এ বছর অর্থাৎ
২০২৫ খ্রিস্টাব্দের ১৩ জানুয়ারি অর্থাৎ পৌষ সংক্রান্তির পূর্বদিন থেকে ৪৫ দিন ব্যাপী
মহাকুম্ভ মেলার আয়োজন হয়েছিল উত্তর প্রদেশের প্রয়াগরাজ ত্রিবেণী সংগম স্থানে। ২৬ ফেব্রুয়ারি
শিবরাত্রি দিন ছিল সমাপন। কথিত আছে প্রতি
৩, ৬, ১২ এবং ১৪৪ বছর পর বৃহস্পতি, সূর্য ও চন্দ্রের অবস্থানের উপর নির্ভর করে অনুষ্ঠিত হয় এই কুম্ভ, অর্ধকুম্ভ, পূর্ণকুম্ভ ও মহাকুম্ভ মেলা। এই
নামাকরণ সম্ভবত আয়োজনের বিশালতা ও সুচারু শ্রেণিবিভাগের সুবিধার জন্যই করা হয়েছিল।
অন্যথা প্রতিটি কুম্ভমেলার তাৎপর্যই সমান। শাস্ত্রাদিতেও স্নানজনিত পুণ্যলাভের
দিকটিতে কোনও তারতম্যের উল্লেখ নেই। বিশ্বের সবচাইতে বড় এই মেলা তথা ধর্মীয় উৎসবের
রয়েছে এক বিস্তৃত প্রেক্ষাপট যা এই ভ্রমণমূলক নিবন্ধের আলোচ্য বিষয় নয়।
সংশ্লিষ্ট সবারই তা কম-বেশি জানা।
কোটি কোটি মানুষ, প্রায় অর্ধেক ভারতবাসী এবারের এই মেলায় উপস্থিত থেকে পবিত্র গঙ্গাস্নানের মাধ্যমে এক অবিস্মরণীয় আধ্যাত্মিক পরিতৃপ্তি লাভ করতে পেরেছেন। কুম্ভমেলা মধ্যযুগ থেকেই রাজসাহায্য লাভে সমর্থ হয়েছিল। মৌর্য ও গুপ্ত সাম্রাজ্যের রাজারা মেলার ব্যবস্থাপনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতেন। এই সময়েই নানা আখড়া প্রতিষ্ঠিত হয় যা আজও কুম্ভমেলার অন্যতম আকর্ষণ। দিনকাল পালটেছে। যুগধর্মের নানা পরিবর্তন ঘটেছে। বিশ্বের সাথে ভারতেও জনসংখ্যা বাড়ছে, বেড়েছে অকল্পনীয় ভাবে। এসবের প্রতি লক্ষ রেখে বর্তমান সরকার এই মেলাকে আধ্যাত্মিক আয়োজনের পাশাপাশি ব্যবসায়িক দৃষ্টিকোণ থেকেও বিশ্লেষণ করেছেন। ফলত এই মেলার মাধ্যমে সরকারি কোষাগারে জমা পড়েছে এক বিশাল পরিমাণ অর্থ যা আবার জনগণের কল্যাণেই ব্যয় করা হবে। দেশ, রাজ্য তথা আয়োজক শহরের অর্থনীতিতে পড়েছে সদর্থক প্রভাব যা সহজেই অনুভব করা যায়।
###
কুম্ভমেলায় গঙ্গাস্নানের একটি সুপ্ত ইচ্ছে ছিল বহু দিনের। এবারের কুম্ভে সেই ‘মহাকুম্ভ’ শব্দটি কিংবা ‘১৪৪ বছর’-এর সাংখ্যিক নস্টালজিয়া তীব্র হয়ে দেখা দিল মেলা আয়োজনের বলতে গেলে শেষের দিকেই। মেলা শুরু হয়ে যাওয়ার পরও যাওয়ার ব্যাপারে কোনও সিদ্ধান্ত হয়নি। আচমকাই সুপ্ত ইচ্ছেটি যেন তীব্রভাবে প্রকট হয়ে উঠল। আমাদের তিনজনের সংসার। গৃহিণী আদ্যোপান্ত ধর্মপ্রাণা। স্বভাবতই একটি পা তাঁর বাড়ানোই ছিল যদিও এ নিয়ে কিছু বলার সাহস করে উঠতে পারেননি সম্ভবত বাকি দুজনের আধ্যাত্মিকতা থেকে সতত দূরে থাকার স্বভাবটির জন্যই। ভেতরে ভেতরে হয়তো কামনা করছিলেন যে আমাদের বাকি দুই ‘মনিষ্যি’র যেন কিছু সুমতি হয়। তাঁর সেই প্রার্থনার ফলেই কিনা জানি না হঠাৎ একটি চিন্তার উদ্রেক হল মনের মধ্যে। চারদিক থেকে এত লোক যাচ্ছে এই মহামানবমেলায় আর আমরা পাপীতাপীর মতো ঘরে বসে রইব ? না হয় তাই রইলাম। আমার তো তেমন চিন্তাভাবনাও নেই কিন্তু একটি সন্তান যে আমার রয়েছে। ইতিমধ্যেই আমরা শতাব্দীর অন্যতম একটি যুগান্তকারী ঘটনা (পড়ুন দুর্ঘটনা)র সম্মুখীন হয়েছি। কোভিড অতিমারি। এবার আবার সম্মুখীন হয়েছি আরেকটি ঘটনার যার পুনরাগমন ঘটবে ১৪৪ বছর পর। আমি নাহয় নাই গেলাম সেই মহাকুম্ভে কিন্তু পাশাপাশি আমার সন্তানেরও তো যাওয়া হবে না। হয়তো এ নিয়ে ওর শেষ জীবনে জবাবদিহি করতে হতে পারে ওর সন্তান-সন্ততি কিংবা তৃতীয় প্রজন্মের কাছে। এবং স্বাভাবিক ভাবেই দোষের দায়ভার এসে বর্ষিত হবে আমার উপর। সুতরাং সেই দায়ভার মুক্ত হতে সিদ্ধান্ত নিলাম আমরাও যাবে।
মা-মেয়ের খুশি আর ধরে না। নিমেষেই সঙ্গীও জুটে গেল যাঁরা মনে মনে তৈরিই ছিলেন। আমার বউদি এবং মিসেসের বউদি। টায় টায় সমান হয়ে গেল টিম। সঙ্গী তো জুটল কিন্তু টিকেট কোথায় ? রেলে, বিমানে টিকেটের হাহাকার। ত্রাতা হয়ে দেখা দিল আমার ভ্রাতুষ্পুত্র পল। ওর বন্ধু থাকে প্রয়াগরাজ। যোগাযোগ করল বন্ধুর সঙ্গে। থাকার জায়গা নিয়ে নিশ্চিন্ত হওয়া গেল। কিন্তু সরাসরি প্রয়াগরাজ বা তার আশেপাশে থাকা কোন জায়গার টিকেটই পাওয়া যাচ্ছিল না। শেষ পর্যন্ত একটু ঘুরিয়ে কাটতে হল টিকেট। যাওয়ার পথে বেনারস অবধি এবং ফেরার টিকেট হল পাটনা থেকে।
সেই হিসেবে ১৪ জানুয়ারি ভোর সাড়ে চারটায় পাঁচজন মিলে বেরিয়ে পড়লাম ব্যোম ভোলানাথ বলে। মনের মধ্যে একাধারে অধ্যাত্মচিন্তা ও ভ্রমণসুখের সমাহার। তিনজন মহিলা যাত্রী মিলে একগাদা খাদ্যদ্রব্য নিয়েছেন সাথে। মনে পড়ল একটি কথা। আগেকার দিনে সাধারণ মানুষেরা শুধুমাত্র চিড়ে-গুড় সম্বল করে বেরিয়ে পড়তেন তীর্থ ভ্রমণে। রেলের সাধারণ কামরায় ওই খেয়ে পুণ্যার্জন করে ফিরে আসতেন এক বুক প্রশান্তি নিয়ে। আমরা এখন আধুনিক হয়েছি, আমাদের চাহিদা অপার। তবু এই যে বেরিয়েছি এক মহাতীর্থের উদ্দেশে সেও বা কম কীসে ?
