Skip to main content

বৃহৎ বাংলার সার্থক ছোটগল্পের সংকলন ‘অগ্নিশুদ্ধা’


বলা যেতেই পারে একটি ব্যতিক্রমী গল্প সংকলন প্রকাশিত হল বরাক উপত্যকা তথা উত্তরপূর্বের গল্পবিশ্ব থেকে কেন ব্যতিক্রমী সেই প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে চোখ রাখা যাক গ্রন্থের সাজসজ্জার দিকেএক এক করে এগোলে প্রথমেই আসে প্রচ্ছদের কথাঅ্যাবস্ট্র্যাক্ট প্রচ্ছদ অপেক্ষাকৃত কম চোখে পড়ে অঞ্চলের প্রকাশনায় সম্প্রতি শীতালং পাবলিকেশন থেকে প্রকাশিত সবকটি গ্রন্থে আশু চৌধুরীর এ ধরনের প্রচ্ছদ গ্রন্থকে প্রদান করছে এক অনন্য মর্যাদা শর্মিলী দেব কানুনগোর আলোচ্য গ্রন্থ ‘অগ্নিশুদ্ধা’র ক্ষেত্রেও ঘটেনি ব্যত্যয় খালি থাকেনি ব্লার্বগুলোও নিয়মমাফিক প্রথম ব্লার্বে রয়েছে গ্রন্থ বিষয়ক কিছু বর্ণনা - নান্দনিক ভাষায় সমৃদ্ধ গল্পসমূহের ভিতর থেকে উঠে আসা অনুভবের কথা, গল্পের প্যাটার্ন তবে ব্লার্বে তো আর সবটুকু বলে দেওয়া যায় না তাই বহুর পরেও রয়ে গেছে আরও অনেক কথা দ্বিতীয় ব্লার্বে যথারীতি রয়েছে গল্পকারের সম্যক সচিত্র পরিচিতি শেষ পৃষ্ঠায় শর্মিলীর গল্পের গতি প্রকৃতি নিয়ে বিশিষ্ট কবি চন্দ্রিমা দত্তের মূল্যায়ন অর্থাৎ সব মিলিয়ে ষোলো আনা ব্যাকরণ মেনে প্রকাশিত হল এই গল্প সংকলনলেখকের কথাশিরোনামে ভূমিকায় গল্পকার লিখছেন - ‘…জীবনের রূঢ় বাস্তবের চেহারা যারা খুব কাছে থেকে দেখে তাদের মধ্যে অনেকের বাঁচার উপায় হিসেবে কলমকে অবলম্বন করা ছাড়া আর অন্য উপায় থাকে না এই সুন্দর পৃথিবীতে আরেকটা নির্মম, নিষ্ঠুর, স্বার্থপর পৃথিবী লুকোনো আছে আপাত সহজ সম্পর্কগুলোর আড়ালে স্বার্থপরতা মুখ লুকিয়ে থাকে কাছের মানুষরা হঠাৎ করে বদলে যেতেই পারে এসব অবশ্য সবার ভাগ্যে জোটে নাজীবনের ভিতরে লুকিয়ে থাকা এক অন্য জীবনকে তুলে আনার চেষ্টা করেছিলাম আমার কলমে যা দেখতে চাই না আমরা - দেখব না বলে যা থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকি - তাই সঙ্গোপনে তুলে আনতাম নিজস্ব খাতার পাতায় পাতায় সেইসব গভীর গোপন সত্যকে মনের মাধুরী মিশিয়ে ধরে রাখার চেষ্টা করেছি আমার লেখা গল্পে’  
৮৮ পৃষ্ঠার গ্রন্থের ৮০ পৃষ্ঠা জুড়ে রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন দৈর্ঘের মোট কুড়িটি গল্প ইতিপূর্বে বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় সেসব প্রকাশিত, যার উল্লেখ রয়েছে গল্পের শেষে বস্তুত ভূমিকায় উপর্যুক্ত বয়ানেই গল্পকার তাঁর গল্পের এবং গ্রন্থেরও নির্যাসটুকু নিখাদ তুলে ধরেছেন পাঠকের জন্য প্রতিটি গল্পের মধ্যেই এক অন্য পৃথিবী, এক ভিন্ন ভাবনার উপস্থিতি যা নিত্যদিনের যাপনে ধরা দেয় না আমাদের কিংবা পাঠকের মননে আপাত সুখ কিংবা দুঃখজনক অনুভূতির ভেতরে যে লুকিয়ে থাকে এক বিপ্রতীপ ভাবনার আকর সে আর কজনের চোখের সামনে ধরা দেয় এসে ? এই দুরূহ কাজটিকেই সাবলীল মুনশিয়ানায় উপস্থাপন করেছেন গল্পকার তার প্রতিটি গল্পে কবি চন্দ্রিমা