Skip to main content

অকপট ভাবনার কাব্যগ্রন্থ ‘শান্তি-নীড়’


সুন্দর-অসুন্দর আর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অণু পরমাণু নিয়েই তো সৃষ্ট এ জগৎ সংসার। সংসারে বৃহতের সৃষ্টিই হয় ক্ষুদ্রের সমন্বয়ে। তাই বৃহতের জয়গাথা শুধু নয় - ক্ষুদ্রের আরাধনাতে, ক্ষুদ্রের উল্লেখেই প্রকাশিত হয় প্রকৃত মূল্যায়ন। এই ভাবধারার অনুসারী হয়ে, এই গভীর বাস্তবের উচ্চারণেই ‘কণিকা’ কাব্যগ্রন্থে কবিগুরু লিখেছেন -
কে লইবে মোর কার্য, কহে সন্ধ্যারবি।
শুনিয়া জগৎ রহে নিরুত্তর ছবি।
মাটির প্রদীপ ছিল, সে কহিল, স্বামী,
আমার যেটুকু সাধ্য করিব তা আমি। (কর্তব্যগ্রহণ)।

সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে কবি মহেন্দ্র চন্দ্র দাসের কাব্যগ্রন্থ ‘শান্তি-নীড়’। পেপারব্যাকে নান্দনিক ও প্রাসঙ্গিক প্রচ্ছদযুক্ত ১০০ পৃষ্ঠার গ্রন্থটিতে রয়েছে মোট ৬৭টি কবিতা। স্বভাবতই ক্ষুদ্র নয় এ গ্রন্থের পরিসর। তবু আলোচনার সূত্রপাতে ‘ক্ষুদ্র’ বিষয়ের উল্লেখের মূল কারণ হচ্ছে বৃহতের প্রতি আমাদের স্বভাবজাত আকর্ষণ। সাড়া জাগানো না হলে, বিশিষ্টতার ছাপ গায়ে লাগানো না থাকলে বস্তুর প্রতি আমাদের অনীহা চিরকালীন। ‘শান্তি-নীড়’ কাব্যগ্রন্থ বিশিষ্টতায় নয় - আবেগে, সারল্যে, দৃঢ় সংকল্পে, ভাবে, নিবেদনে গ্রন্থিত এক অপেক্ষাকৃত স্বল্পখ্যাত অথচ বিশিষ্ট দ্বিভাষিক কবির কাব্য সংকলন।
কবিতার মান, তার আধুনিকতার বৈশিষ্ট্য, কাব্যময়তা - সবকিছুকে ছাপিয়ে গেছে কবির সহজ সরল বয়ানসর্বস্বতা। জীবনের এক নির্মোহ চিত্র এঁকেছেন কবি গভীর সারল্য ও অকপট ভাববোধের যুগলবন্দিতে। তাঁর কবিতা নিয়ে বিশিষ্ট সাহিত্যিক তথা গবেষক অমলেন্দু ভট্টাচার্য তাঁর আলোচনায় তাই যথার্থ লিখেছেন - ‘...প্রতিটি রচনার মূলে থাকে বিশেষ একটি ভাব। শ্রী মহেশ চন্দ্র দাস-এর রচনাকর্মের অভ্যন্তরে রয়েছে সমাজের হিতকামনা। সমাজ-সংস্কার-সভ্যতা বিষয়ে ইতিবাচক ভাবনা এবং সহজ সরল প্রকাশভঙ্গি তাঁর রচনার বড় গুণ। সারল্যই সংকলিত রচনাগুলির প্রধান বৈশিষ্ট্য।’ শুভেচ্ছাবাণীতে শ্রীভূমির ‘করিমগঞ্জ কলেজ’-এর অবসরপ্রাপ্ত উপাধ্যক্ষ শ্রী জ্যোতিপ্রকাশ দাস লিখছেন - ‘...মহেশ চন্দ্র দাসের কবিতাগুলি তাঁর হৃদয় থেকে উৎসারিত। ...কবিতাগুলি হৃদয়গ্রাহী ও আনন্দদায়ী...।’
এই সারল্য আর সহজ ভাবনার প্রকাশেই জীবনের অর্জিত অনুভবকে সম্বল করে কবি লিখেন -
‘শুধু মনে হয় দাঁড়িয়ে আছি সময়ের দ্বারে
সময় দিয়েছে ঠেলে এক রুদ্ধ কারাগারে।
জীবন নাটকের রঙ্গমঞ্চে শুধু আসা আর যাওয়া,
মনে পড়ে কিছু সংলাপ
কখনো তা মনে হয় করুণ বিলাপ
জিঘাংসার তীক্ষ্ণ প্রহার
নিষ্পাপ নিপীড়িতের কত হাহাকার
মূক আত্মগ্লানি নিয়ে
ক্ষীণ দীপশিখার মতো,
শুধু বেঁচে আছি কালের অতলে...।’
(কবিতা - সময়)।

