Skip to main content

অষ্টচরণ কবিতার সুখপাঠ্য সংকলন ‘মানুষ কি মানুষের মতো’


‘আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানবিন্দু থেকে জন্ম দিলাম তোমায়
জন্ম দিলে তো চলে না, লালনের দায়িত্ব
আমি কি একা সামলাতে পারি ?
তোমাকে কি পৌঁছে দিতে পারি ভরা যৌবনে ?
চাই প্রেম, চাই ভালোবাসা, চাই ভালো লাগা,
ঘন আঁধারে হাজার জোনাকির আলো
তোমায় পৌঁছে দেবে পূর্ণিমার আকাশে,
ধ্রুবতারা হয়ে বেঁচে থেকো।’
একটি মস্ত বড় - প্রায় পৃষ্ঠাজোড়া আকারের এবং তার খাঁজে খাঁজে, অঙ্গে অঙ্গে ইতস্তত আটকে থাকা, জুড়ে থাকা আটটি পা (পড়ুন চরণ) অনবদ্য রং-এর খেলায় অভিনব এক প্রচ্ছদ সাংকেতিক এবং ষোলোআনা প্রাসঙ্গিক আটটি পা অর্থে অষ্টচরণ এক বিশেষ ধাঁচের কবিতা, যার পঙক্তি সংখ্যা অতি অবশ্যই আট
এই অষ্টচরণ কবিতা নিয়ে গ্রন্থের ভূমিকায় বিশিষ্ট সাহিত্যিক ও গবেষক অশোকানন্দ রায়বর্ধন লিখছেন - “মধ্যযুগে ইতালিতে এক বিশেষ ধরনের কবিতার প্রথম উদ্ভব হয়, যার বৈশিষ্ট্য হল প্রতিটি কবিতা চোদ্দো চরণের এবং প্রতিটি চরণে সাধারণত মোট চোদ্দোটি করে অক্ষর থাকবে এই কবিতার প্রথম আট চরণের স্তবককে অষ্টক এবং পরবর্তী ছয় চরণের স্তবককে ষষ্টক বলা হয় এগুলোকে সনেট বলা হয় বাংলা ভাষায় সনেট রচনার কৃতিত্বের অধিকারী কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত অনুরূপভাবে ফরাসি ভাষায় আট লাইনের এক ধরনের পুনরুক্তিমূলক কবিতা সৃষ্টি হয় এগুলোকে ট্রায়োলেট বলা হয় ত্রয়োদশ শতক থেকে ফ্রান্সের সাহিত্যে এই ধরনের কবিতা লক্ষ করা যায় পরবর্তী সময় থেকে আজ পর্যন্ত বিশ্বের নানাভাষায় এই ধরনের কবিতা চর্চা ছড়িয়ে পড়ে সনেটের মতোই বাংলা ভাষাতেও ট্রায়োলেটের চর্চা হয়ে থাকে প্রথম ট্রায়োলেট প্রকাশিত হয় সবুজপত্রে……
সনেটের মতোই ট্রায়োলেটেও কিছু আরোপিত নিয়মাবলি প্রথমে থাকলেও কালক্রমে তা অনেকটা সরলীকৃত হয়েছে বিশিষ্ট কবিদের হাত ধরে আজকের দিনে, আধুনিক কবিতার অবয়বেই লিখা হচ্ছে ট্রায়োলেট বা এই অষ্টচরণ কবিতা সম্প্রতি ত্রিপুরা থেকে কবি অর্ধেন্দু ভৌমিক এই অষ্টচরণ কবিতা লিখে সাড়া জাগিয়েছেন পাঠক, বোদ্ধা মহলে তাঁর একটি কাব্যগ্রন্থ মানুষ কি মানুষের মতো এখানে কবি তাঁর অনুভূতির কলমে লিখছেন - “ছোটোবেলায় বাংলা শ্রেণিতে, বাংলা কবিতার নাম, কবির নাম সহ আট লাইন মুখস্থ করে ক্লাসে আসতে বলতেন শিক্ষক মশাই কোনোদিন জিগ্যেস করা হয়নি, আট লাইন কেন, এর বেশি লিখলে কী হবে ? আসলে আট লাইনে কবিতার সম্পূর্ণ সারমর্ম না এলেও, তা আন্দাজ করা যেত এটা সত্যি আট লাইনের কবিতা ছন্দবন্ধ হতে হবে এমন কোনো কথা নেই তাতে আধুনিকতার ছোঁয়া একান্ত আবশ্যিক বলে মনে করি আবার আট লাইনে মূল ভাবও যেন ফুটে ওঠে কবির আত্মতৃপ্তির সার্থকতা অষ্টচরণ কবিতার মধ্য দিয়ে ঘটবে বলে মনে করি
