Skip to main content

শিশির সেনগুপ্তের স্বনির্বাচিত গল্প সংকলন - ‘প্রতিভাস’



“ভবতোষবাবু আমাদের পাড়াতেই থাকেন। নিঃসন্তান, খিটখিটে মেজাজের, বাচাল প্রকৃতির। আমরা জেঠু জেঠু বলেই ডাকি। ডাকি মানে পারতপক্ষে ডাকি না, নেহাত মুখোমুখি হয়ে গেলে…। আর জেঠিমা ঝগড়ুটে, ফাটা বাঁশের মতো গলার স্বর, কেউ বা বলে দাঁড়কাকের মতো। শুনলেই মেজাজ বিগড়ে যায়…
এই সাত সকালে ওখানেই নাকি যেতে হবে। বাবার হুকুম। প্রথমে বাবা কিন্তু দাদাকেই বলেছিল যেতে, কিন্তু দাদা কটাস করে না বলে দিল। বলল, তুমি কি আমার মরা মুখ দেখতে চাও ? আমি কি তোমার পর ? সৎ ছেলে ? তবে এত পয়সা খরচ করে পড়াতে গেলে কেন ? তারপর ছোটভাইকে বলতে গেলেই ফোঁস করে উঠে বলল, আমার তো দাড়ি-গোঁফই ওঠেনি। ওই বাড়ি থেকে প্রাণ নিয়ে ফিরে আসতে পারব না। অগত্যা আমি মানে সবেধন নীলমণি। মেজ ছেলে যে। না ঘরকা, না ঘাটকা। গেলেই বা কী ? আমিও মুখের উপর না বলে দিতে পারতাম, পারতাম কোনো অজুহাত দাঁড় করাতে, কিন্তু করিনি। কারণ আমি না গেলে যে বাবাকেই যেতে হয়। আর এই দুর্দিনের বাজারে বাবার যদি কিছু হয়ে যায় তো পুরো সংসারটাই যাবে। সরকারের দয়ায় যদি চাকরিও হয়, হবে তো দাদার। আমার তাতে কী ? তাই রাজি হয়ে যাই। গুটি গুটি চলি ওই মহাপুরুষের বাড়ির দিকে।” (গল্প - শ্রাদ্ধ সমাচার)।
...... এভাবেই প্রতিটি গল্পের অবতরণিকায় কৌতূহল জাগানো একরাশ চমৎকারিত্ব ছড়িয়ে দিয়েছেন সাবলীল সহজ কথায়। সাহিত্যিক শিশির সেনগুপ্তের স্বনির্বাচিত গল্প সংকলন ‘প্রতিভাস’। মোট চব্বিশটি গল্পের সমাহার এই গ্রন্থ। পেপারব্যাকে ১০০ পৃষ্ঠার এই সংকলন জুড়ে রয়েছে নিত্যদিনের মানবিক জীবনযাত্রার টুকরো টুকরো মণিমালা। সপাট কথার উচ্চারণে, সাবলীল ভঙ্গিমায় পাঠকের রোজকার কথাবার্তার এক অসাধারণ প্রকাশ প্রতিটি গল্প। বাক্যসমূহের গঠনে, বিন্যাসে এবং সরল প্রকাশে পাঠক হৃদয়ে গড়ে ওঠে কুতূহল, পাঠের উন্মাদনা। স্বল্প কথনে গুছিয়ে বলার এক অনন্য উদাহরণ এই গ্রন্থটি। দু’একটির বাইরে অন্য গল্পগুলোকে ঠিক অণুগল্পও বলা যায় না আবার বড়গল্পও নয়। সচরাচর লিখিত ছোটগল্পের চাইতে আবার অবয়বে খানিক খাটো। দুই থেকে তিন পৃষ্ঠার এক একটি গল্প জুড়ে রয়েছে দৈনন্দিন জীবনে মানবিক সিদ্ধান্ত সমূহের অপরূপ প্রকাশ। প্রতিটি গল্পই যেন সমাজের প্রতি বহন করে এক নির্মোহ বার্তা। শুভ চিন্তার পরিচায়ক এই বার্তাসমূহ। এখানেই বলা যেতে পারে যে লেখক বা সাহিত্যিক হিসেবে শিশির সেনগুপ্ত ভাবীকালের কাছে পরিশোধ করতে পেরেছেন তাঁর সামাজিক দায়বদ্ধতা। নিছক ঘটনাবলির বাখানে লিখা হয়নি একটি গল্পও।
উল্লেখযোগ্য কিছু গল্পের নাম তুলে ধরা যেতে পারে অনায়াসে। যেমন - কালের বইঠা, বউয়ের জ্বর হয় না, নেশা, মাতৃভিটে, জীবনের বাঁকে বাঁকে, কালের জাঁতাকলে, রাজু ও দীপ, দুই চরণের গল্প, নীল আকাশের নিচে, জন্মদিন, হরি না হইরা ইত্যাদি।
ছোট ছোট বাক্য, ছোট ছোট দুঃখ ব্যথা নিয়ে সেজে উঠেছে একের পর এক গল্প - যেন জীবনবোধের এক একটি পাঠ। রয়েছে তিনটি গল্পের একটি সিরিজ - ‘ছোটকার গল্প’। অধ্যাত্ম অনুভূতির উপর লিখা এই গল্পগুলো। স্বনির্বাচিত গল্পসমূহের এই সংকলনটি প্রকাশিত হয়েছে জলসিঁড়ি সাহিত্য পত্রিকার পক্ষ থেকে। প্রচ্ছদে এমনটাই লিখা থাকলেও ভেতরের পাতায় আছে - প্রকাশক ঋতম পাবলিকেশন্‌স্‌। অক্ষর বিন্যাস সুলতা বাগচি, আকর্ষণীয় প্রচ্ছদ সৌজন্যে কমল ঘোষ। মুদ্রক সিটি অফসেট, গুয়াহাটি। বইয়ের ছাপাই ও বাঁধাই যথাযথ। অক্ষর, শব্দ ও বাক্য বিন্যাস তথা ছাপাই স্পষ্ট এবং নিখুঁত। ভেতরে কিছু কিছু বানান ভুল রয়ে গেছে। বিশেষ করে ‘র’ এবং ‘ড়’-এর মধ্যে বহু স্থানে ঘটে গেছে পারস্পরিক স্থানচ্যুতি। লেখক এই গ্রন্থটি উৎসর্গ করেছেন করোনার সময় অকালে তাঁদের ছেড়ে যাওয়া ‘বউদি মিনতি সেনগুপ্ত এবং করোনায় মৃত ব্যক্তিদের প্রতি’।
শেষ প্রচ্ছদে রয়েছে লেখকের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি।
সব মিলিয়ে ‘প্রতিভাস’ এক সরল পঠনের, সুখ পঠনের সার্থক গল্পের সম্ভার যা পাঠক মনে নিশ্চিতই সঞ্চার করে প্রত্যাশা।
- বিদ্যুৎ চক্রবর্তী
 