###
রাত দেড়টায় অর্থাৎ ১৫ তারিখ আমরা পৌঁছে গেলাম বেনারস স্টেশনে। ট্রেন থেকে নেমে দেখি গোটা স্টেশন চত্বর লোকে লোকারণ্য। দিন রাত একাকার হয়ে গেছে। স্টেশনের বাইরেও মাটিতে কম্বল পেতে শুয়ে বসে রয়েছেন অগুনতি মানুষ। বুঝে গেলাম এই শুরু আমাদের সংগ্রাম। ঘণ্টাদুয়েক ওখানে কাটিয়ে রাত তিনটেয় একটি ভাড়া গাড়ি করে রওনা হলাম প্রয়াগরাজের উদ্দেশে। সারা রাস্তায় সারি সারি গাড়ি। রাস্তার পাশের অধিকাংশ চায়ের দোকান, ধাবাই খোলা। বোঝা গেল রাজ্য জুড়েই চলছে এক উৎসব। পাশাপাশি সচল অর্থনীতির উৎকৃষ্ট উদাহরণ। তখন সকাল প্রায় ন’টা। প্রয়াগরাজ শহর এলাকার প্রায় পনেরো কিলোমিটার আগে থামিয়ে দেওয়া হল আমাদের গাড়ি। ওখান থেকে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে গাড়িঘোড়ার প্রবেশ। অগত্যা লটবহর নিয়ে নেমে পড়তেই হল। একজন অটোওয়ালার সঙ্গে কথা বলে উঠে পড়লাম অটোয়। গঙ্গার উপর সেতু ধরে চলাচল করতে দেওয়া হচ্ছে না কোনও গাড়ি। সুতরাং অটোওয়ালা আমাদের নামিয়ে দিল সেতু থেকে প্রায় আধা কিলোমিটার আগে। অটো থামিয়ে নিজেই সব থেকে বড় লাগেজটি হাতে করে প্রায় দুইশো মিটার জায়গা হেঁটে আমাদের নিয়ে দাঁড় করালো সেখানে যেখান থেকে বাইক সার্ভিস পাওয়া যায় সেতু পেরোনোর জন্য। সবাই আমরা জিনিসপত্র ভাগ করে নিয়ে বাইকে করেই পেরোলাম সেতু। সে এক বিরল অভিজ্ঞতা। মানুষের ঢল চলছে সেতুর ওপারে যেখানে রয়েছে সংগম ঘাট। সেতুর ওপারে ‘চুঙ্গি চক’ বলে একটি জায়গায় এসে বাইকওয়ালারা বিদায় নিল। আমরা সেখান থেকে একটি ই-রিকশা করে এসে পৌঁছে গেলাম নির্ধারিত হোটেলে। ইতিমধ্যেই হোটেলে পৌঁছে গেছে ভ্রাতুষ্পুত্র পলের বন্ধু সাগর। ততক্ষণে বেলা অনেকটাই হয়ে গেছে। রাস্তায় দেখেছি মাইলের পর মাইল মানুষের যাওয়া আসার সারি। সফরক্লান্ত আমাদের আর সেদিন বেরনোর মতো শরীর বা মনের জোর ছিল না। খেয়েদেয়ে কিছুটা বিশ্রাম শেষে সন্ধ্যা হওয়ার আগে বেরিয়ে পড়লাম খানিক আশেপাশের দুয়েকটি জায়গায়। আমাদের হোটেলটি ছিল শহরের অশোক নগর এলাকায় বাবা চৌরাহার পাশে। আমরা এক এক করে গেলাম সাঁই মন্দির এবং সিভিল লাইনের হনুমান মন্দিরে। হনুমান মন্দিরের বিশাল চত্বর জুড়ে রয়েছে আলাদা আলাদা ভাবে রাম-সীতা-লক্ষণ এবং ১৪টি শিবলিঙ্গযুক্ত শিবমন্দির। টুকিটাকি কিছু কেনাকাটাও সেরে নিলেন মহিলামণ্ডল। সন্ধ্যায় বাবা চৌরাহায় অবস্থিত বিশাল মিষ্টির দোকান ও রেস্টুরেন্টে সামান্য খাওয়াদাওয়া সেরে ফিরে এলাম হোটেলে কারণ শেষরাত সাড়ে চারটেতে আমাদের বেরিয়ে যাওয়ার কথা ঘাটের উদ্দেশে।
###
রাত সাড়ে তিনিটাতে উঠে ফ্রেশ হতে না হতেই আগে থেকে বলে রাখা গাড়ির ড্রাইভারের ফোন এসে গেল - সাব, আ গয়া হু ম্যাঁয়। ঘড়িতে প্রায় সাড়ে চারটা। বেরিয়ে পড়লাম সবাই মিলে। বাইরে তখনও অন্ধকার। এটাই স্বাভাবিক। পথে যেতে যেতে দেখলাম - পথ হাঁটছে অনেক মানুষ - গন্তব্য মেলা পরিসর। প্রায় তিরিশ মিনিট গাড়ি চালিয়ে এক জায়গায় এসে দেখা গেল পার্কিং। ড্রাইভার জানালো আর যাওয়া যাবে না। পুলিশ নিয়ন্ত্রণ করছে গাড়ি ও মানুষ। দিন রাত তাদের ডিউটি। কত যে গাড়ি, কত মানুষ। এরা পৌঁছে গেছে আমাদের আগেই। গাড়ি থেকে নেমে শুরু হল আমাদের হাঁটা। মানুষের ভিড়ে এবং আমাদের মধ্যে কারও কারও হাঁটুর সমস্যা থাকায় আমরা এগোতে থাকলাম ধীরে ধীরে। যতই যাচ্ছি দেখছি অন্যান্য দিক থেকেও দলে দলে আসছে মানুষ। মানুষের এমন মহামেলা আগে দেখিনি কখনও। একদিকে সারি সারি টয়লেট দেখতে পেলাম অসংখ্য। এই শেষরাতেও সাফাইকর্মীরা জল দিয়ে ধুয়ে মুছে পরিচ্ছন্ন করছেন এগুলো। দু’ঘণ্টায় প্রায় তিন কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে আমরা পৌঁছে গেলাম সংগম ঘাটের কিনারে। তিল ধারণের স্থান নেই সেখানে। অগণিত মানুষ নিজেদের সঙ্গে নিয়ে যাওয়া প্লাস্টিকের মাদুর বিছিয়ে কাপড় বদলে স্নানের জন্য তৈরি হচ্ছেন। বাচ্চা থেকে বুড়ো, স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে মানুষ শুধু মানুষ। ততক্ষণে গঙ্গা নদীর ওপারে সোনালি আলো ছড়াচ্ছে ভোরের সূর্য। নদীর জলে তার প্রতিচ্ছায়া। এক স্বর্গীয় দৃশ্য।
