দিব্যি কবি নিজেও দিতে পারেন না এবং কবিতার রসগ্রাহীর পক্ষেও আশা করা সমীচীন হতে পারে না।
৫৬ পৃষ্ঠার পাকা বাঁধাইয়ের গ্রন্থে সন্নিবিষ্ট হয়েছে মোট ৪৮টি কবিতা। দুটি ব্লার্বই খালি রেখে দেওয়াটা সংগত মনে হয়নি। ক্রমে কবি বিষয়ক ও গ্রন্থ বিষয়ক সম্যক পরিচিতি জুড়ে দেওয়াই যেত - যদিও কবি-পরিচিতি আছে শেষ মলাটে। একটি করে প্যারাগ্রাফ সন্নিবিষ্ট হয়েছে ‘প্রকাশকের কথা’ ও ‘আমার কথা’ শিরোনামে যদিও প্যারাগ্রাফের শেষে কোনও নাম লেখা হয়নি। এটাও প্রত্যাশিত ছিল। গ্রন্থটি কবি উৎসর্গ করেছেন তাঁর ‘মা বাবা-কে’। স্বভাবতই ‘মা’ ও ‘বাবা’ বিষয়ক একগুচ্ছ কবিতা থাকছে গ্রন্থে। এছাড়াও একটি ব্যতিক্রমী ‘বিষয়’কে কবি অন্তর্ভুক্ত করেছেন। তা হল ‘মেরুদণ্ড’। এবং এই বিষয়ক কবিতাগুচ্ছই যেন অধিক আকর্ষণীয় তথা আবেদনময় হয়ে উঠেছে। সব মিলিয়ে মা-বিষয়ক তিনটি, বাবা-বিষয়ক চারটি ও মেরুদণ্ড-বিষয়ক ৯টি কবিতা রয়েছে গ্রন্থে। এছাড়াও কিছু কবিতায় এসেছে সবকটি অনুষঙ্গই। মা-বাবা বিষয়ক সব কবিতাতেই কাব্যিকতা প্রায় বর্জিত যদিও যথেষ্ট আবেগিক এবং সংলাপে, ঘটনায়, স্মৃতিচারণে যাপিত অনুভবের সুতোয় বাঁধা। আবার মাতৃভাষা বিষয়েও রয়েছে একাধিক কবিতা। চারটি কবিতার শিরোনামেও রয়েছে ‘মাতৃভাষা’। উনিশের জ্বালা বুকে ধরে বরাক থেকে প্রকাশিত গবেষণাধর্মী পত্রিকার সম্পাদক মাতৃভাষা বিষয়ক কবিতা সন্নিবিষ্ট করবেন না এমন হতেই পারে না। ‘মাতৃভাষা ৩’ শীর্ষক কবিতাটি এক ভিন্ন তাৎপর্য বহন করেছে দেশ-কাল-পাত্রের আবহে। মাতৃভাষা চর্চা হারিয়ে যাওয়ার বেদনা একইভাবে ফুটে উঠেছে মা ও বাবার হারিয়ে যাওয়ার মতো। এক অনন্য গরজ।  
অধিকাংশ নয় যেন সবকটি কবিতাই সংলাপধর্মী আত্মকথা। অনুভবসঞ্জাত আত্মোপলব্ধি -
আমার মনের লালিত কিছু কথা
কিছু কিছু মিষ্টিমাখা স্বপ্ন ছিল
অনেক যত্নে রেখেছিলাম গোপন সিন্দুকে...
এদিক ওদিক খুঁজতে গিয়ে দেখি
চতুর বেড়াল নিজের সন্তানকে মুখে করে
নিয়ে যাওয়ার মতো
আমার লালিত কথা, সঞ্চিত স্বপ্ন
নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে। (কবিতা - বেড়াল’)।
কবির কবিতায় অন্যতম অনুষঙ্গ হচ্ছে ‘শ্লেষ’। কিছু কবিতার অন্দরে অনায়াসে আবিষ্কৃত হয় তা -
একটি পুতুল উঠোন জুড়ে নাচছে
কখনও ধ্রুপদি তো খখনও ভারতনাট্যম...
উঠোনের পুতুলগুলি একজনের সুতোয় বাঁধা
সুতোর ইশারায় পুতুল নাচে
দর্শক হাততালি দেয়।
আমাদের উঠোন আর পথে এখন
ভালুক আর পুতুল নাচের খেলা জমে উঠেছে বেশ। (কবিতা - পুতুলনাচ’)।
এমনি নানা অনুষঙ্গে এক মিশ্র ভাবের কাব্যগ্রন্থ। গ্রন্থনাম শীর্ষক একটি কবিতাও আছে। রয়েছে কিছু উৎসর্গ-কবিতা। যাঁদের প্রতি লেখা হয়েছে এই কবিতাগুলি - বিজিৎকুমার ভট্টাচার্য, শঙ্খ ঘোষ, নীলমণি ফুকন, প্রবুদ্ধসুন্দর কর। সব মিলিয়ে একটি সহজ-পাঠের কাব্যগ্রন্থ ‘এখানে দিনের রং বদলায়’। নান্দনিক প্রচ্ছদের সৌজন্যে - অজিত দাশ। বর্ণ সংস্তাপন ও অলংকরণ - আশু চৌধুরী। মুদ্রণ - শরৎ ইম্প্রেশনস প্রাঃ লিঃ, কলকাতা। আলোচনার শেষে বাস্তব প্রেক্ষিতে আশাব্যঞ্জক একটি আস্ত কবিতার উদ্ধৃতি অপ্রাসঙ্গিক হবে না এটা বলা যায় -
ঝড় থেমে গেলে চরাচর শান্ত হয়ে যাবে
নুয়ে পড়া শিরদাঁড়ারা সোজা হয়ে যাবে
পৃথিবী আবার সুন্দর হয়ে উঠবে
সেজে উঠবে চরাচর
নতুন প্রাণে, নতুন গানে।
মেরুদণ্ড খুঁজে পাবে তার ঠিকানা। (কবিতা - আশা)
 