এবং এই লক্ষ্যেই কবি অর্ধেন্দু ভৌমিক রচনা করে চলেছেন একের পর এক অষ্টচরণ কবিতা আলোচনার শুরুতেই যে কবিতাটির উল্লেখ করা হয়েছে তার শিরোনাম অষ্টচরণ তোমাকে এভাবেই কবি তাঁর কর্মকে নিয়ে উজাড় করে দিয়েছেন তাঁর স্বপ্ন আলোচ্য বইয়ের প্রচ্ছদটিও তাই একান্তই মানানসই প্রচ্ছদ সৌজন্যে শুভনীল ভৌমিক ৬৪ পৃষ্ঠার এই গ্রন্থে আছে মোট ৫৪ টি অষ্টচরণ কবিতা নিজের বয়ান অনুযায়ীই আধুনিক কবিতার ধাঁচে লিখা হয়েছে সবকটি কবিতা ছক বা নির্দিষ্ট আকার, বৈশিষ্ট্যের গোলকধাঁধার থেকে বাইরে বেরিয়ে পঙক্তি বিন্যাস নিয়েও কবি এগিয়েছেন নিজের মতোই এখানেও নিয়মকানুনের বেড়াজালে আবদ্ধ করেননি কবিতাকে কাঁটাছেড়া করেছেন কবিতার স্বার্থে, ভাবের স্বার্থে -
‘আমি কি কবিতার হতে পারি ?
স্বজন পরিজনের মতো -
ডুবতে চাই কবিতার দুধসরে
তবুও, থেকে যায় উপচে পড়ার ভয়
আমার পাস্তুরাইজ্ড রক্ত কেবল জন্ম দেয় -
বেড়ে ওঠা মানুষের ডালভাত আর নাটি
ভেবে ভেবে দিন যায়, থালা শূন্য
শব্দরা পাশ কেটে চলে যায়
(কবিতা - ডালভাত আর মাটি)
যেমন কবিতার ভাব, বিষয় বৈচিত্র্য - তেমনই তার অবয়ব একাধিক বিষয় এসেছে গ্রন্থ জুড়ে এসেছে কোভিড কালের ত্রস্তবেলার কথা, এসেছে সমাজ, ভাবনা, ভাব-ভালোবাসা, অনুভব-অনুভূতি প্রতিটি কবিতাই নান্দনিক, শ্লীল শব্দচয়নে হয়ে উঠেছে সুখপাঠ্য কিছু কবিতার উল্লেখ করতেই হয় যেমন - আমার মাতৃভাষা, পাথরের উপবাস, কী পেলাম, তবু কেন নির্বাক, ফেনিল শব্দগুচ্ছ, মৃত্যুতেই, আকাশপাতা, পলি সার ইত্যাদি
কাব্যময়তা বজায় থেকেছে অধিকাংশ কবিতায় দুএকটি কবিতায় দুএকটি শব্দকে পরবর্তী পঙক্তিতে ঠেলে দিয়ে পঙতিসংখ্যা বজায় রাখা হয়েছে - এমন ভাবনার উদ্রেক হয় যেমন - মা ও বর্ণমালা, একমুঠো ইত্যাদি পূর্ণ বাক্যকে ভেঙে না ফেলে (যদিও একজন কবির সেই স্বাধীনতাটুকু রয়েছে পূর্ণমাত্রায়) ভাবনার সম্প্রসারণের মাধ্যমে চরণসংখ্যা বজায় রাখলে হয়তো অধিকতর কাব্যময় হয়ে উঠত কবিতা গ্রন্থনামের শেষে একটি প্রশ্নবোধক চিহ্নও (?) রাখা যেতেই পারত
সব মিলিয়ে এক নতুনত্বের স্বাদ নিয়ে উপস্থাপিত হয়েছে গ্রন্থটি স্পষ্ট ও যথাযথ ছাপাই, বাঁধাই, শব্দ বিন্যাস গ্রন্থটি উৎসর্গ করা হয়েছে অষ্টচরণ কবিতাপ্রেমী পাঠক, কবি ও শুভানুধ্যায়ীগণকে পাঠকের মন অবশ্যই জয় করতে পেরেছে এবং পারবে এই গ্রন্থটি - এমন প্রত্যয়/আশা করা যেতেই পারে