আমি কাপড় বদলালেও বাকিরা স্নানের পোশাক পরেই এসেছিল। আমরা দুই ভাগে স্নানের জন্য গিয়ে নদীতে নামলাম। কেউ রইলেন ছাড়া কাপড় পাহারা দিতে, কেউ মোবাইল হাতে স্নানের দৃশ্য ক্যামেরাবন্দি করতে। মহিলারা স্নান সেরে পাশেই থাকা সারি সারি চেঞ্জ রুমের একটিতে ঢুকে কাপড় বদলে বেরিয়ে এলেন। ভিড় বাড়ছে ক্রমাগত। চারদিকে পুলিশের ছয়লাপ। রয়েছে জলরক্ষী বাহিনী - স্নানের জায়গাটা ঘিরে। অগণিত মানুষ ডুব দিচ্ছে সংগমের পবিত্র জলে। যেন জলকেলি উৎসবে মেতেছে গোটা ভারতবর্ষ। স্নান ও সূর্যপ্রণাম সেরে আমি সবেমাত্র কাপড় বদলেছি অমনি এক ব্যক্তি, বোঝাই যাচ্ছে সদ্য স্নান সেরে উঠেছেন, বললেন - ভাইয়া (দাদা), আমার ছোটভাইকে খুঁজে পাচ্ছি না। আপনার ফোন থেকে একটা কল করতে পারি ? আমি মুহূর্তের জন্য দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়লেও পরক্ষণেই ভাবলাম এই সময়ে কারও কাজে লাগতে পারাটা তো পুণ্যের। এই জায়গাটি তো আমাদের বাহ্যিক পৃথিবীর মতো এত কলুষিত নয়। আমি তাঁকে নাম্বার জিজ্ঞেস করে রিং হতেই তাঁর হাতে দিলাম মোবাইল। কথা হল। ছোটভাই কোথায় আছে জানাল। ভদ্রলোক আমাকে ধন্যবাদ জানিয়ে আরও কিছু কথা বলে বিদায় নিলেন। খানিক পরেই অপরিচিত নম্বর থেকে ফোন এল - দু’ভাইয়ের মিলন হয়েছে। ওরা রাজস্থানের। আমরা অসমের শুনে অনেকটাই অবাক হল। একটি প্রশ্ন মাথায় এল - ভদ্রলোক যেভাবে ভাইয়ের নাম্বারটি আমাকে মুখস্থ বলে দিলেন তা আজকের দিনে ক’জন পারে ?
যাইহোক এইসব চলতে থাকার মধ্যেই দেখা গেল দক্ষিণ ভারত থেকে আগত এক অতি সম্ভ্রান্ত পরিবারের জ্যেষ্ঠতম মহিলা সদস্যটি অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। আমার সহধর্মিণী এসব ব্যাপারে খানিকটা পারঙ্গত হওয়ার সুবাদে ছুটে গিয়ে তাঁর প্রাথমিক পরিচর্যায় যোগদান করলেন। কী ভাষায় কথা হল জানি না তবে জানা গেল তিনি হার্টের রোগী এবং বলা সত্ত্বেও অদম্য মনোবল নিয়ে ছুটে এসেছেন মানুষের এই মহামেলায়। ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠলেন তিনি। এবার আমাদের ফেরার পালা। গোটা এলাকা জুড়ে ইস্পাদের শক্ত ধাতব পাত বিছিয়ে রাখা হয়েছে। তাই এত ভিড়েও চলতে কোনও অসুবিধা হচ্ছিল না। তবে ততক্ষণে খানিকটা ক্লান্তি এসে যেন আচ্ছন্ন করছিল আমাদের। মানুষের ভিড় থেকে সরে এসে চায়ের দোকানে চা পান করে তা অনেকটাই কাটিয়ে ওঠা গেল।
আমরা যেদিক থেকে এসেছিলাম সেদিকে ফেরার রাস্তা নেই। সুতরাং অন্য রাস্তায় ফিরতে হল। ফলে হাঁটতে হল অনেক বেশি। ড্রাইভারকে ফোন করে বলে দিলাম হোটেলে ফিরে যেতে কারণ আমাদের ফেরার রাস্তায় নো এন্ট্রি। কম হলেও সাত কিলোমিটার হেঁটে আবার সেই চুঙ্গি চক এসে আবার ই-রিকশা নিয়ে আমরা ফিরে এলাম হোটেলে। দুপুর হয়ে গিয়েছিল। তাই হাত পা ধুয়ে সামান্য ফ্রেশ হয়েই আমরা কাছেই থাকা হোটেলে সেরে নিলাম দুপুরের খাওয়া। কিছু প্রশ্ন মাথায় ঘুরছিল আমার। এই যে এত লোক স্নান করছে একই জায়গায়, সেখানে স্নান করে এসে, কোথায় আমাদের শরীরে তো সামান্য চুলকানি কিংবা কাদায় সাদা হয়ে যাওয়া দাগও পড়েনি। এই যে দুর্বল পা নিয়ে এতটা পথ পাড়ি দেওয়া হল, কোথায় পথশ্রমের ক্লান্তি তো তেমন অনুভূত হল না। এর উত্তর খোঁজায় দায় তোলা রইল পাঠকের জন্য।
###
এদিন রাত নটায় আমাদের বাস ছিল প্রয়াগরাজ থেকে পাটনার উদ্দেশে। বাস কোম্পানি থেকে জানালো যে ভিড়ের জন্য নির্ধারিত জায়গার বদলে বাস ছাড়বে প্রায় চল্লিশ কিলোমিটার দূর একটি জায়গা থেকে। আমাদের ড্রাইভার বলল ট্র্যাফিক জ্যামের জন্য এই চল্লিশ কিলোমটার যেতে পাঁচ থেকে ছয় ঘণ্টাও লেগে যেতে পারে। আমরা রিস্ক না নিয়ে তাই বিকেল সাড়ে তিনটেয় বেরিয়ে এলাম হোটেল থেকে। পথে অভাবনীয় জ্যাম। গ্রামের মধ্য দিয়ে নতুন কাঁচা রাস্তা ধরে এগোতে এগোতে দেখলাম গঙ্গার অন্য তটে নতুন অনেকগুলো ঘাট খোলা হয়েছে। স্বভাবতই গাড়ি ও মানুষের প্রচণ্ড ভিড়। একের পর এক গাড়ি আসছে দেশের নানা প্রান্ত থেকে। সত্যিই আমাদের পাঁচ ঘণ্টা লেগে গেল বাস ধরতে। সারা দিনের ধকল শেষে উঠে বসলাম বাসে।
সারা রাতই হাইওয়ে জুড়ে গাড়ির লাইন দেখা গেল। দাঁড়িয়ে রয়েছে। পরদিন সকালের পরিবর্তে দুপুর দুটোয় গিয়ে আমরা পাটনা পৌঁছলাম। আমাদের গাড়ি ছিল রাত সাড়ে এগারোটায়। সুতরাং আমরা রাজেন্দ্রনগর টার্মিনাল স্টেশনের উলটো দিকে একটি হোটেলে এসে উঠলাম। দুপুরের খাওয়াদাওয়া সেরে এবং রাতের জন্য রুটি-সবজি নিয়ে স্টেশনে এসে গেলাম রাত সাড়ে দশটা নাগাদ। এত দূরে পাটনা স্টেশনেও যে এভাবে ভিড়ের মধ্যে পড়ব তা ভাবনায়ও আসেনি কারও। ট্রেন প্ল্যাটফর্মে আসতেই মানুষের হুটোপাটিতে ট্রেনে ওঠা খুবই কষ্টকর হয়ে পড়েছিল। তবু আমাদের নির্ধারিত কামরায় উঠে দেখলাম আমাদের আসন যথারীতি ফাঁকাই আছে। গুছিয়ে বসে রাতের খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম সবাই। প্ল্যাটফর্মে পুলিশ এবং গাড়িতে টিকিট পরীক্ষকদের ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য। দেড়মাসব্যাপী এই সমাগমকে নিয়ন্ত্রণ করেছেন এইসব সরকারি কর্তারা। তাঁরা কিন্তু সাধুবাদের প্রাপ্য।
