Skip to main content

নবরূপে - ‘নবপর্যায় মাজুলি’



“বিশ বছর, দীর্ঘ সময়। এই অবকাশে পরিবর্তন অবধারিত। সেদিনের তরুণ কবি, লেখক আজ পরিণত, প্রতিষ্ঠিতও বটে। সময়ের ছোঁয়া ‘মাজুলি’র গায়ে লাগেনি, সে অনুপস্থিত সাহিত্যের জোয়ারে। ফিরে দেখা নয়, অনুধাবনও নয়। নতুন করে নতুন আর পুরনোর মধ্যে সংযোগ গড়তেই ফিরে আসা।”
সম্পাদকীয়র শুরুতেই এভাবে একটি ইতিহাসকে বর্তমানের প্রেক্ষাপটে পাঠকের দরবারে তুলে ধরেছেন পোড় খাওয়া সম্পাদক তথা কবি দিলীপ দাস। ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার সমৃদ্ধ ছোট পত্রিকা ‘মাজুলি’র গৌরবোজ্জ্বল দিনের শেষে দীর্ঘ বিরতিকে কাটিয়ে নব উদ্যোমে ফিরে এলো ‘নবপর্যায় মাজুলি’ - প্রথম বর্ষ, প্রথম সংখ্যা - তাঁরই হাত ধরে। সংক্ষিপ্ত সম্পাদকীয়র শেষ লাইনে সামগ্রিক ভাবে ফুটে উঠেছে এই গরজের ছোঁয়া - “অবশেষে, পাঠক, একটি বিনীত অনুরোধ, একটি লিটল ম্যাগ কিনে উত্তর-পূর্বে যে লিটল ম্যাগ বৃক্ষ রোপিত হয়েছিল তার গোড়ায় জলদান করুন।”
ঝকঝকে ছাপাই আর প্রায় একশো ভাগ নির্ভুল বানানসমৃদ্ধ পত্রিকায় দীপঙ্কর কর-এর মানানসই প্রচ্ছদ যেন ১০৭ পৃষ্ঠার এই পত্রিকাটিকে তুলে ধরেছে এক অনতিক্রম্য উচ্চতায়। এই উচ্চতাকে ধরে রেখেছে ভেতরের উপকরণ। সুচিন্তিত, সুচয়িত সব লেখাগুলো না পড়লে পিছিয়ে পড়তে হতো।
শুরুতেই চমক। ব্যতিক্রমী সাহিত্যিক বীরেন্দ্রনাথ রক্ষিতের একটি হারিয়ে যাওয়া গল্প ‘পেরেক’ নিঃসন্দেহে পত্রিকার মান বাড়িয়ে দিয়েছে বহুগুণ লেখকের রচনাশৈলীর সঙ্গে এ অঞ্চলের সাহিত্য জগতের নিভৃত পাঠকবর্গ সবাইই অল্পবিস্তর পরিচিত। বহুদিন পর আবার যেন ফিরে এলো সেই পঠনকাল। এই একটি রচনার জন্য সম্পাদককে আলাদা করে ধন্যবাদ জানাতেই হয়।
এই অনবদ্য রচনাটির পরই পাঠককে ভিন্ন স্বাদের পঠনে মনোযোগী করে তোলা হয়েছে একগুচ্ছ কবিতার মধ্য দিয়ে। কবিতায় কলম ধরেছেন দেবাশিস তরফদার, সমরজিৎ সিংহ, অমিতাভ দেব চৌধুরী। পল্লব ভট্টাচার্য, বিশ্বজিৎ দেব, স্বর্ণালী বিশ্বাস ভট্টাচার্য, আকবর আহমেদ, তমোজিৎ সাহা, দীপিকা বিশ্বাস, সুব্রত চৌধুরী, তপন মহন্ত, শিবাশিস চট্টোপাধ্যায়, সঞ্জয় ভট্টাচার্য, দেবলীনা সেনগুপ্ত, দেবপ্রতিম দেব, চিরশ্রী দেবনাথ, তিমির দে, কমলিকা মজুমদার, তাপস পাল, মৌমিতা পাল এবং কোলাজ রায়। এই পর্বে চমকে দেবার মতো বেশ কিছু নাম। সব ক’টি কবিতাই নিজগুণে আকর্ষণীয় এবং আলাদা ধাঁচের। আলাদা করে চিহ্নিত করার কোনও সুযোগই নেই। তবে একটি কথা অবশ্যই বলার থেকে যায়। ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার বাইরে আসামের বিভিন্ন প্রান্তের আরোও কয়েকজন কবির কবিতা সন্নিবিষ্ট হলে এক্ষেত্রে বৈচিত্র সম্ভবত বেড়ে যেত অনেকটাই। কোথাও একটা বৃত্তের সন্ধান পাওয়া যায়। আশা করাই যেতে পারে সাহিত্যের খাতিরে পরবর্তী সংখ্যায় এই বৃত্ত ভাঙতে সচেষ্ট হবেন সম্পাদক। এবং অগতানুগতিক ভাবেই এখানে অনুপস্থিত কবি, সম্পাদক দিলীপ দাস এর কবিতা। তাঁর এ ত্যাগ নিশ্চিতই বঞ্চিত করাছে পাঠকবর্গকে।
মেঘমালা দে মহন্ত-এর প্রবন্ধ ‘ইনফার্নো আসাম - একুশ শতকের নির্বাচিত ছোটগল্প’ এ সংখ্যার এক অমূল্য সম্পদ হিসেবে বিবেচিত হওয়ার দাবি রাখে। আসামের বহুমাত্রিক সমস্যাদীর্ণ অশান্ত জীবন যাপনের একটি মূল কারণ অসমিয়া-বাঙালির সম্পর্কের জটিল বিন্যাস। সেটির সূত্রপাত তথা পরবর্তী উত্থান পতনের সংক্ষিপ্ত রূপরেখা এই প্রবন্ধের প্রেক্ষিত। আলোচনায় উঠে এসেছে এ অঞ্চলের অন্যূন দশজন গল্পকারের গল্পের বিষয়বস্তু ও তার প্রাসঙ্গিকতা। ফুটে উঠেছে ‘বাঙালি জীবনের লাঞ্ছনার দলিল’।
এবার আবার গল্পের নির্যাসে সিক্ত হবেন পাঠক। কিন্তু গল্পকারদের সূচিতে সাংঘাতিক কিছু নাম পাঠকের কাছে একেবারেই চমকে ওঠার মতো পরিস্থিতির সৃষ্টি করবে নিশ্চিত। গল্পে কলম কারা ধরেছেন ? না, যশস্বী কবি সঞ্জয় চক্রবর্তী, অভিজিৎ চক্রবর্তী। যদিও এই প্রথম যে এমনটা হলো তা নয়, তবু একজন কবি যে গল্পে কবিতাকেও ছাপিয়ে যেতে পারেন তার জ্বলজ্যান্ত প্রমাণ তাঁদের ‘জলের দানা’ এবং ‘গড়গড়ি ও একটি অন্ধকারের রাত’ গল্প দু’টি। এছাড়াও সুখপাঠ্য গল্প লিখেছেন তপন রায়। অমৃতা প্রীতমের গল্প ‘নীচে কে কপড়ে’র অনুবাদ করেছেন অভিজিৎ লাহিড়ী। শিরোনাম ‘ঈশ্বরের চোখ’। শিরোনামের অনুবাদ হয় না ?
গদ্যকার বাসব রায়ের দু’টি লেখা স্থান পেয়েছে এখানে। প্রথমটি ‘আমাদের নখে হলুদ বাংলা কবিতা’। উত্তর পূবের বাংলা কবিতার বর্তমান অবস্থাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছেন স্পষ্ট বক্তব্যে। দ্বিতীয়টিতে চুলচেরা আলোচনা করেছেন কবি সঞ্জয় চক্রবর্তীর কাব্যগ্রন্থ ‘দণ্ডবৎ মাতা’র।
সব মিলিয়ে ‘নব পর্যায় মাজুলি’ নব আশায় তৈরি থাকতে বলে পাঠকবৃন্দকে।
 
