Skip to main content

ধ্রুপদী বাংলা ও রবীন্দ্রনাথ

বাংলা তো তখনই ধ্রুপদির মর্যাদা পেয়েছিল যখন কবিগুরুর কলম থেকে বর্ষাবারির মতো কিংবা শরতের শিশিরের মতো টুপটাপ ঝরে পড়ছিল কবিতা কবিতা তো নয়, যেন গভীর জীবনবোধের নবতর উন্মোচন সরল অথচ গভীর, গুরুগম্ভীর সব কবিতা যেন বেদ, উপনিষদের অন্তর্নিহিত জীবনযাপনের মন্ত্র জীবনের এমনকী মরণেরও ওপারে নিবদ্ধ ছিল তাঁর অন্তর্দৃষ্টি। উৎকৃষ্টতার পরাকাষ্ঠায় কবিতায় গানে গোটা বিশ্বকে ধরে রেখেছেন ভাবীকালের জন্য। অন্যদের কথা বাদ দিলেও এই একজন কবির গদ্য ও বিশেষ করে কবিতার হাত ধরেই বাংলা ভাষা সেজে উঠেছিল নব আঙ্গিকে, বিচ্ছিন্নতার হাত থেকে এক মুক্তচিন্তাসমৃদ্ধ সহজতর ধারায়, নতুনতর চিন্তাজগৎকে প্রকাশ্য দিবালোকের মতো উদ্ভাসিত করেতাই তো তিনি কবিগুরু। চর্যাপদ থেকে রবীন্দ্রকাল অবধি উত্তরণের যে ধারা তার তীব্রতা হড়পা বানের মতো আছড়ে পড়েছিল সেদিন বাংলা ভাষা, সাহিত্যের বিশ্বব্যাপী আঙিনায় যেন প্রতিমায় প্রাণপ্রতিষ্ঠাই শুধু নয়, সারস্বত সাধনালব্ধ প্রয়াসে সেই প্রাণে সিঞ্চিত হয়েছিল উৎকর্ষবারি সেই ভাষাবন্ধন, সহজের কাছে নিগূঢ় তত্ত্বের সহজিয়া বিশ্লেষণ ও উপস্থাপন বাংলাকে করে গেছে মহিমান্বিত। এক জীবনে একটি জাতি, একটি ভাষাকে বিশ্বের দরবারে এক অনতিক্রম্য মর্যাদার আসনে বসিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ তিনি যেমন সেদিন থেকেই বিশ্বকবি তেমনি বাংলা সেদিন থেকেই ধ্রুপদি

ভাষার উৎকর্ষ মূলত সেই ভাষাভাষী মানুষের বিচারেই যথার্থ স্থানলাভ করে ভিন্ন ভাষাভাষী মানুষ অপর ভাষার উৎকর্ষ বিচারে সমর্থ হয় না যখন অবধি মূল ভাষাটির অনুবাদ না হয় অথচ অনুবাদে সেই ভাষা সাহিত্যের অন্তরে স্থাপিত ভাব বা বোধের তো সার্বিক অনুবাদ সম্ভব নয় যেদিন বাংলায় নোবেল এসেছিল রবীন্দ্রনাথের হাত ধরে সেদিন রবীন্দ্রনাথের পাশাপাশি বাংলা ভাষাও পেয়েছিল বিশ্বব্যাপী এক স্বীকৃতি যদিও নোবেল এসেছিল গীতাঞ্জলির ইংরেজি অনুবাদের মাধ্যমে তবু ভাব বা বোধ সহকারে কবিতায় যে সারসত্যটুকু নিহিত আছে তা উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন নোবেল কমিটি সহ বিশ্বসাহিত্যের একাধিক কবিকুল এর প্রধান কারণ হল এই যে কবিতা বা গানগুলির তরজমা করেছিলেন কবিগুরু স্বয়ং (অনুবাদকে তিনি তরজমা বলতেই পছন্দ করতেন)। মূলত ভাব ও বোধের যে অভাব থেকে যায় পরকৃত অনুবাদে তা আর থাকেনি স্বকৃত তরজমার জন্য এক্ষেত্রে একশোভাগ ভাব হয়তো বজায় থাকে না কিন্তু যতটা ভাব মূল কবির তরজমায় থাকার সম্ভাবনা ততটা ছিল বলেই গীতাঞ্জলি স্বীকৃত হয়েছে বৌদ্ধিক মহলে