পরদিন রাতে আমাদের পৌঁছানোর কথা। ট্রেন প্রতিটি স্টেশনে নির্ধারিত সময়েই এসে পৌঁছোচ্ছে। আমরা নিজেদের মধ্যে গল্পগুজবে মত্ত। ভাবছিলাম এত সুসংহত জনসমাগমে পদপিষ্ট হয়ে মৃত্যুর দুর্ঘটনাটি ঘটল কী করে। বড়ই দুঃখজনক এই ঘটনা। বলতেই হবে এই একটি ঘটনা যেন অনেকটাই ম্লান করে দিয়েছে মহাকুম্ভের গরিমা। আবার অন্যদিকে চিন্তা করলে দেখা যায় ধর্মীয় সমাগমে এমন ঘটনা কিন্তু বিরল নয়। ফি বছর সরকারি সাবিসিডি পেয়ে যাওয়া হজযাত্রীদের মধ্যেও এমন ঘটনা ঘটে থাকে প্রায় প্রতি বছর। সম্প্রতি জানা গেছে এদেশেও নেহরুজি প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন কুম্ভমেলায় সংঘটিত এমন এক ঘটনায় প্রায় পাঁচশোজন যাত্রী নাকি পদপিষ্ট হয়ে নিহত হয়েছিলেন। সব মৃত্যুই এক একটি দুর্ঘটনা এবং দুঃখজনক। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক মৃত্যু নিয়েও যে কত নোংরা রাজনীতি এদেশে চলে তাও প্রকাশ্যে এল। একটি রাজনৈতিক দলের নেতা তো এবারের কুম্ভকে মৃত্যুকুম্ভ নামেও অভিহিত করলেন। অথচ তাঁর রাজ্যে মহিলা চিকিৎসকের কার্যরত অবস্থায় মৃত্যুকে তিনি বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলেছিলেন। আয়োজক রাজ্যের প্রধান যোগী আদিত্যনাথ এই বিশাল কর্মকাণ্ডের আয়োজনে যে কর্মকুশলতা দেখিয়েছেন তার কোনও তুলনা চলে না। বিরোধীরা মৃত্যুর জন্য তাঁকেই দোষারোপ করেছেন। কিন্তু যোগী কি কাউকে নিমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন ? এই যজ্ঞের আয়োজন করতে অসমর্থ হলে আবার উলটে ওই বিরোধীরাই মেলা আয়োজনে সরকার ব্যর্থ বলে যোগীর পদত্যাগ চাইতেন। আরেক নেতা জিজ্ঞেস করলেন কুম্ভমেলার আয়োজন করে কি দেশ থেকে গরিবি হঠানো যাবে ? কেন বাপু, ৭০ বছর ধরে রাজত্ব করা তোমাদের দলের মুখ্য স্লোগানই তো ছিল - গরিবি হঠাও। প্রশ্ন উঠতেই পারে এতদিনেও গরিবিকে দূর করতে পারলেন না কেন তাঁরা ? নাকি এটাই ছিল তুরুপের তাস ? শুধুই নির্বাচন জেতার ফন্দি ?
এসব কথাবার্তার
ফাঁকেই দেখা গেল কিছু মানুষ ফেসবুকে কুম্ভমেলার বিরুদ্ধে ক্রমাগত বিষোদগার করে চলেছেন। বলছেন
নোংরা পরিবেশ, যত্রতত্র মলমূত্র, ইত্যাদির
মধ্যে সব অশিক্ষিত মূর্খ ধর্মোন্মাদ মানুষই নাকি পাগলের মতো ছুটছেন ডুব দিয়ে পাপমুক্ত
হতে। অথচ আমরা দেখেছি কত কত উচ্চশিক্ষিত, উচ্চপদে বহাল মানুষ এই মেলায় গিয়ে পবিত্র স্নান করছেন। সমালোচনা
যারা করছেন এদের মধ্যে অধিকাংশই কিন্তু ঘরে আরামকেদারায় বসে টিভি আর পেইড ভিডিও দেখে
এমন কথা বলছেন। কেউ সরেজমিনে যাননি। কেউ
কেউ আবার ইচ্ছে ছিল যদিও আরামে ব্যাঘাত হবে বলে সেই ইচ্ছা বিসর্জন দিয়ে নিন্দাবাদে
মত্ত হয়েছেন। দুঃখ হয় তখনই যখন দেখা যায় এই বিরাট হিন্দুধর্মীয়
সমাবেশের বিরোধিতায় কিন্তু একজন অহিন্দুকেও দেখা যায়নি। যুগ
যুগ ধরে নিজেদের পণ্ডিত বলে জাহির করে আসা, মিথ্যা তথ্য তুলে ধরে
জনগণকে বোকা বানিয়ে আসা কিছু রাজনৈতিক দলের মানুষেরা, স্বঘোষিত
সেক্যুলাররাই ইচ্ছাকৃত ভাবে এই কুৎসা রটাচ্ছেন শুধুমাত্র রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে। সরকার
পক্ষের এই বিরাট কৃতিত্ব ও সাফল্যের স্রোতে এদের যখন টিকে থাকাই দায় হয়ে পড়েছে তখন
এইসব মিথ্যাচার ছড়িয়ে তারা আত্মপ্রসাদ লাভে মত্ত হয়েছেন।
লক্ষ, কোটি মানুষের মধ্যে যখন আপনি যাবেন তখন একশোভাগ বিলাসিতার আশা কী করে করতে পারেন ? একটি শহরে এত লোকের ভিড় সামাল দিতে স্বভাবতই নানা রকম বাধানিষেধ আরোপিত হবে। এটাই স্বাভাবিক। এতে যদি আপনি বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন তাতে আপনারই দৈন্য প্রকট হয়ে ওঠে। অথচ কুম্ভমেলায় যোগদানকারী প্রতিটি মানুষ এসব সয়েছেন খোলা মনে। কারও কোনো অভিযোগ নেই। ঘরে টিভির সামনে বসে তো আর কুম্ভদর্শন কিংবা কুম্ভস্নান সম্ভবপর হয়ে উঠতে পারে না।
রাত দশটায় সময় মতোই আমাদের ট্রেন এসে পৌঁছে গেল গন্তব্যে। গাড়ি বলা ছিল আগেই। নেমে গাড়ি করে এসে কামাখ্যা মন্দিরের নীচে দাঁড়িয়ে মাকে প্রণাম জানিয়ে সবাই ফিরে এলাম ঘরে - এক অসাধ্য সাধন করে। আমরা কিংবা আমাদের পরবর্তী প্রজন্মই শুধু নয়, আজ থেকে পঞ্চাশ বছর পরেও জন্ম হবে যে শিশুর তার ভাগ্যেও এই মহাকুম্ভ যোগ ধরা দেবে না। তিন প্রজন্মে একবারই আসে এমন যোগ। নিজেকে তাই ক্ষণজন্মা লাগছিল। পাপ পুণ্যের বিচার যার যার তার তার, মহাকুম্ভে স্নান করে কতটা পাপশূন্য হয়েছি জানি না কিন্তু এই মহামানব মেলার অংশীদার হতে পেরে হৃদিমাঝে আমি অনুভব করেছি পরম্পরা আর ঐতিহ্যের বাহক আমি যেন ধন্য হয়েছি। জীবন একটাই। সার্থক জনম আমার। আমার দেশের হৃদস্পন্দন শুনেছি আমি। প্রত্যক্ষ করেছি ভারতবর্ষের প্রকৃত সনাতন রূপ। উপলব্ধি করেছি একটাই সত্য - যতই আমরা বিশেষ হতে চাই না কেন, শেষ কথা হচ্ছে এই ধুলোবালির মহামিলন যেখানে উচ্চনীচ নেই, নেই কোনো বিভেদ।
