Skip to main content

একবার মৌমাছি হয়ে দেখি, হাসনুহানা ফুটেছে কেমন রাতের সরণিতে… সবুজ কবিতার কাব্যগ্রন্থ ‘আঁচল’


ডুয়ার্স থেকে জাটিঙ্গা, বরাকের পথ বেয়ে কবিতার ধারা বয়ে এসেছে যেন তিস্তাপারের তরুণ কবি সায়ন্তন ধরের প্রথম কবিতার বইআঁচলনানা রঙের এক কবিতা-কোলাজ, যে কোলাজে সবুজ হয়ে উঠেছে মণি মরকতের মতো উজ্জ্বলউদ্ভিদবিদ কবি উত্তরপূর্বে, ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে কর্মরতস্বভাবতই বিজ্ঞান, ভাষা, মাতৃভাষা, ফেলে আসা দিনের স্মৃতি রোমন্থন, শান্তি-সম্প্রীতির অন্বেষণ, বন্ধুকৃত্য আদি বিষয়কে কবিতায় ধরে রাখলেও সায়ন্তন যেন গাছগাছালি, ফুল ফল, মাটি, অরণ্য আর প্রকৃতির কাছেই আত্ম-সমর্পিতপ্রকৃতির রূপমাধুর্য, সবুজ, অরণ্য নদী, তিস্তা, ডুয়ার্স থেক সান্দাক্ফু, মেঘালয় থেকে সুন্দরবন, পাহাড়, বরফ, ডিমা হাসাও থেকে জাটিঙ্গা হয়ে বরাক পর্যন্ত প্রকৃতির নেশায় বিভোর কবির এই কাব্যগ্রন্থটি যেন প্রকৃতির আঁচলে বসে লেখা এক প্রকৃতিবন্দনাস্বাভাবিক অর্থেই এক সার্থক গ্রন্থনাম
প্রকৃতি ছোঁয়া পেতে কবি তাই ছুটে বেড়ান এদিক ওদিকট্রেনের কামরায় জানালার পাশে বসে তিনি লিখেন রূপগাথা -
চলন্ত ট্রেনের জানালা যেন এক চলন্ত লাইব্রেরি
পাতা ওলটাও আর পড়ে যাও,
সে যেন এক চলমান আর্ট গ্যালারি
দেখে যাও ছবি আর গেঁথে রাখো হৃদয়ে,
একটা রূপমায়া, ধুপছায়া টাইপের সিনেমাহল
(কবিতা - ওপেন টি বায়োস্কোপ)
বরাকের পথে জাটিঙ্গাকে দেখে অভিভূত কবি তেমনি লিখেন -
আমি তো নীলচে সবুজ তিস্তাকে চিনি,
তুমি কে গো লাল জলের নদী ?...
রাঙামাটির গাঢ় সবুজ অরণ্যে প্রতিধ্বনিত হয়ে এল
জাটিঙ্গা জাটিঙ্গা জাটিঙ্গা
কতটা পথ একসাথে চললাম…. একসাথে নিলাম কত বাঁক
তুমি শোনালে তোমার তীরভূমির উপকথা
ওই যে পাখিরা যেখানে উড়ে আসে আগুনপাখি হবে বলে
কেমন আছে তোমার বন্ধুরা ? চিরি-জিরি ?...
(কবিতা - জাটিঙ্গা)
কবিরা সাধারণত এমনই হনপাত্র যথাযথ হলে স্থান-কালের থাকে না কোনও বাধজন্মভূমি, কর্মভূমি আর নিখিল বিশ্ব - সবই আপন - একাকারএকের পর এক কবিতায় তাই যেমন উঠে এসেছে পৃথিবীর যাবতীয় অনিয়ম আর ভালোবাসাহীনতা অন্যদিকে তারই উপশম হিসেবে কবিকল্পনায় ধরা দিয়েছে পৃথিবীকে ভালোবেসে কিছু করার তাগিদস্বত:স্ফুর্ত ধারায় জন্ম নেয় কিছু অনাবিল পঙ্ক্তি -
আমরা কি পারি না এমন সমাজ গড়তে/ যুদ্ধবিধ্বস্ত প্রিয়  ধরণিতে/ একবার মউমাছি হয়ে দেখি/ হাসনুহানা ফুটেছে কেমন রাতের সরণিতে(কবিতা - হাসনুহানা ফুটুক)
কিংবা
মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয় সুপ্ত আগ্নেয়গিরি হই…/ যখনই কেউ মৃত ভাববে/ তখনই নিজের অন্তরের লাভা দিয়ে/ আরও একটা পম্পেই নগরী গড়ব…/ আবারও সেজে উঠবে সেই ব্যারেনল্যান্ডসূর্য উঠবে নিয়ম মতো,…/ একে একে সপুষ্পকেরা পুষ্প বিকশিত করবে…/ প্রজাপতি উড়বে এক ফুল থেকে অন্য ফুলে/ নতুন প্রাণের স্পন্দন নিয়ে (কবিতা - অন্য রকম ইচ্ছে)
এমনি নানাবিধ ভাবনায় সেজে উঠেছে ৬৪ পৃষ্ঠা জুড়ে ৫৩টি কবিতার সম্ভারপ্রথম কাব্যগ্রন্থ হিসেবে শব্দ, পঙ্ক্তিবিষয়ক জড়তা রয়ে গেছে কিছু কবিতায়পঙ্ক্তির অভ্যন্তরে ছন্দের আভাস ফুটিয়ে তোলার প্রয়াসও সেভাবে নজরে পড়েনিআসলে প্রকৃতির রূপবর্ণনায় নিবেদিত কবিপ্রাণ বিষয়কেই করেছেন পাখির চোখকাগজের মান, ছাপার স্পষ্টতা এবং সুবীর মণ্ডলের প্রচ্ছদ যথাযথ হলেও অক্ষর/পঙ্ক্তি বিন্যাস বানানের ক্ষেত্রে রয়ে গেছে ত্রুটিসূচিপত্রেও পৃষ্ঠাসংখ্যার উল্লেখ নির্ভুল হয়নিগ্রন্থাভ্যন্তরে ফন্ট কিংবা ফন্ট সাইজের পরিবর্তন শোভনীয় হয় নাএসব ত্রুটিকে পাশে সরিয়ে রাখলে বিশেষ করে প্রকৃতিপ্রেমীদের কাছে এক সুপাঠ্য সুখপাঠ্য কাব্যগ্রন্থআঁচল