বিদ্যুৎ চক্রবর্তী
 
নবপর্যায় মাজুলি
সম্পাদক - দিলীপ দাস
মূল্য - ১০০ টাকা
যোগাযোগ - ৯৪৩৫০৪০৮৭০

Comments

Popular posts from this blog

শেকড়ের টানে নান্দনিক স্মরণিকা - ‘পরিযায়ী’

রামকৃষ্ণনগর । প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আবহে বরাক উপত্যকার এক ঐতিহ্যময় শহর । বিশেষ করে শিক্ষাদীক্ষার ক্ষেত্রে চিরদিনই এক অগ্রণী স্থান হিসেবে উচ্চারিত হয়ে আসছে এই নাম । বৃহত্তর রামকৃষ্ণনগরের গোড়াপত্তনের ইতিহাস বহুদিনের । দেশভাগের আগে ও পরে , উত্তাল সময়ে স্থানচ্যূত হয়ে এখানে থিতু হতে চাওয়া মানুষের অসীম ত্যাগ ও কষ্টের ফলস্বরূপ গড়ে ওঠে এক বিশাল বাসযোগ্য অঞ্চল । শুধু রুটি , কাপড় ও ঘরের স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রই নয় , এর বাইরে শিক্ষা অর্জনের ও শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে মমনশীলতার পরিচয় দিয়েছিলেন সেইসব মহামানবেরা । ফলস্বরূপ এক শিক্ষিত সমাজব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল যদিও উচ্চশিক্ষার জন্য পরবর্তী প্রজন্মকে বেরোতে হয়েছিল নিজ বাসস্থান ছেড়ে । শিলচর তখন এ অঞ্চলের প্রধান শহর হওয়ায় স্বভাবতই শিক্ষা ও উপার্জনের স্থান হিসেবে পরিগণিত হয় । এবং স্বভাবতই রামকৃষ্ণনগর ছেড়ে এক বৃহৎ অংশের মানুষ এসে পাকাপাকিভাবে থাকতে শুরু করেন এই শিলচরে । এই ধারা আজও চলছে সমানে । শিলচরে এসেও শেকড়ের টানে পরস্পরের সাথে যুক্ত থেকে রামকৃষ্ণনগর মূলের লোকজনেরা নিজেদের মধ্যে গড়ে তোলেন এক সৌহার্দমূলক বাতাবরণ । এবং সেই সূত্রেই ২০০০ সালে গঠিত হয় ‘ ...