মানুষ হয়ে জন্ম নিয়ে শকুন কিংবা শূকরের মতো আচরণ করা মানায় না। যার যেমন আচরণ সেটা তাকেই মানায়। আপনি যতই শিক্ষিত হন না কেন নরনারায়ণের প্রকৃত রূপ পরিদর্শন করতে না পারলে আপনার সব শিক্ষাই বৃথা। তাই বৃথা আস্ফালন আর ছল চাতুরির পথ পরিহার করে প্রকৃত দেশপ্রেম আর ধর্মানুচার করাই হচ্ছে প্রকৃত শিক্ষিতের পরিচয়। কারণ কোনো ধর্মই কখনও মানুষকে বিপথে চলার পরামর্শ দেয় না। স্বামী বিবেকানন্দের লেখায় প্রকৃত ভারতবাসীর যে চিত্র অংকিত হয়েছে তারই চাক্ষুষ পরিদর্শনে এক অপার প্রাপ্তির সফর শেষে একটি কথাই বলা যায় - ‘ভারত আমার ভারতবর্ষ, স্বদেশ আমার স্বপ্ন গো। তোমাতে আমরা লভিয়া জনম ধন্য হয়েছি ধন্য গো।’
কোটি কোটি মানুষ, প্রায় অর্ধেক ভারতবাসী এবারের এই মেলায় উপস্থিত থেকে পবিত্র গঙ্গাস্নানের মাধ্যমে এক অবিস্মরণীয় আধ্যাত্মিক পরিতৃপ্তি লাভ করতে পেরেছেন। কুম্ভমেলা মধ্যযুগ থেকেই রাজসাহায্য লাভে সমর্থ হয়েছিল। মৌর্য ও গুপ্ত সাম্রাজ্যের রাজারা মেলার ব্যবস্থাপনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতেন। এই সময়েই নানা আখড়া প্রতিষ্ঠিত হয় যা আজও কুম্ভমেলার অন্যতম আকর্ষণ। দিনকাল পালটেছে। যুগধর্মের নানা পরিবর্তন ঘটেছে। বিশ্বের সাথে ভারতেও জনসংখ্যা বাড়ছে, বেড়েছে অকল্পনীয় ভাবে। এসবের প্রতি লক্ষ রেখে বর্তমান সরকার এই মেলাকে আধ্যাত্মিক আয়োজনের পাশাপাশি ব্যবসায়িক দৃষ্টিকোণ থেকেও বিশ্লেষণ করেছেন। ফলত এই মেলার মাধ্যমে সরকারি কোষাগারে জমা পড়েছে এক বিশাল পরিমাণ অর্থ যা আবার জনগণের কল্যাণেই ব্যয় করা হবে। দেশ, রাজ্য তথা আয়োজক শহরের অর্থনীতিতে পড়েছে সদর্থক প্রভাব যা সহজেই অনুভব করা যায়।
###
কুম্ভমেলায় গঙ্গাস্নানের একটি সুপ্ত ইচ্ছে ছিল বহু দিনের। এবারের কুম্ভে সেই ‘মহাকুম্ভ’ শব্দটি কিংবা ‘১৪৪ বছর’-এর সাংখ্যিক নস্টালজিয়া তীব্র হয়ে দেখা দিল মেলা আয়োজনের বলতে গেলে শেষের দিকেই। মেলা শুরু হয়ে যাওয়ার পরও যাওয়ার ব্যাপারে কোনও সিদ্ধান্ত হয়নি। আচমকাই সুপ্ত ইচ্ছেটি যেন তীব্রভাবে প্রকট হয়ে উঠল। আমাদের তিনজনের সংসার। গৃহিণী আদ্যোপান্ত ধর্মপ্রাণা। স্বভাবতই একটি পা তাঁর বাড়ানোই ছিল যদিও এ নিয়ে কিছু বলার সাহস করে উঠতে পারেননি সম্ভবত বাকি দুজনের আধ্যাত্মিকতা থেকে সতত দূরে থাকার স্বভাবটির জন্যই। ভেতরে ভেতরে হয়তো কামনা করছিলেন যে আমাদের বাকি দুই ‘মনিষ্যি’র যেন কিছু সুমতি হয়। তাঁর সেই প্রার্থনার ফলেই কিনা জানি না হঠাৎ একটি চিন্তার উদ্রেক হল মনের মধ্যে। চারদিক থেকে এত লোক যাচ্ছে এই মহামানবমেলায় আর আমরা পাপীতাপীর মতো ঘরে বসে রইব ? না হয় তাই রইলাম। আমার তো তেমন চিন্তাভাবনাও নেই কিন্তু একটি সন্তান যে আমার রয়েছে। ইতিমধ্যেই আমরা শতাব্দীর অন্যতম একটি যুগান্তকারী ঘটনা (পড়ুন দুর্ঘটনা)র সম্মুখীন হয়েছি। কোভিড অতিমারি। এবার আবার সম্মুখীন হয়েছি আরেকটি ঘটনার যার পুনরাগমন ঘটবে ১৪৪ বছর পর। আমি নাহয় নাই গেলাম সেই মহাকুম্ভে কিন্তু পাশাপাশি আমার সন্তানেরও তো যাওয়া হবে না। হয়তো এ নিয়ে ওর শেষ জীবনে জবাবদিহি করতে হতে পারে ওর সন্তান-সন্ততি কিংবা তৃতীয় প্রজন্মের কাছে। এবং স্বাভাবিক ভাবেই দোষের দায়ভার এসে বর্ষিত হবে আমার উপর। সুতরাং সেই দায়ভার মুক্ত হতে সিদ্ধান্ত নিলাম আমরাও যাবে।
মা-মেয়ের খুশি আর ধরে না। নিমেষেই সঙ্গীও জুটে গেল যাঁরা মনে মনে তৈরিই ছিলেন। আমার বউদি এবং মিসেসের বউদি। টায় টায় সমান হয়ে গেল টিম। সঙ্গী তো জুটল কিন্তু টিকেট কোথায় ? রেলে, বিমানে টিকেটের হাহাকার। ত্রাতা হয়ে দেখা দিল আমার ভ্রাতুষ্পুত্র পল। ওর বন্ধু থাকে প্রয়াগরাজ। যোগাযোগ করল বন্ধুর সঙ্গে। থাকার জায়গা নিয়ে নিশ্চিন্ত হওয়া গেল। কিন্তু সরাসরি প্রয়াগরাজ বা তার আশেপাশে থাকা কোন জায়গার টিকেটই পাওয়া যাচ্ছিল না। শেষ পর্যন্ত একটু ঘুরিয়ে কাটতে হল টিকেট। যাওয়ার পথে বেনারস অবধি এবং ফেরার টিকেট হল পাটনা থেকে।
সেই হিসেবে ১৪ জানুয়ারি ভোর সাড়ে চারটায় পাঁচজন মিলে বেরিয়ে পড়লাম ব্যোম ভোলানাথ বলে। মনের মধ্যে একাধারে অধ্যাত্মচিন্তা ও ভ্রমণসুখের সমাহার। তিনজন মহিলা যাত্রী মিলে একগাদা খাদ্যদ্রব্য নিয়েছেন সাথে। মনে পড়ল একটি কথা। আগেকার দিনে সাধারণ মানুষেরা শুধুমাত্র চিড়ে-গুড় সম্বল করে বেরিয়ে পড়তেন তীর্থ ভ্রমণে। রেলের সাধারণ কামরায় ওই খেয়ে পুণ্যার্জন করে ফিরে আসতেন এক বুক প্রশান্তি নিয়ে। আমরা এখন আধুনিক হয়েছি, আমাদের চাহিদা অপার। তবু এই যে বেরিয়েছি এক মহাতীর্থের উদ্দেশে সেও বা কম কীসে ?