বিদ্যুৎ চক্রবর্তী
 
মূল্য - ১৫০ টাকা
যোগাযোগ - ৮৮১১০১০৫৪০ 

Comments

Post a Comment

Popular posts from this blog

উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বাংলা গল্প : বিষয়ে বিশ্লেষণে

একক কিংবা যৌথ সম্পাদনায় বিগত কয়েক বছরে উত্তরপূর্বের বাংলা লেখালেখি বিষয়ক একাধিক গ্রন্থ সম্পাদনা করে এই সাহিত্যবিশ্বকে পাঠকের দরবারে পরিচিত করিয়ে দেওয়ার এক প্রচেষ্টা করে যাচ্ছেন নিবেদিতপ্রাণ তরুণ লেখক ও সম্পাদক নিত্যানন্দ দাস । হালে এপ্রিল ২০২৪ - এ প্রকাশিত হয়েছে তাঁর সম্পাদনা গ্রন্থ ‘ উত্তর - পূর্বাঞ্চলের বাংলা গল্প : বিষয়ে বিশ্লেষণে ’ ( প্রথম খণ্ড ) । প্রকাশক - একুশ শতক , কলকাতা । আলোচ্য গ্রন্থটিতে দুই ছত্রে মোট ২৮ জন বিশিষ্ট প্রাবন্ধিকের ২৮টি প্রবন্ধ রয়েছে । উপযুক্ত বিষয় ও আলোচকদের নির্বাচন বড় সহজ কথা নয় । এর জন্য প্রাথমিক শর্তই হচ্ছে নিজস্ব জ্ঞানার্জন । কালাবধি এই অঞ্চল থেকে প্রকাশিত উৎকৃষ্ট সাহিত্যকৃতির সম্বন্ধে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল না হলে তা সম্ভব নয় মোটেও । নিত্যানন্দ নিজেকে নিমগ্ন রেখেছেন গভীর অধ্যয়ন ও আত্মপ্রত্যয়কে সম্বল করে তা বলার অপেক্ষা রাখে না । আলোচ্য গ্রন্থের ভূমিকা লিখেছেন প্রতিষ্ঠিত কথাকার রণবীর পুরকায়স্থ । বস্তুত সাত পৃষ্ঠা জোড়া এই ভূমিকা এক পূর্ণাঙ্গ আলোচনা । ভূমিকা পাঠের পর আর আলাদা করে আলোচনার কিছু থাকে না । প্রতিটি নিবন্ধ নিয়ে পরিসরের অভাবে সংক্ষিপ্ত হলেও ...

