Skip to main content

‘পাতার আড়ালে’ - একরাশ স্নিগ্ধতা


অনেক আকুতি মিনতির পর গল্পের শেষে
নেমে এল পর্বত শিখর থেকে এক রাজকন্যা
পা পাতা জলে
আরো একটু নামতে পারো, হাঁটুজল অব্দি
হাত বাড়িয়ে রেখেছি, গত জন্ম থেকে
এইটুকু কাছে এলে
আমি তো বুক জল থেকে গলা জলে ডুব দিতে পারি।
(কবিতা - পা পাতা জল)
কিংবা -
কেউ আর খবর রাখে না আজকাল ...
তবে সরলা খবর রাখে ব্যস্ততার ফাঁকে
পাতার আড়াল থেকে ...
আচমকা তার ফোন এলে
আবেগতাড়িত হয়ে পড়ি -
যেন বিষাদ মুক্তি।
(কবিতা - সরলা খবর রাখে)।
এভাবেই প্রায় সব ক’টি কবিতায় ছড়িয়ে আছে বিষাদ মুক্তির আবহে একরাশ স্নিগ্ধতা। প্রেম, ভালোবাসা, প্রকৃতি আর শুদ্ধ পরম্পরার প্রেক্ষাপটে মোট ৪৬ টি কবিতার সমাহার জিতেন্দ্র নাথ-এর সদ্য প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ‘পাতার আড়ালে’। যথার্থ নামকরণ। একাধিক কবিতায় উঠে এসেছে এই শব্দজুটিএটি কবির চতুর্থ কাব্যগ্রন্থ। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত কবিতার সংকলনপ্রকাশিত হয়েছে সাহিত্য প্রকাশনী, হাইলাকান্দি থেকে। এছাড়াও কবির আটটি সম্পাদনা গ্রন্থ এবং একটি শ্রদ্ধাঞ্জলি গ্রন্থ ইতিমধ্যেই প্রকাশের মুখ দেখেছে। আরোও আটটি গ্রন্থ প্রকাশের অপেক্ষায়। আলোচ্য গ্রন্থটি কবি উৎসর্গ করেছেন - ডঃ ঊষারঞ্জন ভট্টাচার্য, অধ্যাপক নীতি রঞ্জন চৌধুরী, কবি দিব্যেন্দু ভট্টাচার্য ও কবি চিরশ্রী দেবনাথকে। মোট ৫৬ পৃষ্ঠার এই কাব্য  গ্রন্থের প্রচ্ছদ শিল্পী রাজদীপ পুরি এবং অলঙ্করণ পদ্মাক্ষ নাথ।
কবিতার স্নিগ্ধতার আড়ালে কবি অনায়াস দক্ষতায় ব্যক্ত করেছেন কিছু সহজ বাস্তবের উচ্চারণ। একাধিক কবিতার পঙ্‌ক্তিমধ্যে তাই ছলকে ওঠে কঠোর অথচ সরল সত্য। ‘প্রকৃতি বিরূপ হলে ধ্বংস অনিবার্য’ (কবিতা - ধ্বংস), ‘একবার পায়ের তলার মাটি সরে গেলে, আর ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব হয় না’ (কবিতা - তিন দশক কাঁপিয়ে), ‘ঘুরে ফিরে সব জল সমুদ্রে গড়ায়’ (কবিতা - আবার আসবে), ‘গভীর রাতে সব নব সৃষ্টির প্রকাশ ঘটে’ (কবিতা - বালিশের সঙ্গে), ‘কবজির জোরে এগোতে হয় সম্মুখ সমরে, সহজে পায়ের নিচে জমি আসে না’ (কবিতা - ক্ল্যাপ), ‘পথ কতটা দীর্ঘ হলো বড় কথা নয়... লক্ষ্য পর্বত শিখর’ (কবিতা - অসাধ্য সাধন), ‘জানি, অন্ধকার সরে গেলে ঘটে আলোর প্রকাশ’ (কবিতা - উৎখাত), ‘সত্য গোপন থাকে না’ (কবিতা - স্মৃতিধুলো), ‘কোন পথই শেষ পথ নয়, আবার সকল পথই এক একটি পথ ধরে চলে’ (কবিতা - কোন পথই শেষ পথ নয়) - ইত্যাদি শব্দবন্ধের যথোচিত প্রয়োগ অধিকাংশ কবিতাকে দিয়েছে এক অন্য মাত্রা, ধরিয়ে দিয়েছে কবিতার খেই।
জিতেন্দ্রর কবিতা যেন এক মোহময় আবেশের বিনির্মিত সংজ্ঞা। তাঁর কবিতায় যেন লেগে থাকে এক অনাবিল রূপমুগ্ধতা, এক শীতল অথচ অমোঘ ভালোবাসার আমেজ। ইচ্ছে হয় আবার পড়ি, বার বার পড়ি সবগুলো কবিতা -
সন্তর্পণে, চুপি চুপি দূরে চলে গেলে বুঝি
পেছনে তাকিয়ে
পাতার আড়ালে ...
 