গ্রন্থের প্রাককথনে কবি এই সত্য উপলব্ধি, এই সরল উচ্চারণেই তাই লিখেছেন - ‘যা কিছু আপন উপলব্ধিতে আসে, নিজের সংবেদনশীল ভাবনার জগতের প্রতিক্রিয়াগুলিকে সাধারণ ভাষায় প্রকাশ করার চেষ্টা করেছি মাত্র... কোনোদিন ভাবিনি যে এই কবিতাকে দুই মলাটের ভিতরে বন্দি করে প্রকাশ করব। এই শেষ বয়সে এসে সেই পুরোনো দিনের অনুভূতিগুলোকে সকলের সাথে ভাগ করার ভাবনায় এই ক্ষুদ্র প্রয়াসটুকু...।’
এই ক্ষুদ্রের মধ্যেই নিহিত থাকে ভবিষ্যতের বিশিষ্টতার আভাস। যে কোনো কবির প্রথমদিককার কবিতায় যে জড়তা থাকে ক্রমে তা কেটে গিয়েই সৃষ্টি হয় উৎকৃষ্ট কবিতা। এ অনস্বীকার্য। আলোচ্য কবির কবিতাও সেই মাইলফলক প্রাপ্তির এক পদক্ষেপ যাকে কিছুতেই পরিহার করা যায় না, দূরে সরিয়ে রাখা যায় না।
এক গভীর জীবনবোধের প্রকাশ আলোচ্য গ্রন্থের সবকটি কবিতা। গ্রন্থের ছাপা, বাঁধাই যথাযথ। বর্ণ সংস্থাপন, অক্ষরবিন্যাসে ত্রুটি রয়েছে। বানানের শুদ্ধতা স্বভাবতই অপ্রত্যাশিত। অজন্তা দাসের প্রচ্ছদ গ্রন্থটিকে প্রদান করেছে এক অনন্য মর্যাদা। বাংলা ও বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি উভয় ভাষায় সাবলীল কবি মহেন্দ্র চন্দ্র দাসের গ্রন্থটি তাই অবিসম্বাদিতভাবেই উঠে আসে আলোচনার পরিসরে।
বিদ্যুৎ চক্রবর্তী
প্রকাশক - নন্দা দাস, ‘দয়িতা’।
মূল্য - ২০০ টাকা।

Comments

Popular posts from this blog

শেকড়ের টানে নান্দনিক স্মরণিকা - ‘পরিযায়ী’

রামকৃষ্ণনগর । প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আবহে বরাক উপত্যকার এক ঐতিহ্যময় শহর । বিশেষ করে শিক্ষাদীক্ষার ক্ষেত্রে চিরদিনই এক অগ্রণী স্থান হিসেবে উচ্চারিত হয়ে আসছে এই নাম । বৃহত্তর রামকৃষ্ণনগরের গোড়াপত্তনের ইতিহাস বহুদিনের । দেশভাগের আগে ও পরে , উত্তাল সময়ে স্থানচ্যূত হয়ে এখানে থিতু হতে চাওয়া মানুষের অসীম ত্যাগ ও কষ্টের ফলস্বরূপ গড়ে ওঠে এক বিশাল বাসযোগ্য অঞ্চল । শুধু রুটি , কাপড় ও ঘরের স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রই নয় , এর বাইরে শিক্ষা অর্জনের ও শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে মমনশীলতার পরিচয় দিয়েছিলেন সেইসব মহামানবেরা । ফলস্বরূপ এক শিক্ষিত সমাজব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল যদিও উচ্চশিক্ষার জন্য পরবর্তী প্রজন্মকে বেরোতে হয়েছিল নিজ বাসস্থান ছেড়ে । শিলচর তখন এ অঞ্চলের প্রধান শহর হওয়ায় স্বভাবতই শিক্ষা ও উপার্জনের স্থান হিসেবে পরিগণিত হয় । এবং স্বভাবতই রামকৃষ্ণনগর ছেড়ে এক বৃহৎ অংশের মানুষ এসে পাকাপাকিভাবে থাকতে শুরু করেন এই শিলচরে । এই ধারা আজও চলছে সমানে । শিলচরে এসেও শেকড়ের টানে পরস্পরের সাথে যুক্ত থেকে রামকৃষ্ণনগর মূলের লোকজনেরা নিজেদের মধ্যে গড়ে তোলেন এক সৌহার্দমূলক বাতাবরণ । এবং সেই সূত্রেই ২০০০ সালে গঠিত হয় ‘ ...

