রূপনগরে আমি
- - - - - - - - - - - -
দমবন্ধ অন্ধকার মাতৃজঠরে
অসহ্য বোধ প্রসূতি ও সন্তানের
শীত শেষে নব বসন্তে
বিগত যৌবনা জননীর কোলে
সদ্যোজাত শিশুর প্রথম সকাল
রাত শেষের চাঁদ শিমূলের ডালে
দিন জাগার প্রাক্কালে
ধরণীর বুকে আমার আত্মপ্রকাশ।
এভাবেই আত্মপ্রকাশ হলো কবি রবিশঙ্কর ভট্টাচার্যের প্রথম কাব্যগ্রন্থ - ‘রূপনগরে আমি’র। দীর্ঘদিন ধরে কবিতা লিখছেন কবি রবিশঙ্কর ভট্টাচার্য। বিভিন্ন মাধ্যমে ইতস্তত ছড়িয়ে ছিটিয়ে লিখে যাচ্ছিলেন একের পর এক অনবদ্য কবিতা। শেষ পর্যন্ত অতিমারিজনিত লক ডাউনের শেষে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হলো তাঁর কাব্য সংকলন। বইটি হাতে নিয়ে তাকালে প্রথম দর্শনেই বাজিমাত মনে হবে তার প্রচ্ছদের জন্য। নামের সঙ্গে হুবহু সামঞ্জস্য রেখে চমৎকার প্রচ্ছদ এঁকেছেন সম্রাজ্ঞী ভট্টাচার্য। ভেতরের কবিতাগুলো পড়তে পড়তে নিবিড় পাঠকও নিশ্চিত হারিয়ে যাবেন ওই প্রচ্ছদে থাকা রূপনগরের অরূপ সাকিনের পথে।
বর্ষীয়ান কবি তাঁর প্রথম গ্রন্থটি উৎসর্গ করেছেন তাঁর ‘পরম স্নেহময়ী স্বর্গগতা মাতৃদেবীর স্মৃতির উদ্দেশে’। ‘মা’ শিরোনামে আত্মকথায় কবি জানিয়েছেন তাঁর কবিতে লিখার ইতিকথা। কবিতার পথে সাহচর্যে থাকা একাধিক ব্যক্তিবেশেষকে ধন্যবাদ জানানোর কাজটিও সেরে রেখেছেন আত্মকথায়। কবি লিখছেন - “কবিতার প্রতি প্রেরণা হিসেবে আমি প্রকৃতিকে প্রথম স্থান দিয়ে থাকি।, তারপর তাৎক্ষণিক সামাজিক ব্যবস্থা”। গ্রন্থের ভূমিকায় বিশিষ্ট কবি, সাহিত্যিক ও অগ্রগণ্য শিক্ষাবিদ তপোধীর ভট্টাচার্য লিখছেন - “- - - - কবির শহর শিলচরে আরেক তরুণের কিছু লাজুক রচনা পড়তে পারলাম। কবির বাঁশি শুনেছি, চোখে দেখিনি। - - - আমি তাঁর কবিতা-প্রয়াসে তারুণ্যের বৈশিষ্ট খুঁজে পেয়েছি। - - - - তারুণ্যের সজীবতা ‘রূপনগরে আমি’ সংকলনে যে নবীন ধানের মঞ্জরীর মতো প্রকাশিত হয়েছে এতেই আমি পড়ুয়া হিসেবে আশার নোঙর ফেলেছি। রবিশঙ্করের কলম সেতারের মতো ছন্দ লয় গাঁথা সুরের ঝঙ্কার তুলুক”। এই ভূমিকা থেকেই স্পষ্ট যে রবিশঙ্করের কবিতা বয়সের বাঁধ ভেঙে পাঠকের কাছে অনায়াসে পৌঁছে গেছে আপন সাবলীলতায়।