- বিদ্যুৎ চক্রবর্তী

‘মানুষ কি মানুষের মতো’
অর্ধেন্দু ভৌমিক
মূল্য - ১৮০ টাকা
যোগাযোগ - ৭০৮৫৭৮৪৮৪৫

Comments

  1. অসংখ্য ধন্যবাদ জানাই লেখককে। খুব সুনিপুণ ভাবে গ্রন্থ টির পর্যালোচনা করেছেন। তবে আরও কোনো ত্রুটি রয়েছে কিনা, তা স্পষ্ট নয়। ভালোবাসা জানবেন🌹🙏
    ভুল বা ভাবনার দুর্বলতার ঘাটতি থাকলেও তা আলোচনার দৃষ্টি এড়িয়ে যায় নি তো

    ReplyDelete
    Replies
    1. ধন্যবাদ আপনাকে। তবে দ্বিতীয় প্যারাগ্রাফে আপনার মন্তব্য বুঝতে পারলাম না। একটু যদি বিশদে লিখেন।
      আরেকটি অনুরোধ। ব্লগে কমেন্ট করলে কমেন্টদাতার নাম আসে না। তাই আপনার পরিচয় পেলে ভালো লাগত।

      Delete

Post a Comment

Popular posts from this blog

শেকড়ের টানে নান্দনিক স্মরণিকা - ‘পরিযায়ী’

রামকৃষ্ণনগর । প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আবহে বরাক উপত্যকার এক ঐতিহ্যময় শহর । বিশেষ করে শিক্ষাদীক্ষার ক্ষেত্রে চিরদিনই এক অগ্রণী স্থান হিসেবে উচ্চারিত হয়ে আসছে এই নাম । বৃহত্তর রামকৃষ্ণনগরের গোড়াপত্তনের ইতিহাস বহুদিনের । দেশভাগের আগে ও পরে , উত্তাল সময়ে স্থানচ্যূত হয়ে এখানে থিতু হতে চাওয়া মানুষের অসীম ত্যাগ ও কষ্টের ফলস্বরূপ গড়ে ওঠে এক বিশাল বাসযোগ্য অঞ্চল । শুধু রুটি , কাপড় ও ঘরের স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রই নয় , এর বাইরে শিক্ষা অর্জনের ও শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে মমনশীলতার পরিচয় দিয়েছিলেন সেইসব মহামানবেরা । ফলস্বরূপ এক শিক্ষিত সমাজব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল যদিও উচ্চশিক্ষার জন্য পরবর্তী প্রজন্মকে বেরোতে হয়েছিল নিজ বাসস্থান ছেড়ে । শিলচর তখন এ অঞ্চলের প্রধান শহর হওয়ায় স্বভাবতই শিক্ষা ও উপার্জনের স্থান হিসেবে পরিগণিত হয় । এবং স্বভাবতই রামকৃষ্ণনগর ছেড়ে এক বৃহৎ অংশের মানুষ এসে পাকাপাকিভাবে থাকতে শুরু করেন এই শিলচরে । এই ধারা আজও চলছে সমানে । শিলচরে এসেও শেকড়ের টানে পরস্পরের সাথে যুক্ত থেকে রামকৃষ্ণনগর মূলের লোকজনেরা নিজেদের মধ্যে গড়ে তোলেন এক সৌহার্দমূলক বাতাবরণ । এবং সেই সূত্রেই ২০০০ সালে গঠিত হয় ‘ ...