###
রাত দেড়টায় অর্থাৎ ১৫ তারিখ আমরা পৌঁছে গেলাম বেনারস স্টেশনে। ট্রেন থেকে নেমে দেখি গোটা স্টেশন চত্বর লোকে লোকারণ্য। দিন রাত একাকার হয়ে গেছে। স্টেশনের বাইরেও মাটিতে কম্বল পেতে শুয়ে বসে রয়েছেন অগুনতি মানুষ। বুঝে গেলাম এই শুরু আমাদের সংগ্রাম। ঘণ্টাদুয়েক ওখানে কাটিয়ে রাত তিনটেয় একটি ভাড়া গাড়ি করে রওনা হলাম প্রয়াগরাজের উদ্দেশে। সারা রাস্তায় সারি সারি গাড়ি। রাস্তার পাশের অধিকাংশ চায়ের দোকান, ধাবাই খোলা। বোঝা গেল রাজ্য জুড়েই চলছে এক উৎসব। পাশাপাশি সচল অর্থনীতির উৎকৃষ্ট উদাহরণ। তখন সকাল প্রায় ন’টা। প্রয়াগরাজ শহর এলাকার প্রায় পনেরো কিলোমিটার আগে থামিয়ে দেওয়া হল আমাদের গাড়ি। ওখান থেকে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে গাড়িঘোড়ার প্রবেশ। অগত্যা লটবহর নিয়ে নেমে পড়তেই হল। একজন অটোওয়ালার সঙ্গে কথা বলে উঠে পড়লাম অটোয়। গঙ্গার উপর সেতু ধরে চলাচল করতে দেওয়া হচ্ছে না কোনও গাড়ি। সুতরাং অটোওয়ালা আমাদের নামিয়ে দিল সেতু থেকে প্রায় আধা কিলোমিটার আগে। অটো থামিয়ে নিজেই সব থেকে বড় লাগেজটি হাতে করে প্রায় দুইশো মিটার জায়গা হেঁটে আমাদের নিয়ে দাঁড় করালো সেখানে যেখান থেকে বাইক সার্ভিস পাওয়া যায় সেতু পেরোনোর জন্য। সবাই আমরা জিনিসপত্র ভাগ করে নিয়ে বাইকে করেই পেরোলাম সেতু। সে এক বিরল অভিজ্ঞতা। মানুষের ঢল চলছে সেতুর ওপারে যেখানে রয়েছে সংগম ঘাট। সেতুর ওপারে ‘চুঙ্গি চক’ বলে একটি জায়গায় এসে বাইকওয়ালারা বিদায় নিল। আমরা সেখান থেকে একটি ই-রিকশা করে এসে পৌঁছে গেলাম নির্ধারিত হোটেলে। ইতিমধ্যেই হোটেলে পৌঁছে গেছে ভ্রাতুষ্পুত্র পলের বন্ধু সাগর। ততক্ষণে বেলা অনেকটাই হয়ে গেছে। রাস্তায় দেখেছি মাইলের পর মাইল মানুষের যাওয়া আসার সারি। সফরক্লান্ত আমাদের আর সেদিন বেরনোর মতো শরীর বা মনের জোর ছিল না। খেয়েদেয়ে কিছুটা বিশ্রাম শেষে সন্ধ্যা হওয়ার আগে বেরিয়ে পড়লাম খানিক আশেপাশের দুয়েকটি জায়গায়। আমাদের হোটেলটি ছিল শহরের অশোক নগর এলাকায় বাবা চৌরাহার পাশে। আমরা এক এক করে গেলাম সাঁই মন্দির এবং সিভিল লাইনের হনুমান মন্দিরে। হনুমান মন্দিরের বিশাল চত্বর জুড়ে রয়েছে আলাদা আলাদা ভাবে রাম-সীতা-লক্ষণ এবং ১৪টি শিবলিঙ্গযুক্ত শিবমন্দির। টুকিটাকি কিছু কেনাকাটাও সেরে নিলেন মহিলামণ্ডল। সন্ধ্যায় বাবা চৌরাহায় অবস্থিত বিশাল মিষ্টির দোকান ও রেস্টুরেন্টে সামান্য খাওয়াদাওয়া সেরে ফিরে এলাম হোটেলে কারণ শেষরাত সাড়ে চারটেতে আমাদের বেরিয়ে যাওয়ার কথা ঘাটের উদ্দেশে।
###
রাত সাড়ে তিনিটাতে উঠে ফ্রেশ হতে না হতেই আগে থেকে বলে রাখা গাড়ির ড্রাইভারের ফোন এসে গেল - সাব, আ গয়া হু ম্যাঁয়। ঘড়িতে প্রায় সাড়ে চারটা। বেরিয়ে পড়লাম সবাই মিলে। বাইরে তখনও অন্ধকার। এটাই স্বাভাবিক। পথে যেতে যেতে দেখলাম - পথ হাঁটছে অনেক মানুষ - গন্তব্য মেলা পরিসর। প্রায় তিরিশ মিনিট গাড়ি চালিয়ে এক জায়গায় এসে দেখা গেল পার্কিং। ড্রাইভার জানালো আর যাওয়া যাবে না। পুলিশ নিয়ন্ত্রণ করছে গাড়ি ও মানুষ। দিন রাত তাদের ডিউটি। কত যে গাড়ি, কত মানুষ। এরা পৌঁছে গেছে আমাদের আগেই। গাড়ি থেকে নেমে শুরু হল আমাদের হাঁটা। মানুষের ভিড়ে এবং আমাদের মধ্যে কারও কারও হাঁটুর সমস্যা থাকায় আমরা এগোতে থাকলাম ধীরে ধীরে। যতই যাচ্ছি দেখছি অন্যান্য দিক থেকেও দলে দলে আসছে মানুষ। মানুষের এমন মহামেলা আগে দেখিনি কখনও। একদিকে সারি সারি টয়লেট দেখতে পেলাম অসংখ্য। এই শেষরাতেও সাফাইকর্মীরা জল দিয়ে ধুয়ে মুছে পরিচ্ছন্ন করছেন এগুলো। দু’ঘণ্টায় প্রায় তিন কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে আমরা পৌঁছে গেলাম সংগম ঘাটের কিনারে। তিল ধারণের স্থান নেই সেখানে। অগণিত মানুষ নিজেদের সঙ্গে নিয়ে যাওয়া প্লাস্টিকের মাদুর বিছিয়ে কাপড় বদলে স্নানের জন্য তৈরি হচ্ছেন। বাচ্চা থেকে বুড়ো, স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে মানুষ শুধু মানুষ। ততক্ষণে গঙ্গা নদীর ওপারে সোনালি আলো ছড়াচ্ছে ভোরের সূর্য। নদীর জলে তার প্রতিচ্ছায়া। এক স্বর্গীয় দৃশ্য।