বিদ্যুৎ চক্রবর্তী

প্রকাশক - টেক টাচ টক, কলকাতা 
মূল্য - ২০০ টাকা, যোগাযোগ - ৯৩৮২০৩৮০২৭

Comments

Popular posts from this blog

শেকড়ের টানে নান্দনিক স্মরণিকা - ‘পরিযায়ী’

রামকৃষ্ণনগর । প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আবহে বরাক উপত্যকার এক ঐতিহ্যময় শহর । বিশেষ করে শিক্ষাদীক্ষার ক্ষেত্রে চিরদিনই এক অগ্রণী স্থান হিসেবে উচ্চারিত হয়ে আসছে এই নাম । বৃহত্তর রামকৃষ্ণনগরের গোড়াপত্তনের ইতিহাস বহুদিনের । দেশভাগের আগে ও পরে , উত্তাল সময়ে স্থানচ্যূত হয়ে এখানে থিতু হতে চাওয়া মানুষের অসীম ত্যাগ ও কষ্টের ফলস্বরূপ গড়ে ওঠে এক বিশাল বাসযোগ্য অঞ্চল । শুধু রুটি , কাপড় ও ঘরের স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রই নয় , এর বাইরে শিক্ষা অর্জনের ও শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে মমনশীলতার পরিচয় দিয়েছিলেন সেইসব মহামানবেরা । ফলস্বরূপ এক শিক্ষিত সমাজব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল যদিও উচ্চশিক্ষার জন্য পরবর্তী প্রজন্মকে বেরোতে হয়েছিল নিজ বাসস্থান ছেড়ে । শিলচর তখন এ অঞ্চলের প্রধান শহর হওয়ায় স্বভাবতই শিক্ষা ও উপার্জনের স্থান হিসেবে পরিগণিত হয় । এবং স্বভাবতই রামকৃষ্ণনগর ছেড়ে এক বৃহৎ অংশের মানুষ এসে পাকাপাকিভাবে থাকতে শুরু করেন এই শিলচরে । এই ধারা আজও চলছে সমানে । শিলচরে এসেও শেকড়ের টানে পরস্পরের সাথে যুক্ত থেকে রামকৃষ্ণনগর মূলের লোকজনেরা নিজেদের মধ্যে গড়ে তোলেন এক সৌহার্দমূলক বাতাবরণ । এবং সেই সূত্রেই ২০০০ সালে গঠিত হয় ‘ ...