‘প্রতিভাস’
শিশির সেনগুপ্ত
মূল্য - ১৭০ টাকা
যোগাযোগ - ৯৪৩৫১৪৮৫০২

Comments

Popular posts from this blog

খয়েরি পাতার ভিড়ে ...... ‘টাপুর টুপুর ব্যথা’

ব্যথা যখন ঝরে পড়ে নিরলস তখনই বোধ করি সমান তালে পাল্লা দিয়ে ঝরে পড়ে কবিতারা । আর না হলে একজন কবি ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর ব্যথাকেও কী করে ধরে রাখতে পারেন কবিতার পঙক্তি জুড়ে ? নষ্টনীড়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন - ‘মনে যখন বেদনা থাকে, তখন অল্প আঘাতেই গুরুতর ব্যথা বোধ হয়’। তাঁর অসংখ্য গান, কবিতা ও রচনায় তাই বেদনার মূর্ত প্রকাশ লক্ষ করা যায়।    এমনই সব ব্যথা আর ভিন্ন ভিন্ন যাপনকথার কাব্যিক উপস্থাপন কবি বিশ্বজিৎ দেব - এর সদ্য প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ - ‘ টাপুর টুপুর ব্যথা ’ । মোট ৫৬ পৃষ্ঠার এই কাব্যগ্রন্থের ৪৮ পৃষ্ঠা জুড়ে রয়েছে ৫৬ টি কবিতা। কিছু সংক্ষিপ্ত, কিছু পৃষ্ঠাজোড়া। ভূমিকায় বিশিষ্ট সাহিত্যিক রতীশ দাস লিখছেন - ... বিশ্বজিতের কবিতাগুলো অনেকটা তার কাঠখোদাই শিল্পের রিলিফ-এর মতোই উচ্ছ্বাসধর্মী - যেন উত্তলাবতল তক্ষণজনিত আলো-আঁধারি মায়াবিজড়িত, পঙক্তিগুলো পাঠক পাঠিকার মনোযোগ দাবি করতেই পারে...। এখান থেকেই আলোচ্য গ্রন্থের কবিতাগুলোর বিষয়ে একটা ধারণা করা যেতে পারে। এখানে উচ্ছ্বাস অর্থে আমাদের ধরে নিতে হবে কবির ভাবনার উচ্ছ্বাস, সে বিষাদেই হোক আর তাৎক্ষণিক কোনও ঘটনার জের হিসেবেই হোক। তাই হয়তো কবি করোনার

