বসন্ত শুধু প্রস্ফুটিল
কুসুমের বেলা নয়,
বসন্ত ঝরা পাতারও বেলা। ঝরা পাতারই মতো আমি যোগসূত্র বিচ্ছিন্ন
হয়েছিলাম এমনই এক বসন্তে। তাই বসন্ত এলেই আমার অন্তরে সৃষ্টি হয় এক শূণ্যতা,
এক দুঃখবোধের পালা। এমনি এক বিশেষ উদাস বসন্তের দুপুরে আজ গিয়ে
হাজির হয়েছিলাম গুয়াহাটি বশিষ্ঠ মন্দির এলাকায়। আমার ঘরের খুবই কাছে। প্রায়ই যাই।
সব কিছু চেনা। বশিষ্ঠ নদীর ঝরনার মতো প্রবাহিত জলধারা আর আসা যাওয়ার পথে ঝরা পাতার
উড়ে যাওয়া দেখে মনে হলো আমাদের এই জীবনটাওতো এমনি এক ধারাবাহিক ঝরে যাওয়ারই
বৃত্তান্ত বৈ আর কিছু নয়। নদী, নালা, ঝরনার
জল ক্রমাগত বয়ে চলেছে - নানা পথ, নানা
ঘাত প্রতিঘাত পেরিয়ে সাগরের পানে। ঝরা পাতা বৃন্তচ্যুত হয়ে আশ্রয় নিচ্ছে ধরিত্রীরই
বুকে। মানব জীবনও এমনি করে বয়ে চলে ধারা হয়ে, জীবন ধারা। বয়ে
চলে শেষ গন্তব্য পার্থিব চোখে পঞ্চভূতে,
অপার্থিব মননে অজানার পানে।
মন্দিরের সামনে থাকা সব দোকানপাট বন্ধ। মারণ
ভাইরাসের ভয়ে ভীত সন্ত্রস্ত মানবজাতি। বেঁচে থাকার অদম্য স্পৃহা। মন্দির
দর্শনার্থীদের জন্য বন্ধ। পুজো হচ্ছে নিয়মিত। কিন্তু দলে দলে লাফালাফি করতে থাকা
বাঁদরগুলো সব গেল কোথায় ?
অন্যদিন এদের জ্বালায় অতিষ্ঠ হয়ে যাই, আজ মনে
মনে খুঁজে বেড়াচ্ছিলাম। মানব মনের এক বিচিত্র পর্যায়। ওরা সব কি ভাইরাসের ভয়ে ফিরে
গেল গভীর অরণ্যে ? নাকি কাল সন্ধ্যার শব্দনিনাদে পালিয়ে গেল
ভয় পেয়ে ? পেছনের দিকে কুলুকুলু বয়ে চলেছে পাহাড়ি নদী
বশিষ্ঠ। কাছের এক বিশাল পাথরের উপরে গিয়ে বসলাম খানিকটা সময়। বড্ড কাঠখোট্টা
লাগছিল চরাচর। যেন শুকিয়ে গেছে সব লাবণ্য।
এমনি এক কালবসন্তের রাতে আমি হারিয়েছিলাম
আমার জন্মদাত্রীকে। এও তো জীবন ধারারই অঙ্গ। কিন্তু কিছু ঘটনা, কিছু ব্যথা ক্ষত হয়ে গেঁথে
থাকে মনের অতলে। যতদিন বেঁচে ছিলেন স্নেহের অবারিত পরশ বিলিয়ে গেছেন আমার দেহমনে।
শেষ বয়সে তার কতটুকুই বা দিতে পেরেছি ফিরিয়ে ? শেষ দিনটি প্রায়
অচৈতন্য অবস্থায় কাটাচ্ছিলেন মা। বসে রয়েছিলাম পাশে। কিন্তু সেই বিশেষ মুহুর্তটি
আসার সামান্য আগে খানিকটা সময় মা’কে একলা রেখেই একটু সরে
গিয়েছিলাম অবসরের জন্য। আর সেই ফাঁকেই মা যেন নীরব অভিমানে ফাঁকি দিয়ে চলে গেলেন
সেই অজানা গন্তব্যে। কিছু একটা আঁচ করে তড়িঘড়ি ফিরে এসেই আর দেখা পেলাম না জীবন্ত
মায়ের। এত দিন ধরে চলে আসা যথাসম্ভব যত্নআত্তিকে এক লহমায় অসার প্রতিপন্ন করে মা
বুঝিয়ে দিলেন যে মাতৃঋণ কখনো শোধ করা যায় না।
সেই থেকে বড় অপরাধী লাগে যেন নিজেকে। বড় স্বার্থপর, বড়ই অকৃতজ্ঞ। পারো যদি ক্ষমা করে দিয়ো মা, তুমি তো অপার স্নেহেরই প্রতিচ্ছবি।
Comments
Post a Comment