আমি কাপড় বদলালেও বাকিরা স্নানের পোশাক পরেই এসেছিল। আমরা দুই ভাগে স্নানের জন্য গিয়ে নদীতে নামলাম। কেউ রইলেন ছাড়া কাপড় পাহারা দিতে, কেউ মোবাইল হাতে স্নানের দৃশ্য ক্যামেরাবন্দি করতে। মহিলারা স্নান সেরে পাশেই থাকা সারি সারি চেঞ্জ রুমের একটিতে ঢুকে কাপড় বদলে বেরিয়ে এলেন। ভিড় বাড়ছে ক্রমাগত। চারদিকে পুলিশের ছয়লাপ। রয়েছে জলরক্ষী বাহিনী - স্নানের জায়গাটা ঘিরে। অগণিত মানুষ ডুব দিচ্ছে সংগমের পবিত্র জলে। যেন জলকেলি উৎসবে মেতেছে গোটা ভারতবর্ষ। স্নান ও সূর্যপ্রণাম সেরে আমি সবেমাত্র কাপড় বদলেছি অমনি এক ব্যক্তি, বোঝাই যাচ্ছে সদ্য স্নান সেরে উঠেছেন, বললেন - ভাইয়া (দাদা), আমার ছোটভাইকে খুঁজে পাচ্ছি না। আপনার ফোন থেকে একটা কল করতে পারি ? আমি মুহূর্তের জন্য দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়লেও পরক্ষণেই ভাবলাম এই সময়ে কারও কাজে লাগতে পারাটা তো পুণ্যের। এই জায়গাটি তো আমাদের বাহ্যিক পৃথিবীর মতো এত কলুষিত নয়। আমি তাঁকে নাম্বার জিজ্ঞেস করে রিং হতেই তাঁর হাতে দিলাম মোবাইল। কথা হল। ছোটভাই কোথায় আছে জানাল। ভদ্রলোক আমাকে ধন্যবাদ জানিয়ে আরও কিছু কথা বলে বিদায় নিলেন। খানিক পরেই অপরিচিত নম্বর থেকে ফোন এল - দু’ভাইয়ের মিলন হয়েছে। ওরা রাজস্থানের। আমরা অসমের শুনে অনেকটাই অবাক হল। একটি প্রশ্ন মাথায় এল - ভদ্রলোক যেভাবে ভাইয়ের নাম্বারটি আমাকে মুখস্থ বলে দিলেন তা আজকের দিনে ক’জন পারে ?
যাইহোক এইসব চলতে থাকার মধ্যেই দেখা গেল দক্ষিণ ভারত থেকে আগত এক অতি সম্ভ্রান্ত পরিবারের জ্যেষ্ঠতম মহিলা সদস্যটি অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। আমার সহধর্মিণী এসব ব্যাপারে খানিকটা পারঙ্গত হওয়ার সুবাদে ছুটে গিয়ে তাঁর প্রাথমিক পরিচর্যায় যোগদান করলেন। কী ভাষায় কথা হল জানি না তবে জানা গেল তিনি হার্টের রোগী এবং বলা সত্ত্বেও অদম্য মনোবল নিয়ে ছুটে এসেছেন মানুষের এই মহামেলায়। ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠলেন তিনি। এবার আমাদের ফেরার পালা। গোটা এলাকা জুড়ে ইস্পাদের শক্ত ধাতব পাত বিছিয়ে রাখা হয়েছে। তাই এত ভিড়েও চলতে কোনও অসুবিধা হচ্ছিল না। তবে ততক্ষণে খানিকটা ক্লান্তি এসে যেন আচ্ছন্ন করছিল আমাদের। মানুষের ভিড় থেকে সরে এসে চায়ের দোকানে চা পান করে তা অনেকটাই কাটিয়ে ওঠা গেল।
আমরা যেদিক থেকে এসেছিলাম সেদিকে ফেরার রাস্তা নেই। সুতরাং অন্য রাস্তায় ফিরতে হল। ফলে হাঁটতে হল অনেক বেশি। ড্রাইভারকে ফোন করে বলে দিলাম হোটেলে ফিরে যেতে কারণ আমাদের ফেরার রাস্তায় নো এন্ট্রি। কম হলেও সাত কিলোমিটার হেঁটে আবার সেই চুঙ্গি চক এসে আবার ই-রিকশা নিয়ে আমরা ফিরে এলাম হোটেলে। দুপুর হয়ে গিয়েছিল। তাই হাত পা ধুয়ে সামান্য ফ্রেশ হয়েই আমরা কাছেই থাকা হোটেলে সেরে নিলাম দুপুরের খাওয়া। কিছু প্রশ্ন মাথায় ঘুরছিল আমার। এই যে এত লোক স্নান করছে একই জায়গায়, সেখানে স্নান করে এসে, কোথায় আমাদের শরীরে তো সামান্য চুলকানি কিংবা কাদায় সাদা হয়ে যাওয়া দাগও পড়েনি। এই যে দুর্বল পা নিয়ে এতটা পথ পাড়ি দেওয়া হল, কোথায় পথশ্রমের ক্লান্তি তো তেমন অনুভূত হল না। এর উত্তর খোঁজায় দায় তোলা রইল পাঠকের জন্য।
এদিন রাত নটায় আমাদের বাস ছিল প্রয়াগরাজ থেকে পাটনার উদ্দেশে। বাস কোম্পানি থেকে জানালো যে ভিড়ের জন্য নির্ধারিত জায়গার বদলে বাস ছাড়বে প্রায় চল্লিশ কিলোমিটার দূর একটি জায়গা থেকে। আমাদের ড্রাইভার বলল ট্র্যাফিক জ্যামের জন্য এই চল্লিশ কিলোমটার যেতে পাঁচ থেকে ছয় ঘণ্টাও লেগে যেতে পারে। আমরা রিস্ক না নিয়ে তাই বিকেল সাড়ে তিনটেয় বেরিয়ে এলাম হোটেল থেকে। পথে অভাবনীয় জ্যাম। গ্রামের মধ্য দিয়ে নতুন কাঁচা রাস্তা ধরে এগোতে এগোতে দেখলাম গঙ্গার অন্য তটে নতুন অনেকগুলো ঘাট খোলা হয়েছে। স্বভাবতই গাড়ি ও মানুষের প্রচণ্ড ভিড়। একের পর এক গাড়ি আসছে দেশের নানা প্রান্ত থেকে। সত্যিই আমাদের পাঁচ ঘণ্টা লেগে গেল বাস ধরতে। সারা দিনের ধকল শেষে উঠে বসলাম বাসে।
সারা রাতই হাইওয়ে জুড়ে গাড়ির লাইন দেখা গেল। দাঁড়িয়ে রয়েছে। পরদিন সকালের পরিবর্তে দুপুর দুটোয় গিয়ে আমরা পাটনা পৌঁছলাম। আমাদের গাড়ি ছিল রাত সাড়ে এগারোটায়। সুতরাং আমরা রাজেন্দ্রনগর টার্মিনাল স্টেশনের উলটো দিকে একটি হোটেলে এসে উঠলাম। দুপুরের খাওয়াদাওয়া সেরে এবং রাতের জন্য রুটি-সবজি নিয়ে স্টেশনে এসে গেলাম রাত সাড়ে দশটা নাগাদ। এত দূরে পাটনা স্টেশনেও যে এভাবে ভিড়ের মধ্যে পড়ব তা ভাবনায়ও আসেনি কারও। ট্রেন প্ল্যাটফর্মে আসতেই মানুষের হুটোপাটিতে ট্রেনে ওঠা খুবই কষ্টকর হয়ে পড়েছিল। তবু আমাদের নির্ধারিত কামরায় উঠে দেখলাম আমাদের আসন যথারীতি ফাঁকাই আছে। গুছিয়ে বসে রাতের খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম সবাই। প্ল্যাটফর্মে পুলিশ এবং গাড়িতে টিকিট পরীক্ষকদের ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য। দেড়মাসব্যাপী এই সমাগমকে নিয়ন্ত্রণ করেছেন এইসব সরকারি কর্তারা। তাঁরা কিন্তু সাধুবাদের প্রাপ্য।