কবির মজলিশ-গাথা

তুষারকান্তি সাহা   জন্ম ১৯৫৭ সাল৷ বাবা প্ৰয়াত নিৰ্মলকান্তি সাহা ও মা অমলা সাহার দ্বিতীয় সন্তান   তুষারকান্তির ৮ বছর বয়সে ছড়া রচনার মাধ্যমে সাহিত্য ভুবনে প্ৰবেশ৷ ‘ ছায়াতরু ’ সাহিত্য পত্ৰিকায় সম্পাদনার হাতেখড়ি হয় কলেজ জীবনে অধ্যয়নকালীন সময়েই৷ পরবৰ্তী জীবনে শিক্ষকতা থেকে সাংবাদিকতা ও লেখালেখিকেই পেশা হিসেবে গ্ৰহণ করেন৷ প্ৰথম ছড়া প্ৰকাশ পায় সাতের দশকে ‘ শুকতারা ’ য়৷ এরপর ‘ দৈনিক যুগশঙ্খ ’ পত্ৰিকার ‘ সবুজের আসর ’, দৈনিক সময়প্ৰবাহ ও অন্যান্য একাধিক কাগজে চলতে থাকে লেখালেখি৷ নিম্ন অসমের সাপটগ্ৰামে জন্ম হলেও বৰ্তমানে গুয়াহাটির স্থায়ী বাসিন্দা তুষারকান্তির এ যাবৎ প্ৰকাশিত গ্ৰন্থের সংখ্যা ছয়টি৷ এগুলো হচ্ছে নগ্ননিৰ্জন পৃথিবী (দ্বৈত কাব্যগ্ৰন্থ) , ভবঘুরের অ্যালবাম (ব্যক্তিগত গদ্য) , একদা বেত্ৰবতীর তীরে (কাব্যগ্ৰন্থ) , প্ৰেমের গদ্যপদ্য (গল্প সংকলন) , জীবনের আশেপাশে (উপন্যাস) এবং শিশু-কিশোরদের জন্য গল্প সংকলন ‘ গাবুদার কীৰ্তি ’ ৷ এছাড়াও বিভিন্ন পত্ৰপত্ৰিকায় প্ৰকাশিত হয়েছে শিশু কিশোরদের উপযোগী অসংখ্য অগ্ৰন্থিত গল্প৷ রবীন্দ্ৰনাথের বিখ্যাত ছড়া , কবিতা ও একাধিক ছোটগল্প অবলম্বনে লিখেছেন ...

শুদ্ধ বানানচর্চার প্রয়োজনীয়তা ও সচেতনতা

উত্তরপূর্বের বাংলা সাহিত্যচর্চার পরিসরকে কেউ কেউ অভিহিত করেন তৃতীয় ভুবন বলে , কেউ আবার বলেন ঈশান বাংলা । অনেকেই আবার এই জাতীয় ভুবনায়নকে তীব্র কটাক্ষ করে বলেন - সাহিত্যের কোনও ভুবন হয় না । সাহিত্যকে ভৌগোলিক গণ্ডির মধ্যে আটকে রাখা যায় না । কারও ব্যক্তিগত অভিমতের পক্ষে বা বিপক্ষে বলার কিছুই থাকতে পারে না । যে যেমন ভাবতে বা বলতেই পারেন । কিন্তু প্রকৃত অবস্থাটি অনুধাবন করতে গেলে দেখা যায় বাংলার এই যে অখণ্ড বিশ্বভুবন সেখানে কিন্তু কয়েকটি স্পষ্ট বিভাজন রয়েছে । আঞ্চলিক ভাষায় বাংলা সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রটি ধর্তব্যের মধ্যে না আনলেও মান্য বাংলা চর্চার ক্ষেত্রে আমরা প্রথমেই দেখব যে বাংলাদেশের বাংলা ও পশ্চিমবঙ্গের বাংলার মধ্যে শব্দরূপ তথা গৃহীত বানানের ক্ষেত্রেও বহু তারতম্য রয়েছে । সংলাপ বা প্রেক্ষাপট অনুযায়ী মান্য বাংলারও ভিন্ন ভিন্ন রূপের প্রয়োগ দেখতে পাওয়া যায় । যেমন পানি / জল , গোসল / স্নান , নাস্তা / প্রাত : রাশ ইত্যাদি । সেসবের উৎস সন্ধানে না গিয়ে শুধু এটাই বলার যে বাংলা সাহিত্য চর্চার ক্ষেত্রে আঞ্চলিকতা এক অমোঘ পর্যায় । বিহার / ঝাড়খণ্ডের বাংলা আর নিউইয়র্কের বাংলা এক হলেও সাহিত্যে তা...