গীতাঞ্জলির কবিতাসমূহ গভীর প্রভাবে আচ্ছন্ন করেছিল বিখ্যাত কবি ইয়েটস ও এজরা পাউন্ডকে কবি তথা চিত্রশিল্পী টমাস মূরেরও ভালো লেগেছিল কবিগুরুর কবিতা এবং তিনি সেসব পড়ার পর স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে সুপারিশ করেছিলেন নোবেল কমিটির কাছে রবীন্দ্রনাথের কবিতার নোবেল প্রাপ্তির প্রস্তাবে যে কজন সায় দিয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে ছিলেন সুইডিশ কবি ভারনার ভন হেইডেনস্টাম তিন বছর পর তিনি নিজেও ভূষিত হয়েছিলেন নোবেল পুরস্কারে সেদিন তিনি যে মন্তব্য করেছিলেন সেখানে তিনি বলেছিলেন - গীতাঞ্জলির কবিতাগুলোর ভেতর দিয়ে আমাদের সমকালিক শ্রেষ্ঠতম কবিদের মধ্যে একজনের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ এসেছে আমাদের সামনে কবিতাসমূহ পাঠে মনে হয় যেন সরল, স্বচ্ছ, অনাবিল ঝরনা ধারার জল পান করছি কবির অনুভবে যে তীব্র ঈশ্বরপ্রেম ও ধর্মানুভূতি পরিব্যাপ্ত হয়ে আছে এবং তাঁর রচনাশৈলীতে যে মহৎ ও নিঃস্বার্থ উৎকর্ষ লক্ষণীয় তা গভীর ও দুর্লভ আধ্যাত্মিক সৌন্দর্যের একটি ধারণা তৈরি করে রবীন্দ্রনাথের কবিতা তাঁর নিজস্ব ভাষায় শুধুমাত্র তাঁরই কবিতা - শৈলীতে, স্বভাবে স্বাভাবিকভাবেই নোবেল ঘোষণাপত্রেও রয়েছে রবীন্দ্রনাথের কবিতায় শিল্পগুণের প্রসঙ্গ 

এহেন স্বীকৃতি যা এসেছিল আজ থেকে শতবর্ষেরও অধিক কাল আগে সেদিনই ধ্রুপদি ভাষার মর্যাদায় বিশ্বে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বাংলা ভাষা যে ভাষায় একমাত্র নোবেল এসেছে ভারতবর্ষে সেই ভাষাকে স্বীকৃতি দেওয়া উচিৎ ছিল বহু আগেই সরকারি স্বীকৃতিই একজন গুণসম্পন্ন ব্যক্তি বা একটি বস্তুর শেষ কথা নয়। তবু দেরিতে হলেও এই স্বীকৃতি যে সরকারিভাবে পাওয়া গেল সেই বা কম কীসে ? এর ফলাফল বিচার এই নিবন্ধের বিচার্য বিষয় নয় ভাষা চর্চা কিংবা সাহিত্যসৃষ্টি চলে আসছে কালাবধি যদিও বৃহত্তর আঙ্গিকে এর উৎকর্ষ সাধন রবীন্দ্রোত্তর বাংলায় কতটুকু সম্ভব তা সন্দেহাতীত বাংলা ভাষা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথই শেষ কথা এর বাইরে চিন্তার আর কোনও স্থান নেই বললেও অত্যুক্তি হয় না রবীন্দ্রনাথই একমেবাদ্বিতীয়ম মাইলস্টোন  

এবার, এই ধ্রুপদি বিষয়ক সরকারি স্বীকৃতিলাভের পর অন্ততবাংলাটা ঠিক আসে নার মতো উন্নাসিকতা বন্ধ হওয়া উচিত পাশাপাশি মাতৃভাষা চর্চার অধিকার এবং সুযোগও পর্যাপ্ত পরিমাণে উপলব্ধ হওয়ার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে তবে তা তখনই সম্ভব যখন বাঙালির অন্তরাত্মায় বাংলা ঠিক সেভাবেই জায়গা করে নিতে পারে যতটা দক্ষিণী ভাষাসমূহের ক্ষেত্রে ঘটে আসছে। এক্ষেত্রে আমাদের সহোদরসম অসমিয়া ভাষাভাষী মানুষের সত্তায় যে ভাষাপ্রেম তা এক প্রকৃষ্ট উদাহরণ হিসেবে উঠে আসতে পারে। অস্তিত্ব রক্ষার খাতিরে পৃথিবীতে ভাষাসৈনিকদের ভাষাশহিদ হওয়ার উদাহরণ যদিও বাংলাভাষীদেরই তবু ভাষাপ্রেম হয়তো ততটুকু নেই যতটুকু থাকা উচিৎ অস্তিত্ব বিপন্ন হওয়ার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার আগ পর্যন্ত। সবার ভাষাকে উপযুক্ত মর্যাদা দিয়ে নিজ ভাষাকে মাতৃসম মমতায় লালনের দায়ভার তুলে নিতে হবে সবাইকে। তবেই হয়তো বাংলা মা হয়ে উঠবে প্রকৃতার্থে ধ্রুপদি।  