পরদিন রাতে আমাদের পৌঁছানোর কথা। ট্রেন প্রতিটি স্টেশনে নির্ধারিত সময়েই এসে পৌঁছোচ্ছে। আমরা নিজেদের মধ্যে গল্পগুজবে মত্ত। ভাবছিলাম এত সুসংহত জনসমাগমে পদপিষ্ট হয়ে মৃত্যুর দুর্ঘটনাটি ঘটল কী করে। বড়ই দুঃখজনক এই ঘটনা। বলতেই হবে এই একটি ঘটনা যেন অনেকটাই ম্লান করে দিয়েছে মহাকুম্ভের গরিমা। আবার অন্যদিকে চিন্তা করলে দেখা যায় ধর্মীয় সমাগমে এমন ঘটনা কিন্তু বিরল নয়। ফি বছর সরকারি সাবিসিডি পেয়ে যাওয়া হজযাত্রীদের মধ্যেও এমন ঘটনা ঘটে থাকে প্রায় প্রতি বছর। সম্প্রতি জানা গেছে এদেশেও নেহরুজি প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন কুম্ভমেলায় সংঘটিত এমন এক ঘটনায় প্রায় পাঁচশোজন যাত্রী নাকি পদপিষ্ট হয়ে নিহত হয়েছিলেন। সব মৃত্যুই এক একটি দুর্ঘটনা এবং দুঃখজনক। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক মৃত্যু নিয়েও যে কত নোংরা রাজনীতি এদেশে চলে তাও প্রকাশ্যে এল। একটি রাজনৈতিক দলের নেতা তো এবারের কুম্ভকে মৃত্যুকুম্ভ নামেও অভিহিত করলেন। অথচ তাঁর রাজ্যে মহিলা চিকিৎসকের কার্যরত অবস্থায় মৃত্যুকে তিনি বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলেছিলেন। আয়োজক রাজ্যের প্রধান যোগী আদিত্যনাথ এই বিশাল কর্মকাণ্ডের আয়োজনে যে কর্মকুশলতা দেখিয়েছেন তার কোনও তুলনা চলে না। বিরোধীরা মৃত্যুর জন্য তাঁকেই দোষারোপ করেছেন। কিন্তু যোগী কি কাউকে নিমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন ? এই যজ্ঞের আয়োজন করতে অসমর্থ হলে আবার উলটে ওই বিরোধীরাই মেলা আয়োজনে সরকার ব্যর্থ বলে যোগীর পদত্যাগ চাইতেন। আরেক নেতা জিজ্ঞেস করলেন কুম্ভমেলার আয়োজন করে কি দেশ থেকে গরিবি হঠানো যাবে ? কেন বাপু, ৭০ বছর ধরে রাজত্ব করা তোমাদের দলের মুখ্য স্লোগানই তো ছিল - গরিবি হঠাও। প্রশ্ন উঠতেই পারে এতদিনেও গরিবিকে দূর করতে পারলেন না কেন তাঁরা ? নাকি এটাই ছিল তুরুপের তাস ? শুধুই নির্বাচন জেতার ফন্দি ?
লক্ষ, কোটি মানুষের মধ্যে যখন আপনি যাবেন তখন একশোভাগ বিলাসিতার আশা কী করে করতে পারেন ? একটি শহরে এত লোকের ভিড় সামাল দিতে স্বভাবতই নানা রকম বাধানিষেধ আরোপিত হবে। এটাই স্বাভাবিক। এতে যদি আপনি বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন তাতে আপনারই দৈন্য প্রকট হয়ে ওঠে। অথচ কুম্ভমেলায় যোগদানকারী প্রতিটি মানুষ এসব সয়েছেন খোলা মনে। কারও কোনো অভিযোগ নেই। ঘরে টিভির সামনে বসে তো আর কুম্ভদর্শন কিংবা কুম্ভস্নান সম্ভবপর হয়ে উঠতে পারে না।
রাত দশটায় সময় মতোই আমাদের ট্রেন এসে পৌঁছে গেল গন্তব্যে। গাড়ি বলা ছিল আগেই। নেমে গাড়ি করে এসে কামাখ্যা মন্দিরের নীচে দাঁড়িয়ে মাকে প্রণাম জানিয়ে সবাই ফিরে এলাম ঘরে - এক অসাধ্য সাধন করে। আমরা কিংবা আমাদের পরবর্তী প্রজন্মই শুধু নয়, আজ থেকে পঞ্চাশ বছর পরেও জন্ম হবে যে শিশুর তার ভাগ্যেও এই মহাকুম্ভ যোগ ধরা দেবে না। তিন প্রজন্মে একবারই আসে এমন যোগ। নিজেকে তাই ক্ষণজন্মা লাগছিল। পাপ পুণ্যের বিচার যার যার তার তার, মহাকুম্ভে স্নান করে কতটা পাপশূন্য হয়েছি জানি না কিন্তু এই মহামানব মেলার অংশীদার হতে পেরে হৃদিমাঝে আমি অনুভব করেছি পরম্পরা আর ঐতিহ্যের বাহক আমি যেন ধন্য হয়েছি। জীবন একটাই। সার্থক জনম আমার। আমার দেশের হৃদস্পন্দন শুনেছি আমি। প্রত্যক্ষ করেছি ভারতবর্ষের প্রকৃত সনাতন রূপ। উপলব্ধি করেছি একটাই সত্য - যতই আমরা বিশেষ হতে চাই না কেন, শেষ কথা হচ্ছে এই ধুলোবালির মহামিলন যেখানে উচ্চনীচ নেই, নেই কোনো বিভেদ।
মানুষ হয়ে জন্ম নিয়ে শকুন কিংবা শূকরের মতো আচরণ করা মানায় না। যার যেমন আচরণ সেটা তাকেই মানায়। আপনি যতই শিক্ষিত হন না কেন নরনারায়ণের প্রকৃত রূপ পরিদর্শন করতে না পারলে আপনার সব শিক্ষাই বৃথা। তাই বৃথা আস্ফালন আর ছল চাতুরির পথ পরিহার করে প্রকৃত দেশপ্রেম আর ধর্মানুচার করাই হচ্ছে প্রকৃত শিক্ষিতের পরিচয়। কারণ কোনো ধর্মই কখনও মানুষকে বিপথে চলার পরামর্শ দেয় না। স্বামী বিবেকানন্দের লেখায় প্রকৃত ভারতবাসীর যে চিত্র অংকিত হয়েছে তারই চাক্ষুষ পরিদর্শনে এক অপার প্রাপ্তির সফর শেষে একটি কথাই বলা যায় - ‘ভারত আমার ভারতবর্ষ, স্বদেশ আমার স্বপ্ন গো। তোমাতে আমরা লভিয়া জনম ধন্য হয়েছি ধন্য গো।’
বিদ্যুৎ
চক্রবর্তী
সুন্দর তথ্য সম্বলিত প্রতিবেদন!
ReplyDeleteধন্যবাদ
Delete