৫৫ পৃষ্ঠার বইয়ে সন্নিবিষ্ট রয়েছে ছোট বড় মোট ৪৩টি কবিতা। পড়তে পড়তে কেমন এক ঘোর লেগে যায় কবিতা পিয়াসী অন্তরে। একের পর এক কবিতায় অসাধারণ কিছু কথা, কিছু ব্যঞ্জনা আগ্রহ বাড়িয়ে তোলে পরবর্তী কবিতা পাঠের। ছন্দ, কিংবা যতি চিহ্নের ধার না ধেরে, অহেতুক কঠিন শব্দ প্রয়োগের পথে না হেঁটে কবি পাঠককে ধরে রেখেছেন এক অনাবিল মোহের আচ্ছন্নতায়। ‘প্রতীক্ষা’ কবিতায় কবির স্বগতোক্তি -
ডাকলি যদি
মাঝপথে একলা ফেলে
আসি বলে কোথায় গেলি
মাথার উপর আকাশ নিয়ে
গাছের মতো দাঁড়িয়ে আছি
পথ তো কেবল পথের দিকে
আমার শুধু চাওয়ার পালা
একটি জীবন পার করিয়ে
আবার বুঝি হবে দেখা
দাঁড়িয়ে আছি দাঁড়িয়ে থাকি
গাছ কিংবা পাথর হয়ে।
কবির অধিকাংশ কবিতায় রয়েছে চমকে দেওয়ার মতো একাধিক পংক্তি। বেশির ভাগ কবিতার চরণগুলো ছুঁয়ে গেছে তাঁরই কথামতো প্রকৃতি এবং সমসাময়িক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিত। করোনা কালের অসংলগ্ন জীবন যাপনের কথা উঠে এসেছে বেশ কয়েকটি কবিতায়। কবির ভাষায় “প্রতিটি কবিতায় একটি করে গল্প থাকে”। প্রকৃত অর্থেই তাঁর প্রতিটি কবিতা যেন নতুনত্বের মোড়কে পরিবেশিত এক একটি ভিন্ন স্বাদের গল্পকথা, কল্পকথা। আছে প্রিয়জনের উদ্দেশে নিবেদিত কিছু অতুলনীয় সারি -
দিনের সাথে তুমি যখন ঘুমে
রাতকে নিয়ে আমি থাকি জেগে
সময় গুণি একা একা বসে
মুহূর্ত যায় অতি ধীর পদে
নৈঃশব্দের আওয়াজ বড় ভারী
মোচড় তোলে শিরা উপশির্যয়
চোখের তারায় ভাসে মুখচ্ছবি
হৃদয় মাঝে তোমার আসন খানি।
(কবিতা - তোমার আসন)
জীবন পথের পোড় খাওয়া পথিক কবির কবিতায় বারবার উঠে এসেছে জীবনের নানা ঘাত প্রতিঘাতের ছবি। এসেছে কবি হওয়ার ঝক্কির কথাও। বরাক পারের বাসিন্দার কবিতায় যথারীতি উঠে এসেছে উনিশ নিয়ে তাঁর অনুভব। সব মিলিয়ে প্রথম প্রয়াসেই এক সুখপাঠ্য কাব্যগ্রন্থ উপহার দিতে পেরেছেন কবি রবিশঙ্কর। পাঠক পাঠিকার চোখ নিঃসন্দেহে তাঁর পরবর্তী কাব্যগ্রন্থের অপেক্ষায় তাকিয়ে রইবে।
মুদ্রণ এবং অক্ষর বিন্যাস যথাযথ হলেও আরোও খানিকটা সচেতন হলে হাতে গোণা কয়েকটি বানান ভুলও হয়তো এড়িয়ে যাওয়া যেত। যদিও এর ফলে সরল পঠনে কোথাও হয়নি ছন্দপতন।
- - - - - - - - - - - - - - বিদ্যুৎ চক্রবর্তী।
“রূপনগরে আমি”
রবিশঙ্কর ভট্টাচার্য
মূল্য - ১৫০ টাকা
যোগাযোগ - ৯৭০৬০৪১০৮৪
Comments
Post a Comment