হারিয়ে যাওয়া স্মৃতিচিহ্ন নিয়ে বেঁচে আছো
ঘাস মাটি আঁকড়ে ধরেই
 
আচমকা একদিন মুখোমুখি দেখা হয় আয়নায়
উৎসবে, ছিপি খুলে কথা কয় পরস্পর
তবুও থেমে যায় অসম্পূর্ণ বাক।
(কবিতা - পাতার আড়ালে)।
প্রকৃতির প্রতিটি উপাদান ঘুরে ফিরে আসে কবিতায়, আলাদা ভাবে কিংবা একত্রে। সেজে ওঠে প্রকৃতি-কবিতা -
কেউ যেন গলা ফাটিয়ে ডাকছে
অথবা নীরবে, ইশারায়
কান পাতলে শুনতে পাবে, ইথার তরঙ্গ
 
বাতাসে-বাতাসে, পাথরে-পাথরে কিংবা
পাতা ঝরা শব্দে
মেঘের গর্জনে
পাখির ডাকে
বাঁশির সুরে
নূপুরের শব্দে
ডাক ভেসে আসে
কেউ যেন তোমাকে ডাকছে, নাম ধরে
কান পাতলে শুনতে পাবে, হাওয়ায়।
(কবিতা - পাতা ঝরা শব্দে)।
যতিচিহ্নের যথোপযুক্ত ব্যবহার এবং বানান ভুলের ন্যূনতা এ গ্রন্থের অন্যতম সম্পদ। তবে ছাপার ক্ষেত্রে কিছুটা অবিন্যাস লক্ষ করা যায় যখন কিছু কবিতায় পঙ্‌ক্তিশেষের শব্দটি অযাচিত ভাবে পরবর্তী পঙ্‌ক্তিতে সংযোজিত হয়ে যায়।
কবি তাঁর গ্রন্থের শেষ কথাটি যেভাবে - মুগ্ধতায়, স্নিগ্ধতায় ব্যক্ত করেছেন বলে সজজেই প্রতীয়মান হয় - যা এই কাব্যগ্রন্থের মূল নির্যাসের সঙ্গে চমকপ্রদ ভাবে মানানসই হয়ে ওঠে -
প্রথম দেখার পর থেকে
তুমিই আমার আদি এবং অন্ত
বর্ণমালা
শেষকথা
অন্তিম ঠিকানা
সরে আসতে পারিনি
সবুজ প্রকৃতি কোল থেকে
 
সেই একই পুরোনো মরমি জায়গা ছুঁয়ে আছি
কতকাল ধরে
আমাকে উষ্ণতা দেয়
তরতাজা করে রাখে, সারাবেলা
ঘুরে ফিরে বুকের দিকে টেনে নেয় অক্লেশে।
(কবিতা - সবুজ প্রকৃতি)।
জিতেন্দ্র নাথের কবিতা আশার কিরণ দেখায় পাঠক মনে। বোধ হয় - এখনো হারিয়ে যায়নি সব কিছু। কবিমননের গরজে এখানেই একজন সমাজবদ্ধ কবির দায়বদ্ধতা এবং সার্থকতা।

বিদ্যুৎ চক্রবর্তী।

‘পাতার আড়ালে’
জিতেন্দ্র নাথ
মূল্য - ৮০ টাকা
যোগাযোগ - ৯৩৬৫১৬০৭৩৩

Comments

Post a Comment

Popular posts from this blog

খয়েরি পাতার ভিড়ে ...... ‘টাপুর টুপুর ব্যথা’

ব্যথা যখন ঝরে পড়ে নিরলস তখনই বোধ করি সমান তালে পাল্লা দিয়ে ঝরে পড়ে কবিতারা । আর না হলে একজন কবি ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর ব্যথাকেও কী করে ধরে রাখতে পারেন কবিতার পঙক্তি জুড়ে ? নষ্টনীড়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন - ‘মনে যখন বেদনা থাকে, তখন অল্প আঘাতেই গুরুতর ব্যথা বোধ হয়’। তাঁর অসংখ্য গান, কবিতা ও রচনায় তাই বেদনার মূর্ত প্রকাশ লক্ষ করা যায়।    এমনই সব ব্যথা আর ভিন্ন ভিন্ন যাপনকথার কাব্যিক উপস্থাপন কবি বিশ্বজিৎ দেব - এর সদ্য প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ - ‘ টাপুর টুপুর ব্যথা ’ । মোট ৫৬ পৃষ্ঠার এই কাব্যগ্রন্থের ৪৮ পৃষ্ঠা জুড়ে রয়েছে ৫৬ টি কবিতা। কিছু সংক্ষিপ্ত, কিছু পৃষ্ঠাজোড়া। ভূমিকায় বিশিষ্ট সাহিত্যিক রতীশ দাস লিখছেন - ... বিশ্বজিতের কবিতাগুলো অনেকটা তার কাঠখোদাই শিল্পের রিলিফ-এর মতোই উচ্ছ্বাসধর্মী - যেন উত্তলাবতল তক্ষণজনিত আলো-আঁধারি মায়াবিজড়িত, পঙক্তিগুলো পাঠক পাঠিকার মনোযোগ দাবি করতেই পারে...। এখান থেকেই আলোচ্য গ্রন্থের কবিতাগুলোর বিষয়ে একটা ধারণা করা যেতে পারে। এখানে উচ্ছ্বাস অর্থে আমাদের ধরে নিতে হবে কবির ভাবনার উচ্ছ্বাস, সে বিষাদেই হোক আর তাৎক্ষণিক কোনও ঘটনার জের হিসেবেই হোক। তাই হয়তো কবি করোনার