দত্ত তাই লিখেছেন - ‘শর্মিলী জীবনসত্যকে লেখার উপাদান হিসেবে নেন বলেই আমরা সহজতার স্রোতধ্বনি শুনি, গল্পের জীবনের সাথে একাত্মবোধ করি, গল্পের চরিত্রেরা আমাদের কাছে খুব সাবলীল হয়ে ধরা দেয় বলেই মনে হয় - আমি তো তাকে চিনি, আমার মনে হয় - গল্পের সাথে একাত্মবোধ হলেই সে গল্প সার্থক হয়ে ওঠে গল্পে শর্মিলীর নারী চরিত্রদের উচ্চকিত কণ্ঠ নয়, বরং সমুদ্রের প্রত্যয়ের, দৃঢ়তার উচ্চারণ শুনতে পাই আমরা তাঁর গল্পের নারীরা খুব দৃষ্টি আকর্ষণ করে কারণ তাদের খুব মার্জিত ভাবে স্বাধীনতার যথার্থ অর্জন আমাদের চোখে পড়ে
মূলত আমাদের খুব কাছের চেনা জগতের প্রতিটি পরিবারের নারীদের জীবনযাপনের যে বৈচিত্র তাকেই গ্রন্থের মূল উপজীব্য হিসেবে লেখা হয়েছে গল্পগুলো কিন্তু চোখের দেখার বাইরে নারী জীবনের অন্দরে যে অনুভূতির কোন্দল সে তো কারো বোধগম্যতা কিংবা অনুভবে আসে না সেই জায়গাটিতেই পাখির চোখ করে গল্পকার ছেকে এনেছেন নারী মননের অন্দরের কথা, অন্তর্কথা প্রথম গল্প ‘পরাজিত’তেই কুঠারাঘাত করেছেন লুক্কায়িত পুরুষতন্ত্রের উপর। একে একে গল্পে গল্পে ব্যতিক্রমী আঙ্গিকে উপস্থাপিত করেছেন নারী পুরুষের অন্য আরেক রূপ - ভেতর ও বাইরের, চোখের দেখার ও অদেখা স্বভাবের কথা
এখানে আলাদা করে গল্পগুলোর কথা বলার দরকার পড়ে না তবু ছুঁয়ে যেতে হয় গল্পেরই আবাহনে অধিকাংশ গল্পের নির্যাস একই ভাবনার অনুসারী অথচ প্রেক্ষাপট ও বিষয়ধারার বৈচিত্রে, লিখনশৈলী, সাহিত্যগুণ তথা ভাষার নান্দনিক ও শালীন ব্যবহারে একের থেকে অনবদ্য হয়ে উঠেছে আরেক অনন্য এবং ব্যতিক্রমী কিছু অনুষঙ্গ এসেছে বহু গল্পে গল্পের বিষয়সমূহও তেমনি এমন বিষয়ও যে একটি গল্পের প্লট হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে তা সচরাচর অকল্পনীয় বলের মনে হতে পারে উদাহরণ - শব্দ, সুতনুকার তিল, বদল, ভুলে যাওয়ার পরে, জীবন বদলে যাওয়া ইত্যাদি গ্রন্থনামের গল্পটি এক কথায় অনবদ্য গল্পটির শিরোনামদ্বিখণ্ডিত নারীও হতে পারত বকুলগন্ধঅসাধারণ একটি ককটেল গল্প বলা যায় দুই বা তিনটি গল্পকে নিপুণ শৈলীতে একাকার করে দিয়েছেন গল্পকার এই উন্নত মানের ভাষা ও লিখনশৈলীর জন্যই বহুদিন পর একটি গল্পগ্রন্থ প্রকাশিত হল বলে আলোচনার প্রথমেই উল্লেখ করা হয়েছে উপত্যকার কিংবা এই আঞ্চলিকতার ঊর্ধ্বে উঠে ভাব ভাষা সংলাপ বুনোটের সৌকর্যে অভীপ্সা’, ‘জলছবি’, ‘শ্রাবণ সঙ্গ সুধায়’, ‘উপলবাবুর স্বপ্ন’, ‘ছায়াসুখইত্যাদি গল্পের সমন্বয়ে গ্রন্থটি হয়ে উঠেছে বৃহৎ বাংলার সম্পদ
উন্নত মানের কাগজ, বাঁধাই, বর্ণ সংস্থাপন, ছাপার পাশাপাশি বানানের শুদ্ধতাও উল্লেখনীয় যদিও কিছু গল্পে তা ব্যাহত হয়েছেকিকী’-এর জটিলতা পরিলক্ষিত হয়েছে কয়েকটি জায়গায় সূচিপত্রের বিন্যাসেও একটি ত্রুটি বিদ্যমান এসব হয়তো পরবর্তী সংস্করণে কাটিয়ে ওঠা যাবে গল্পকার এই গ্রন্থটি উৎসর্গ করেছেন তাঁরআত্মজ ও আত্মজাকে সব মিলিয়ে একটি সার্থক গল্প সংকলন - ‘অগ্নিশুদ্ধা