কবির মজলিশ-গাথা

তুষারকান্তি সাহা   জন্ম ১৯৫৭ সাল৷ বাবা প্ৰয়াত নিৰ্মলকান্তি সাহা ও মা অমলা সাহার দ্বিতীয় সন্তান   তুষারকান্তির ৮ বছর বয়সে ছড়া রচনার মাধ্যমে সাহিত্য ভুবনে প্ৰবেশ৷ ‘ ছায়াতরু ’ সাহিত্য পত্ৰিকায় সম্পাদনার হাতেখড়ি হয় কলেজ জীবনে অধ্যয়নকালীন সময়েই৷ পরবৰ্তী জীবনে শিক্ষকতা থেকে সাংবাদিকতা ও লেখালেখিকেই পেশা হিসেবে গ্ৰহণ করেন৷ প্ৰথম ছড়া প্ৰকাশ পায় সাতের দশকে ‘ শুকতারা ’ য়৷ এরপর ‘ দৈনিক যুগশঙ্খ ’ পত্ৰিকার ‘ সবুজের আসর ’, দৈনিক সময়প্ৰবাহ ও অন্যান্য একাধিক কাগজে চলতে থাকে লেখালেখি৷ নিম্ন অসমের সাপটগ্ৰামে জন্ম হলেও বৰ্তমানে গুয়াহাটির স্থায়ী বাসিন্দা তুষারকান্তির এ যাবৎ প্ৰকাশিত গ্ৰন্থের সংখ্যা ছয়টি৷ এগুলো হচ্ছে নগ্ননিৰ্জন পৃথিবী (দ্বৈত কাব্যগ্ৰন্থ) , ভবঘুরের অ্যালবাম (ব্যক্তিগত গদ্য) , একদা বেত্ৰবতীর তীরে (কাব্যগ্ৰন্থ) , প্ৰেমের গদ্যপদ্য (গল্প সংকলন) , জীবনের আশেপাশে (উপন্যাস) এবং শিশু-কিশোরদের জন্য গল্প সংকলন ‘ গাবুদার কীৰ্তি ’ ৷ এছাড়াও বিভিন্ন পত্ৰপত্ৰিকায় প্ৰকাশিত হয়েছে শিশু কিশোরদের উপযোগী অসংখ্য অগ্ৰন্থিত গল্প৷ রবীন্দ্ৰনাথের বিখ্যাত ছড়া , কবিতা ও একাধিক ছোটগল্প অবলম্বনে লিখেছেন ...

শুদ্ধ বানানচর্চার প্রয়োজনীয়তা ও সচেতনতা

উত্তরপূর্বের বাংলা সাহিত্যচর্চার পরিসরকে কেউ কেউ অভিহিত করেন তৃতীয় ভুবন বলে , কেউ আবার বলেন ঈশান বাংলা । অনেকেই আবার এই জাতীয় ভুবনায়নকে তীব্র কটাক্ষ করে বলেন - সাহিত্যের কোনও ভুবন হয় না । সাহিত্যকে ভৌগোলিক গণ্ডির মধ্যে আটকে রাখা যায় না । কারও ব্যক্তিগত অভিমতের পক্ষে বা বিপক্ষে বলার কিছুই থাকতে পারে না । যে যেমন ভাবতে বা বলতেই পারেন । কিন্তু প্রকৃত অবস্থাটি অনুধাবন করতে গেলে দেখা যায় বাংলার এই যে অখণ্ড বিশ্বভুবন সেখানে কিন্তু কয়েকটি স্পষ্ট বিভাজন রয়েছে । আঞ্চলিক ভাষায় বাংলা সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রটি ধর্তব্যের মধ্যে না আনলেও মান্য বাংলা চর্চার ক্ষেত্রে আমরা প্রথমেই দেখব যে বাংলাদেশের বাংলা ও পশ্চিমবঙ্গের বাংলার মধ্যে শব্দরূপ তথা গৃহীত বানানের ক্ষেত্রেও বহু তারতম্য রয়েছে । সংলাপ বা প্রেক্ষাপট অনুযায়ী মান্য বাংলারও ভিন্ন ভিন্ন রূপের প্রয়োগ দেখতে পাওয়া যায় । যেমন পানি / জল , গোসল / স্নান , নাস্তা / প্রাত : রাশ ইত্যাদি । সেসবের উৎস সন্ধানে না গিয়ে শুধু এটাই বলার যে বাংলা সাহিত্য চর্চার ক্ষেত্রে আঞ্চলিকতা এক অমোঘ পর্যায় । বিহার / ঝাড়খণ্ডের বাংলা আর নিউইয়র্কের বাংলা এক হলেও সাহিত্যে তা...