অবশ্যপাঠ্য এক সার্থক উপন্যাস ‘হাজার কণ্ঠে মা’

উত্তরপূর্বের বাংলা সাহিত্যের সৃষ্টিক্ষেত্রে একটি উপন্যাসের সৃষ্টি কিংবা জন্মের ইতিহাস বহু পুরোনো হলেও এই ধারা যে সতত প্রবহমান তা বলা যাবে না কোনওভাবেই। বিশেষ করে আজকের দিনে অন্তত এই ঘটনাকে একটি ‘বিরল’ ঘটনা বলতে দ্বিধা থাকার কথা নয়। এমনও দেখা যায় যে ৪০ থেকে ৮০ পৃষ্ঠার বড় গল্প বা উপন্যাসিকাকে দিব্যি উপন্যাস বলেই বিজ্ঞাপিত করা হচ্ছে। তবে প্রকৃতই এক উপন্যাসের জন্মের মতো ঘটনার ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি সংযোজিত হয়েছে সাহিত্যিক সজল পালের উপন্যাস ‘হাজার কণ্ঠে মা’। ২৫৩ পৃষ্ঠার এই উপন্যাসটির প্রকাশক গুয়াহাটির মজলিশ বইঘর। তথাকথিত মানবপ্রেমের বা নায়ক নায়িকার প্রেমঘটিত কোনো আবহ না থাকা সত্ত্বেও উপন্যাসটিকে মূলত রোমান্সধর্মী উপন্যাস হিসেবেই আখ্যায়িত করা যায় যদিও আঞ্চলিকতা ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকেও উপন্যাসটিকে যথার্থই এক সার্থক উপন্যাস বলা যায় নির্দ্বিধায়। প্রেম এখানে বিচিত্র এক অনুষঙ্গ নিয়ে এসেছে। সংস্কৃতিমনষ্কতা, নান্দনিকতা এবং প্রেম একসূত্রে গ্রথিত হয়ে আছে এখানে। উপন্যাসটি ‘সার্থক’ অর্থে এখানে সচরাচর একটি উপন্যাসের আবশ্যকীয় ধর্মসমূহ যথা প্রাসঙ্গিক ঘটনাবিন্যাস , কাহিনির জমজমাট বুনোট , মানানসই চরিত্র

ভালোবাসার আস্তরণে ঢেকে রেখেছি, না-বলা কথা……'

তোমাকে দেখব বলে, প্রতিদিন জেগে উঠি। তোমার নবযৌবনার সৌন্দর্য আমাকে প্রাণ চঞ্চল করে তোলে।   তোমার রূপ, তোমার স্বর্ণআভা সৌন্দর্য, আমার দেহমনে শিহরণ জাগায়……। (কবিতা - স্বর্ণআভা)   গ্রন্থের নাম স্বর্ণআভা। কবি পরিমল কর্মকারের সদ্য প্রকাশিত প্রথম কাব্যগ্রন্থ। ভাবনা ও ভালোবাসার বিমূর্ত প্রকাশ - কবিতায় কবিতায়, পঙক্তিতে পঙক্তিতে। অধিকাংশ কবিতাই ভালোবাসাকে কেন্দ্র করে। সুতরাং এই গ্রন্থকে অনায়াসে প্রেমের কবিতার সংকলন বলতেও আপত্তি থাকার কথা নয়। কবির কাব্যভাবনা, কাব্যপ্রতিভার ঝলক দীর্ঘদিন ধরেই প্রতিভাত হয়ে আসছে উপত্যকা ও উপত্যকার সীমানা ছাড়িয়ে। তারই একত্রীকরণের দায়ে এই কাব্য সংকলন। তবে এই গ্রন্থে ভালোবাসার বাইরেও সন্নিবিষ্ট হয়েছে অন্য স্বাদের কিছু কবিতা। এর মধ্যে আছে জীবনবোধ ও জীবনচর্চার ভাবনা, শরৎ, স্মৃতি, উনিশের ভাবনা, দেশপ্রেম, সমাজের অন্দরে লুকিয়ে থাকা অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আদি। ‘পাঠকের উদ্দেশে’ শিরোনামে ভূমিকায় এমনটাই ব্যক্ত করেছেন পরিমল - ‘আমার কবিতার গরিষ্ঠাংশই জীবনমুখী। বাস্তব জীবনের নির্যাসসম্পৃক্ত এই কবিতাগুলি পাঠককে পরিচয় করিয়ে দেবে সমাজের অনেক গভীর ও অনস্বীকার্য রূঢ়