বিদ্যুৎ চক্রবর্তী

প্রকাশক - শীতালং পাবলিকেশন, শিলচর
মূল্য - ২৫০ টাকা
যোগাযোগ - ৮১৩৪০৯২৯৪৭ 

Comments

Popular posts from this blog

শেকড়ের টানে নান্দনিক স্মরণিকা - ‘পরিযায়ী’

রামকৃষ্ণনগর । প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আবহে বরাক উপত্যকার এক ঐতিহ্যময় শহর । বিশেষ করে শিক্ষাদীক্ষার ক্ষেত্রে চিরদিনই এক অগ্রণী স্থান হিসেবে উচ্চারিত হয়ে আসছে এই নাম । বৃহত্তর রামকৃষ্ণনগরের গোড়াপত্তনের ইতিহাস বহুদিনের । দেশভাগের আগে ও পরে , উত্তাল সময়ে স্থানচ্যূত হয়ে এখানে থিতু হতে চাওয়া মানুষের অসীম ত্যাগ ও কষ্টের ফলস্বরূপ গড়ে ওঠে এক বিশাল বাসযোগ্য অঞ্চল । শুধু রুটি , কাপড় ও ঘরের স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রই নয় , এর বাইরে শিক্ষা অর্জনের ও শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে মমনশীলতার পরিচয় দিয়েছিলেন সেইসব মহামানবেরা । ফলস্বরূপ এক শিক্ষিত সমাজব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল যদিও উচ্চশিক্ষার জন্য পরবর্তী প্রজন্মকে বেরোতে হয়েছিল নিজ বাসস্থান ছেড়ে । শিলচর তখন এ অঞ্চলের প্রধান শহর হওয়ায় স্বভাবতই শিক্ষা ও উপার্জনের স্থান হিসেবে পরিগণিত হয় । এবং স্বভাবতই রামকৃষ্ণনগর ছেড়ে এক বৃহৎ অংশের মানুষ এসে পাকাপাকিভাবে থাকতে শুরু করেন এই শিলচরে । এই ধারা আজও চলছে সমানে । শিলচরে এসেও শেকড়ের টানে পরস্পরের সাথে যুক্ত থেকে রামকৃষ্ণনগর মূলের লোকজনেরা নিজেদের মধ্যে গড়ে তোলেন এক সৌহার্দমূলক বাতাবরণ । এবং সেই সূত্রেই ২০০০ সালে গঠিত হয় ‘ ...