কবির মজলিশ-গাথা

তুষারকান্তি সাহা   জন্ম ১৯৫৭ সাল৷ বাবা প্ৰয়াত নিৰ্মলকান্তি সাহা ও মা অমলা সাহার দ্বিতীয় সন্তান   তুষারকান্তির ৮ বছর বয়সে ছড়া রচনার মাধ্যমে সাহিত্য ভুবনে প্ৰবেশ৷ ‘ ছায়াতরু ’ সাহিত্য পত্ৰিকায় সম্পাদনার হাতেখড়ি হয় কলেজ জীবনে অধ্যয়নকালীন সময়েই৷ পরবৰ্তী জীবনে শিক্ষকতা থেকে সাংবাদিকতা ও লেখালেখিকেই পেশা হিসেবে গ্ৰহণ করেন৷ প্ৰথম ছড়া প্ৰকাশ পায় সাতের দশকে ‘ শুকতারা ’ য়৷ এরপর ‘ দৈনিক যুগশঙ্খ ’ পত্ৰিকার ‘ সবুজের আসর ’, দৈনিক সময়প্ৰবাহ ও অন্যান্য একাধিক কাগজে চলতে থাকে লেখালেখি৷ নিম্ন অসমের সাপটগ্ৰামে জন্ম হলেও বৰ্তমানে গুয়াহাটির স্থায়ী বাসিন্দা তুষারকান্তির এ যাবৎ প্ৰকাশিত গ্ৰন্থের সংখ্যা ছয়টি৷ এগুলো হচ্ছে নগ্ননিৰ্জন পৃথিবী (দ্বৈত কাব্যগ্ৰন্থ) , ভবঘুরের অ্যালবাম (ব্যক্তিগত গদ্য) , একদা বেত্ৰবতীর তীরে (কাব্যগ্ৰন্থ) , প্ৰেমের গদ্যপদ্য (গল্প সংকলন) , জীবনের আশেপাশে (উপন্যাস) এবং শিশু-কিশোরদের জন্য গল্প সংকলন ‘ গাবুদার কীৰ্তি ’ ৷ এছাড়াও বিভিন্ন পত্ৰপত্ৰিকায় প্ৰকাশিত হয়েছে শিশু কিশোরদের উপযোগী অসংখ্য অগ্ৰন্থিত গল্প৷ রবীন্দ্ৰনাথের বিখ্যাত ছড়া , কবিতা ও একাধিক ছোটগল্প অবলম্বনে লিখেছেন ...

শুদ্ধ বানানচর্চার প্রয়োজনীয়তা ও সচেতনতা

উত্তরপূর্বের বাংলা সাহিত্যচর্চার পরিসরকে কেউ কেউ অভিহিত করেন তৃতীয় ভুবন বলে , কেউ আবার বলেন ঈশান বাংলা । অনেকেই আবার এই জাতীয় ভুবনায়নকে তীব্র কটাক্ষ করে বলেন - সাহিত্যের কোনও ভুবন হয় না । সাহিত্যকে ভৌগোলিক গণ্ডির মধ্যে আটকে রাখা যায় না । কারও ব্যক্তিগত অভিমতের পক্ষে বা বিপক্ষে বলার কিছুই থাকতে পারে না । যে যেমন ভাবতে বা বলতেই পারেন । কিন্তু প্রকৃত অবস্থাটি অনুধাবন করতে গেলে দেখা যায় বাংলার এই যে অখণ্ড বিশ্বভুবন সেখানে কিন্তু কয়েকটি স্পষ্ট বিভাজন রয়েছে । আঞ্চলিক ভাষায় বাংলা সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রটি ধর্তব্যের মধ্যে না আনলেও মান্য বাংলা চর্চার ক্ষেত্রে আমরা প্রথমেই দেখব যে বাংলাদেশের বাংলা ও পশ্চিমবঙ্গের বাংলার মধ্যে শব্দরূপ তথা গৃহীত বানানের ক্ষেত্রেও বহু তারতম্য রয়েছে । সংলাপ বা প্রেক্ষাপট অনুযায়ী মান্য বাংলারও ভিন্ন ভিন্ন রূপের প্রয়োগ দেখতে পাওয়া যায় । যেমন পানি / জল , গোসল / স্নান , নাস্তা / প্রাত : রাশ ইত্যাদি । সেসবের উৎস সন্ধানে না গিয়ে শুধু এটাই বলার যে বাংলা সাহিত্য চর্চার ক্ষেত্রে আঞ্চলিকতা এক অমোঘ পর্যায় । বিহার / ঝাড়খণ্ডের বাংলা আর নিউইয়র্কের বাংলা এক হলেও সাহিত্যে তা...