এবার অন্তত বাংলা ভাষায় সাহিত্যচর্চা করার মধ্যে যে গৌরব লুকিয়ে রয়েছে তা বাঙালি মাত্রেরই উপলব্ধিতে আসা উচিত প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা এক আর ভাষা সাহিত্যের চর্চা ও চাষাবাদ অন্য এ এক নির্মম সত্য স্নাতকোত্তর পর্ব সমাধা করার পরেও যাঁরা শিক্ষাদানে এবং শিক্ষা সম্পর্কিত কাজে নিজেদের জড়িত করে রেখেছেন তাঁদের অন্তরে যদি এই ধ্রুপদি মাতৃভাষাতে কিছু শিল্প সৃষ্টির তাগিদ অনুভূত হয় তাহলে আখেরে ঋদ্ধ হবে আমাদের ভাষাজননী এই ভাষার অমৃতময় শব্দোচ্চারণে ঋদ্ধ হবে ভাবীকালের যাপনবেলা যেমন লিখেছিলেন কবিগুরু তেমনি হয়তো তারাও বলবে - ‘মা তোর মুখের বাণী আমার কানে লাগে সুধার মতো, মরি হায় হায় রে

বিদ্যুৎ চক্রবর্তী

Comments

  1. খুব ভাললাগে যখন কবিকে দেখি গদ্যের সভায় ঠিক কবিরই মতো উৎকৃষ্ট জাতীয় প্ৰবন্ধ লিখতে।
    খুবই উপভোগ্য এই প্ৰবন্ধ পাঠ।
    অশেষ অশেষ

    ReplyDelete

Post a Comment

Popular posts from this blog

শেকড়ের টানে নান্দনিক স্মরণিকা - ‘পরিযায়ী’

রামকৃষ্ণনগর । প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আবহে বরাক উপত্যকার এক ঐতিহ্যময় শহর । বিশেষ করে শিক্ষাদীক্ষার ক্ষেত্রে চিরদিনই এক অগ্রণী স্থান হিসেবে উচ্চারিত হয়ে আসছে এই নাম । বৃহত্তর রামকৃষ্ণনগরের গোড়াপত্তনের ইতিহাস বহুদিনের । দেশভাগের আগে ও পরে , উত্তাল সময়ে স্থানচ্যূত হয়ে এখানে থিতু হতে চাওয়া মানুষের অসীম ত্যাগ ও কষ্টের ফলস্বরূপ গড়ে ওঠে এক বিশাল বাসযোগ্য অঞ্চল । শুধু রুটি , কাপড় ও ঘরের স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রই নয় , এর বাইরে শিক্ষা অর্জনের ও শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে মমনশীলতার পরিচয় দিয়েছিলেন সেইসব মহামানবেরা । ফলস্বরূপ এক শিক্ষিত সমাজব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল যদিও উচ্চশিক্ষার জন্য পরবর্তী প্রজন্মকে বেরোতে হয়েছিল নিজ বাসস্থান ছেড়ে । শিলচর তখন এ অঞ্চলের প্রধান শহর হওয়ায় স্বভাবতই শিক্ষা ও উপার্জনের স্থান হিসেবে পরিগণিত হয় । এবং স্বভাবতই রামকৃষ্ণনগর ছেড়ে এক বৃহৎ অংশের মানুষ এসে পাকাপাকিভাবে থাকতে শুরু করেন এই শিলচরে । এই ধারা আজও চলছে সমানে । শিলচরে এসেও শেকড়ের টানে পরস্পরের সাথে যুক্ত থেকে রামকৃষ্ণনগর মূলের লোকজনেরা নিজেদের মধ্যে গড়ে তোলেন এক সৌহার্দমূলক বাতাবরণ । এবং সেই সূত্রেই ২০০০ সালে গঠিত হয় ‘ ...