শেকড়ের টানে নান্দনিক স্মরণিকা - ‘পরিযায়ী’

রামকৃষ্ণনগর । প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আবহে বরাক উপত্যকার এক ঐতিহ্যময় শহর । বিশেষ করে শিক্ষাদীক্ষার ক্ষেত্রে চিরদিনই এক অগ্রণী স্থান হিসেবে উচ্চারিত হয়ে আসছে এই নাম । বৃহত্তর রামকৃষ্ণনগরের গোড়াপত্তনের ইতিহাস বহুদিনের । দেশভাগের আগে ও পরে , উত্তাল সময়ে স্থানচ্যূত হয়ে এখানে থিতু হতে চাওয়া মানুষের অসীম ত্যাগ ও কষ্টের ফলস্বরূপ গড়ে ওঠে এক বিশাল বাসযোগ্য অঞ্চল । শুধু রুটি , কাপড় ও ঘরের স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রই নয় , এর বাইরে শিক্ষা অর্জনের ও শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে মমনশীলতার পরিচয় দিয়েছিলেন সেইসব মহামানবেরা । ফলস্বরূপ এক শিক্ষিত সমাজব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল যদিও উচ্চশিক্ষার জন্য পরবর্তী প্রজন্মকে বেরোতে হয়েছিল নিজ বাসস্থান ছেড়ে । শিলচর তখন এ অঞ্চলের প্রধান শহর হওয়ায় স্বভাবতই শিক্ষা ও উপার্জনের স্থান হিসেবে পরিগণিত হয় । এবং স্বভাবতই রামকৃষ্ণনগর ছেড়ে এক বৃহৎ অংশের মানুষ এসে পাকাপাকিভাবে থাকতে শুরু করেন এই শিলচরে । এই ধারা আজও চলছে সমানে । শিলচরে এসেও শেকড়ের টানে পরস্পরের সাথে যুক্ত থেকে রামকৃষ্ণনগর মূলের লোকজনেরা নিজেদের মধ্যে গড়ে তোলেন এক সৌহার্দমূলক বাতাবরণ । এবং সেই সূত্রেই ২০০০ সালে গঠিত হয় ‘ ...

প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'স্বপ্নতরী'

  স্বপ্নতরী                         বিদ্যুৎ চক্রবর্তী   গ্রন্থ বিপণী প্রকাশনা  বাবা - স্বর্গীয় সুধীর চন্দ্র চক্রবর্তী মা - শ্রীমতী বীণাপাণি চক্রবর্তী               জনম দিয়েছ মোরে এ ভব ধরায় গড়েছ সযতনে শিক্ষায় দীক্ষায় জীবনে কখনো কোথা পাইনি দ্বন্দ্ব দেখিনি হারাতে পূত - আদর্শ ছন্দ বিন্দু বিন্দু করি গড়ি পদ্য সংকলন তোমাদেরই চরণে করি সমর্পণ প্রথম ভাগ ( কবিতা )   স্বপ্নতরী ১ স্বপ্ন - তরী   নিটোল , নিষ্পাপ কচিপাতার মর্মর আর কাঁচা - রোদের আবোল - তাবোল পরিধিস্থ নতুন আমি ।   আনকোরা নতুন ঝরনাবারি নিয়ে এখন নদীর জলও নতুন বয়ে যায় , তাই শেওলা জমে না ।   দুঃখ আমার রয়ে গেছে এবার আসবে স্বপ্ন - তরী চেনা পথ , অচেনা ঠিকানা ।         ২ পাখমারা   সেই উথাল - পাথাল পাখশাট আজও আনে আরণ্যক অনুভূতি । একটু একটু হেঁটে গিয়ে বয়সের ফল্গুধারায় জগৎ নদীর দু ’ পার ছাড়ে দীর্ঘশ্বাস - সময়ের কাঠগড়াতে আমি বন...