অবশ্যপাঠ্য এক সার্থক উপন্যাস ‘হাজার কণ্ঠে মা’

উত্তরপূর্বের বাংলা সাহিত্যের সৃষ্টিক্ষেত্রে একটি উপন্যাসের সৃষ্টি কিংবা জন্মের ইতিহাস বহু পুরোনো হলেও এই ধারা যে সতত প্রবহমান তা বলা যাবে না কোনওভাবেই। বিশেষ করে আজকের দিনে অন্তত এই ঘটনাকে একটি ‘বিরল’ ঘটনা বলতে দ্বিধা থাকার কথা নয়। এমনও দেখা যায় যে ৪০ থেকে ৮০ পৃষ্ঠার বড় গল্প বা উপন্যাসিকাকে দিব্যি উপন্যাস বলেই বিজ্ঞাপিত করা হচ্ছে। তবে প্রকৃতই এক উপন্যাসের জন্মের মতো ঘটনার ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি সংযোজিত হয়েছে সাহিত্যিক সজল পালের উপন্যাস ‘হাজার কণ্ঠে মা’। ২৫৩ পৃষ্ঠার এই উপন্যাসটির প্রকাশক গুয়াহাটির মজলিশ বইঘর। তথাকথিত মানবপ্রেমের বা নায়ক নায়িকার প্রেমঘটিত কোনো আবহ না থাকা সত্ত্বেও উপন্যাসটিকে মূলত রোমান্সধর্মী উপন্যাস হিসেবেই আখ্যায়িত করা যায় যদিও আঞ্চলিকতা ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকেও উপন্যাসটিকে যথার্থই এক সার্থক উপন্যাস বলা যায় নির্দ্বিধায়। প্রেম এখানে বিচিত্র এক অনুষঙ্গ নিয়ে এসেছে। সংস্কৃতিমনষ্কতা, নান্দনিকতা এবং প্রেম একসূত্রে গ্রথিত হয়ে আছে এখানে। উপন্যাসটি ‘সার্থক’ অর্থে এখানে সচরাচর একটি উপন্যাসের আবশ্যকীয় ধর্মসমূহ যথা প্রাসঙ্গিক ঘটনাবিন্যাস , কাহিনির জমজমাট বুনোট , মানানসই চরিত্র

ভালোবাসার আস্তরণে ঢেকে রেখেছি, না-বলা কথা……'

তোমাকে দেখব বলে, প্রতিদিন জেগে উঠি। তোমার নবযৌবনার সৌন্দর্য আমাকে প্রাণ চঞ্চল করে তোলে।   তোমার রূপ, তোমার স্বর্ণআভা সৌন্দর্য, আমার দেহমনে শিহরণ জাগায়……। (কবিতা - স্বর্ণআভা)   গ্রন্থের নাম স্বর্ণআভা। কবি পরিমল কর্মকারের সদ্য প্রকাশিত প্রথম কাব্যগ্রন্থ। ভাবনা ও ভালোবাসার বিমূর্ত প্রকাশ - কবিতায় কবিতায়, পঙক্তিতে পঙক্তিতে। অধিকাংশ কবিতাই ভালোবাসাকে কেন্দ্র করে। সুতরাং এই গ্রন্থকে অনায়াসে প্রেমের কবিতার সংকলন বলতেও আপত্তি থাকার কথা নয়। কবির কাব্যভাবনা, কাব্যপ্রতিভার ঝলক দীর্ঘদিন ধরেই প্রতিভাত হয়ে আসছে উপত্যকা ও উপত্যকার সীমানা ছাড়িয়ে। তারই একত্রীকরণের দায়ে এই কাব্য সংকলন। তবে এই গ্রন্থে ভালোবাসার বাইরেও সন্নিবিষ্ট হয়েছে অন্য স্বাদের কিছু কবিতা। এর মধ্যে আছে জীবনবোধ ও জীবনচর্চার ভাবনা, শরৎ, স্মৃতি, উনিশের ভাবনা, দেশপ্রেম, সমাজের অন্দরে লুকিয়ে থাকা অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আদি। ‘পাঠকের উদ্দেশে’ শিরোনামে ভূমিকায় এমনটাই ব্যক্ত করেছেন পরিমল - ‘আমার কবিতার গরিষ্ঠাংশই জীবনমুখী। বাস্তব জীবনের নির্যাসসম্পৃক্ত এই কবিতাগুলি পাঠককে পরিচয় করিয়ে দেবে সমাজের অনেক গভীর ও অনস্বীকার্য রূঢ়