নিবেদিত সাহিত্যচর্চার গর্বিত পুনরাবলোকন - ‘নির্বাচিত ঋতুপর্ণ’

সাধারণ অর্থে বা বলা যায় প্রচলিত অর্থে একটি সম্পাদনা গ্রন্থের মানে হচ্ছে মূলত অপ্রকাশিত লেখা একত্রিত করে তার ভুল শুদ্ধ বিচার করে প্রয়োজনীয় সংশোধন ও সম্পাদনার পর গ্রন্থিত করা । যেমনটি করা হয় পত্রপত্রিকার ক্ষেত্রে । অপরদিকে সংকলন গ্রন্থের অর্থ হচ্ছে শুধুই ইতিপূর্বে প্রকাশিত লেখাসমূহ এক বা একাধিক পরিসর থেকে এনে হুবহু ( শুধুমাত্র বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে ন্যূনতম সংশোধনসাপেক্ষে ) একত্রীকরণ । সেই হিসেবে আলোচ্য গ্রন্থটি হয়তো সম্পাদনা গ্রন্থ নয় , একটি সংকলন গ্রন্থ । বিস্তারিত জানতে হলে যেতে হবে সম্পাদক ( সংকলক ) সত্যজিৎ নাথের বিস্তৃত ভূমিকায় । পুরো ভূমিকাটিই যদি লেখা যেতো তাহলে যথাযথ হতো যদিও পরিসর সে সায় দেয় না বলেই অংশবিশেষ তুলে ধরা হলো এখানে - ‘ সালটা ১৯৯০ । ‘ দৈনিক সোনার কাছাড় ’- এ একবছর হল আসা - যাওয়া করছি । চাকরির বয়স হয়নি তাই চাকরি নয় , এই ‘ আসা - যাওয়া ’ । …. হঠাৎ করেই একদিন ভূত চাপল মাথায় - পত্রিকা বের করব । ‘… সেই শুরু । অক্টোবর ১৯৯০ সালে শারদ সংখ্যা দিয়ে পথচলা শুরু হল ‘ঋতুপর্ণ’র। পরপর দুমাস বের করার পর সেটা হয়ে গেল ত্রৈমাসিক। পুরো পাঁচশো কপি ছাপাতাম ‘মৈত্রী প্রকাশনী’ থেকে।...

মহানিষ্ক্ৰমণ

প্রায় চল্লিশ বছর আগে গ্রামের সেই মায়াময় বাড়িটি ছেড়ে আসতে বেজায় কষ্ট পেয়েছিলেন মা ও বাবা। স্পষ্ট মনে আছে অর্ঘ্যর, এক অব্যক্ত অসহায় বেদনার ছাপ ছিল তাঁদের চোখেমুখে। চোখের কোণে টলটল করছিল অশ্রু হয়ে জমে থাকা যাবতীয় সুখ দুঃখের ইতিকথা। জীবনে চলার পথে গড়ে নিতে হয় অনেক কিছু, আবার ছেড়েও যেতে হয় একদিন। এই কঠোর বাস্তব সেদিন প্রথমবারের মতো উপলব্ধি করতে পেরেছিল অর্ঘ্যও। সিক্ত হয়ে উঠছিল তার চোখও। জন্ম থেকে এখানেই যে তার বেড়ে ওঠা। খেলাধুলা, পড়াশোনা সব তো এখানেই। দাদাদের বাইরে চলে যাওয়ার পর বারান্দাসংলগ্ন বাঁশের বেড়াযুক্ত কোঠাটিও একদিন তার একান্ত ব্যক্তিগত কক্ষ হয়ে উঠেছিল। শেষ কৈশোরে এই কোঠাতে বসেই তার শরীরচর্চা আর দেহজুড়ে বেড়ে-ওঠা লক্ষণের অবাক পর্যবেক্ষণ। আবার এখানে বসেই নিমগ্ন পড়াশোনার ফসল ম্যাট্রিকে এক চোখধাঁধানো ফলাফল। এরপর একদিন পড়াশোনার পাট চুকিয়ে উচ্চ পদে চাকরি পেয়ে দাদাদের মতোই বাইরে বেরিয়ে যায় অর্ঘ্য, স্বাভাবিক নিয়মে। ইতিমধ্যে বিয়ে হয়ে যায় দিদিরও। সন্তানরা যখন বড় হয়ে বাইরে চলে যায় ততদিনে বয়সের ভারে ন্যুব্জ বাবা মায়ের পক্ষে আর ভিটেমাটি আঁকড়ে পড়ে থাকা সম্ভব হয়ে ওঠে না। বহু জল্পনা কল্পনার শেষে ত...