আজ মহালয়া। মহা আলয়
থেকে পিতৃপুরুষের নেমে আসার দিন। পিতৃপুরুষে মাতৃরাও আছেন সসম্মানে। তাই তো মাতা,
মাতামহ,
প্রমাতামহরাও তিল
তর্পণের অধিকারী। মাতামহী,
প্রমাতামহীও আছেন
তালিকায়।
আজকের
দিনটি আমার সত্যিকার অর্থেই শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণের দিন। আজকের ভোর আমার ফেলে আসা
অতীতের বুক চিরে আমার সত্ত্বা জুড়ে বিছিয়ে দেয় বাবা ও মায়ের অনবদ্য
স্মৃতিমঞ্জরী।
তখন
আমি ১০ থেকে ১২র নাবালক। তীব্র গরিবির ঝাপটা সামলে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর
সংগ্রামে ব্যতিব্যস্ত বাবা ও মা। আমরা চার ভাই বোন মিলে শুধু স্নেহ মমতা আর
সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে এগোচ্ছি ভবিষ্যতের পথে।
মা
ছিলেন সরস্বতীর নীরব পূজারী। কেউ জানতাম না। আজ বুঝি। মা'কে কোনও দিন কিছু লিখতে দেখিনি। এমনকি
বাজারের ফর্দটিও নয়। মা বলতেন, বাবা লিখতেন। অপূর্ব হস্তাক্ষর তাঁর। তার ছিটাফোঁটাও পেলাম
না - দুঃখ। সেই মা রাত জেগে লন্ঠনের আলোয় অগুনতি বইয়ের সদ্ব্যবহার করতেন। এর
থেকে বঙ্কিম তো ওর থেকে শরৎ। নিজে কিনে পড়ার সাধ্য ছিল না। ঘুম থেকে উঠতে
স্বভাবতই দেরি হতো মায়ের। সেই অভেস থেকে গেছিল আজীবন। বাবা ঠিক উল্টো। যত রাতেই
ঘুমোন না কেন ভোর রাতে শয্যাত্যাগ ছিল রুটিন ব্যাপার।
সবে
যখন থিতু হওয়ার সময় এলো তখনই মায়ের তীব্র ইচ্ছের ফলস্বরূপ ঘরে এলো একটি পুরোনো
ফিলিপ্স রেডিও। শুরু হলো ব্যাটারির পেছনে নিয়মিত একটি খরচ। রেডিওটি বড় পয়মন্ত
ছিল। কী মধুর আওয়াজ তার। শুরু হলো আমাদের নান্দনিক শিক্ষার পালা। গান বাজনা নাটক
এর পাশাপাশি খবরের মাধ্যমে বিশ্বকে চেনা। রোজ সকালে ঠিক সাড়ে সাতটা বাজতেই চার
জোড়া কান খাড়া থাকতো এক অঘোষিত প্রতিযোগিতায় সাফল্যের আকাঙ্ক্ষায়। 'আকাশবাণী' শব্দটি শুনেই বলে দিতে হতো - খবর পড়ছি কে। নীলিমা সান্যাল
না ইভা নাগ কিংবা অনিল চট্টোপাধ্যায়, দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়। বিকেলে আমরা দু'দলে ভাগ হয়ে যেতাম। একদল ইষ্টবেংগল আর আরেক
দল মোহন বাগান।
সেই
রেডিওটি কিন্তু বছরে একটি দিন সবার কাছে হয়ে উঠতো এক অপ্রতিরোধ্য মর্যাদার
অধিকারী। মহালয়ার কয়েক দিন বাকি থাকতেই রেডিওর স্বাস্থ্য পরীক্ষা করানো হতো
প্রতি বছর। সাথে নতুন ব্যাটারি এসে যেত দিন দুয়েক আগে। একটা সাজ সাজ রব যেন। ভোর
চারটে বাজার খানিকক্ষণ আগেই আমাদের ডেকে ওঠানোর দায়িত্ব ছিল বাবার। ঘড়িই নেই তো
এলার্ম বাজাবে কে ?
সুতরাং বাবা ছিলেন এই
দায়িত্বে। এবার রেডিওকে আলতো করে সাবধানে ধরে নিয়ে আসা হলো বারান্দায়। চারপাশে
গোল হয়ে ঘুমঘোরে আমরা। যেই না স্টেশন খোলার টিউনটি বেজে উঠলো অমনি ঘুম উধাও।
শঙ্খধ্বনিতে যেই না উচ্চারিত হলো আগমনির আগমন বার্তা অমনি পুজোর দোলায় দুলে উঠলো
অন্তরাত্মা। চোখের সামনে বদলে যেত পৃথিবী। ঘুমন্ত মাও জেগে উঠতেন কিন্তু বিছানা
ছাড়তেন না। শুয়ে শুয়েই উপভোগ করতেন পুরো অনুষ্ঠান।
এর
পরের দেড়টি ঘন্টা শুধুই চমৎকারিত্বে ভরপুর একটি যাপন বেলা। একদিকে হালকা কুয়াশার
চাদর মেখে উঠোনের শিউলি গাছের মনমাতানো সুবাসে আন্দোলিত তনু মন আর অন্যদিকে গানের
ফাঁকে ফাঁকে উদাত্ত পাঠের সাথে পাল্লা দিয়ে বাবার মন্ত্রোচ্চারণ। অবাক লাগত আমার।
কী করে বাবা এত দীর্ঘ মন্ত্র শিখলেন ?
সেই
দেড় ঘন্টার পুরোটা জুড়ে বাবা আর বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্র একাকার।
আজও মহালয়ার ভোরে চণ্ডী পাঠের শব্দে জীবন্ত হয়ে ওঁঠেন আমার বাবা ও মা। এ পালা চলবে নিরন্তর।
Comments
Post a Comment