কবির মজলিশ-গাথা

তুষারকান্তি সাহা   জন্ম ১৯৫৭ সাল৷ বাবা প্ৰয়াত নিৰ্মলকান্তি সাহা ও মা অমলা সাহার দ্বিতীয় সন্তান   তুষারকান্তির ৮ বছর বয়সে ছড়া রচনার মাধ্যমে সাহিত্য ভুবনে প্ৰবেশ৷ ‘ ছায়াতরু ’ সাহিত্য পত্ৰিকায় সম্পাদনার হাতেখড়ি হয় কলেজ জীবনে অধ্যয়নকালীন সময়েই৷ পরবৰ্তী জীবনে শিক্ষকতা থেকে সাংবাদিকতা ও লেখালেখিকেই পেশা হিসেবে গ্ৰহণ করেন৷ প্ৰথম ছড়া প্ৰকাশ পায় সাতের দশকে ‘ শুকতারা ’ য়৷ এরপর ‘ দৈনিক যুগশঙ্খ ’ পত্ৰিকার ‘ সবুজের আসর ’, দৈনিক সময়প্ৰবাহ ও অন্যান্য একাধিক কাগজে চলতে থাকে লেখালেখি৷ নিম্ন অসমের সাপটগ্ৰামে জন্ম হলেও বৰ্তমানে গুয়াহাটির স্থায়ী বাসিন্দা তুষারকান্তির এ যাবৎ প্ৰকাশিত গ্ৰন্থের সংখ্যা ছয়টি৷ এগুলো হচ্ছে নগ্ননিৰ্জন পৃথিবী (দ্বৈত কাব্যগ্ৰন্থ) , ভবঘুরের অ্যালবাম (ব্যক্তিগত গদ্য) , একদা বেত্ৰবতীর তীরে (কাব্যগ্ৰন্থ) , প্ৰেমের গদ্যপদ্য (গল্প সংকলন) , জীবনের আশেপাশে (উপন্যাস) এবং শিশু-কিশোরদের জন্য গল্প সংকলন ‘ গাবুদার কীৰ্তি ’ ৷ এছাড়াও বিভিন্ন পত্ৰপত্ৰিকায় প্ৰকাশিত হয়েছে শিশু কিশোরদের উপযোগী অসংখ্য অগ্ৰন্থিত গল্প৷ রবীন্দ্ৰনাথের বিখ্যাত ছড়া , কবিতা ও একাধিক ছোটগল্প অবলম্বনে লিখেছেন ...

শুদ্ধ বানানচর্চার প্রয়োজনীয়তা ও সচেতনতা

উত্তরপূর্বের বাংলা সাহিত্যচর্চার পরিসরকে কেউ কেউ অভিহিত করেন তৃতীয় ভুবন বলে , কেউ আবার বলেন ঈশান বাংলা । অনেকেই আবার এই জাতীয় ভুবনায়নকে তীব্র কটাক্ষ করে বলেন - সাহিত্যের কোনও ভুবন হয় না । সাহিত্যকে ভৌগোলিক গণ্ডির মধ্যে আটকে রাখা যায় না । কারও ব্যক্তিগত অভিমতের পক্ষে বা বিপক্ষে বলার কিছুই থাকতে পারে না । যে যেমন ভাবতে বা বলতেই পারেন । কিন্তু প্রকৃত অবস্থাটি অনুধাবন করতে গেলে দেখা যায় বাংলার এই যে অখণ্ড বিশ্বভুবন সেখানে কিন্তু কয়েকটি স্পষ্ট বিভাজন রয়েছে । আঞ্চলিক ভাষায় বাংলা সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রটি ধর্তব্যের মধ্যে না আনলেও মান্য বাংলা চর্চার ক্ষেত্রে আমরা প্রথমেই দেখব যে বাংলাদেশের বাংলা ও পশ্চিমবঙ্গের বাংলার মধ্যে শব্দরূপ তথা গৃহীত বানানের ক্ষেত্রেও বহু তারতম্য রয়েছে । সংলাপ বা প্রেক্ষাপট অনুযায়ী মান্য বাংলারও ভিন্ন ভিন্ন রূপের প্রয়োগ দেখতে পাওয়া যায় । যেমন পানি / জল , গোসল / স্নান , নাস্তা / প্রাত : রাশ ইত্যাদি । সেসবের উৎস সন্ধানে না গিয়ে শুধু এটাই বলার যে বাংলা সাহিত্য চর্চার ক্ষেত্রে আঞ্চলিকতা এক অমোঘ পর্যায় । বিহার / ঝাড়খণ্ডের বাংলা আর নিউইয়র্কের বাংলা এক হলেও সাহিত্যে তা...