কবির মজলিশ-গাথা

তুষারকান্তি সাহা   জন্ম ১৯৫৭ সাল৷ বাবা প্ৰয়াত নিৰ্মলকান্তি সাহা ও মা অমলা সাহার দ্বিতীয় সন্তান   তুষারকান্তির ৮ বছর বয়সে ছড়া রচনার মাধ্যমে সাহিত্য ভুবনে প্ৰবেশ৷ ‘ ছায়াতরু ’ সাহিত্য পত্ৰিকায় সম্পাদনার হাতেখড়ি হয় কলেজ জীবনে অধ্যয়নকালীন সময়েই৷ পরবৰ্তী জীবনে শিক্ষকতা থেকে সাংবাদিকতা ও লেখালেখিকেই পেশা হিসেবে গ্ৰহণ করেন৷ প্ৰথম ছড়া প্ৰকাশ পায় সাতের দশকে ‘ শুকতারা ’ য়৷ এরপর ‘ দৈনিক যুগশঙ্খ ’ পত্ৰিকার ‘ সবুজের আসর ’, দৈনিক সময়প্ৰবাহ ও অন্যান্য একাধিক কাগজে চলতে থাকে লেখালেখি৷ নিম্ন অসমের সাপটগ্ৰামে জন্ম হলেও বৰ্তমানে গুয়াহাটির স্থায়ী বাসিন্দা তুষারকান্তির এ যাবৎ প্ৰকাশিত গ্ৰন্থের সংখ্যা ছয়টি৷ এগুলো হচ্ছে নগ্ননিৰ্জন পৃথিবী (দ্বৈত কাব্যগ্ৰন্থ) , ভবঘুরের অ্যালবাম (ব্যক্তিগত গদ্য) , একদা বেত্ৰবতীর তীরে (কাব্যগ্ৰন্থ) , প্ৰেমের গদ্যপদ্য (গল্প সংকলন) , জীবনের আশেপাশে (উপন্যাস) এবং শিশু-কিশোরদের জন্য গল্প সংকলন ‘ গাবুদার কীৰ্তি ’ ৷ এছাড়াও বিভিন্ন পত্ৰপত্ৰিকায় প্ৰকাশিত হয়েছে শিশু কিশোরদের উপযোগী অসংখ্য অগ্ৰন্থিত গল্প৷ রবীন্দ্ৰনাথের বিখ্যাত ছড়া , কবিতা ও একাধিক ছোটগল্প অবলম্বনে লিখেছেন ...

শুদ্ধ বানানচর্চার প্রয়োজনীয়তা ও সচেতনতা

উত্তরপূর্বের বাংলা সাহিত্যচর্চার পরিসরকে কেউ কেউ অভিহিত করেন তৃতীয় ভুবন বলে , কেউ আবার বলেন ঈশান বাংলা । অনেকেই আবার এই জাতীয় ভুবনায়নকে তীব্র কটাক্ষ করে বলেন - সাহিত্যের কোনও ভুবন হয় না । সাহিত্যকে ভৌগোলিক গণ্ডির মধ্যে আটকে রাখা যায় না । কারও ব্যক্তিগত অভিমতের পক্ষে বা বিপক্ষে বলার কিছুই থাকতে পারে না । যে যেমন ভাবতে বা বলতেই পারেন । কিন্তু প্রকৃত অবস্থাটি অনুধাবন করতে গেলে দেখা যায় বাংলার এই যে অখণ্ড বিশ্বভুবন সেখানে কিন্তু কয়েকটি স্পষ্ট বিভাজন রয়েছে । আঞ্চলিক ভাষায় বাংলা সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রটি ধর্তব্যের মধ্যে না আনলেও মান্য বাংলা চর্চার ক্ষেত্রে আমরা প্রথমেই দেখব যে বাংলাদেশের বাংলা ও পশ্চিমবঙ্গের বাংলার মধ্যে শব্দরূপ তথা গৃহীত বানানের ক্ষেত্রেও বহু তারতম্য রয়েছে । সংলাপ বা প্রেক্ষাপট অনুযায়ী মান্য বাংলারও ভিন্ন ভিন্ন রূপের প্রয়োগ দেখতে পাওয়া যায় । যেমন পানি / জল , গোসল / স্নান , নাস্তা / প্রাত : রাশ ইত্যাদি । সেসবের উৎস সন্ধানে না গিয়ে শুধু এটাই বলার যে বাংলা সাহিত্য চর্চার ক্ষেত্রে আঞ্চলিকতা এক অমোঘ পর্যায় । বিহার / ঝাড়খণ্ডের বাংলা আর নিউইয়র্কের বাংলা এক হলেও সাহিত্যে তা...