Skip to main content

ব্যতিক্রমী ধারার ‘তিন ডজন পদ্য’


পদ্য, কবিতা ও ছড়ার সংজ্ঞার মধ্যে একটি সুনির্দিষ্ট পার্থক্য রয়েছে যদিও তার যথার্থ শ্রেণিবিভাজন খানিকটা জটিল বইকী। একটি ছন্দবদ্ধ রচনা একটি পদ্য তো বটেই কিন্তু তার উপর এটি হতে পারে একটি কবিতাও এবং একটি ছড়াও। আধুনিক কবিতা আবার হতে পারে ছন্দহীনও যদিও ছন্দহীন রচনামাত্রেই যে তা কবিতা হয়ে উঠবে তাও নয়। ছড়া যে শুধু ছোটদের জন্যই হতে হবে তারও কোনো মানে নেই। সুতরাং বলাই যেতে পারে যে একটি ছন্দবদ্ধ রচনাকে আদৌ কোন শ্রেণিতে বিন্যস্ত করা যায় কিংবা তা কতটা কবিতা হয়ে উঠল তা ভিন্ন মানসে ভিন্নরূপে আখ্যায়িত হওয়ার সমূহ একটি সম্ভাবনা থেকেই যেতে পারে। সব মিলিয়ে এই শ্রেণিবিভাজনের দায় তাই কবি, ছড়াকার, বাচিক শিল্পী এবং পাঠকের হাতেই সঁপে দেওয়া শ্রেয়।
মূলত একজন গদ্যকার বিশেষ করে প্রাবন্ধিক ত্রিদেব চৌধুরীর কবি হিসেবে সদ্য প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ‘তিন ডজন পদ্য’তে এ নিয়ে এবং নিজেকে নিয়ে একটি পরিচ্ছন্ন স্বকৃত ভূমিকা রয়েছে। এখানে আছে - ‘...কবিতা আমার আসে না। কাব্যগুণের ধার ধারি না। এককালে ছন্দ নিয়ে কিঞ্চিৎ নাড়াচাড়া করেছিলাম। এগুলো তারই ফসল। আধুনিক কবিতা ছন্দ বা অন্ত্যমিলের ধার ধারে না এরকম একটা ধারণা হয়তো অনেকের মধ্যেই আছে। সুতরাং সংজ্ঞামাফিক এগুলোকে আর যাই বলুন কবিতা নিঃসন্দেহে নলা চলে না। বলা যায় না...। ছড়া বলুন, পদ্য বলুন আর কবিতাই বলুন - বাচিক শিল্পীদের কণ্ঠেই এদের বাস; কাগজের পাতায় নয়...। স্বরলিপি দেখে যেমন গানের রূপ বোঝা যায় না তেমনি কাগজে লেখা ছড়া কবিতা তো ধ্বনির বাণীলিপি মাত্র। একটা সংকেত শুধু। তার বেশি কিছু নয়...।’ এবং সেই হিসেবেই গ্রন্থকার তাঁর এই কাব্যগ্রন্থের কবিতা/ছড়াসমূহকে ‘ছোট বড় সবার আবৃত্তিযোগ্য’ বলে অভিহিত করেছেন। অর্থাৎ তাঁর লেখা শুধুমাত্র আবৃত্তিযোগ্য তিন ডজন কবিতারই সমাহার আলোচ্য কাব্যগ্রন্থটি।
সেক্ষেত্রে একটি কাব্যগ্রন্থের আলোচনা করতে সক্ষম শুধু বাচিক শিল্পীরাই। এমন একটা ধারণার সৃষ্টি হতে পারে। আসলে তা নয়। কবিতা দুরকমই হতে পারে। মঞ্চে আবৃত্তিযোগ্য কিংবা আবৃত্তি-অযোগ্য। কিন্তু একটি ছন্দবদ্ধ রচনা কতটা কবিতা হয়ে উঠতে পেরেছে তার মূল্যায়ন কিন্তু কাগজে দেখে, পাঠ করে, হৃদয়ঙ্গম করেই নির্ণয় করতে সক্ষম একজন বোদ্ধা পাঠক কিংবা আলোচক। রচনায় কাব্যময়তার উপস্থিতি এক্ষেত্রে অপরিহার্য। বোধের তারতম্য ভিন্নজনের ক্ষেত্রে ভিন্নতর ভাবে প্রকট হতেই পারে তবে সার্বিক ভাবে একটি কবিতার সার্থক হয়ে ওঠা কিন্তু নির্ভর করে একজন নিবিষ্ট পাঠকের উপরই।
আলোচ্য গ্রন্থের অভ্যন্তরে প্রবেশ করলে যে কবিতা, লিমেরিক, ছড়া ইত্যাদির সঙ্গে পাঠকের পরিচয় ঘটবে সেসবের ক্ষেত্রেও উপর্যুক্ত কথাগুলোর এক সমঞ্জস কিন্তু খুঁজে পাওয়া যায়। গ্রন্থে সন্নিবিষ্ট হয়েছে মোট ৩৬টি পদ্য যার অধিকাংশই ছড়ার আঙ্গিকে সীমিত পরিসরে ছন্দবদ্ধ সব রচনা। রয়েছে পৃষ্ঠা পেরোনো কিছু রচনাও। ‘এককালে ছন্দ নিয়ে কিঞ্চিৎ নাড়াচাড়া’র সুবাদে স্বর ও মাত্রার যথাযথ প্রয়োগে প্রতিটি রচনা হয়ে উঠেছে সুখপঠনের এক একটি পদ্য। সুচয়িত শব্দের সামঞ্জস্য একদিকে যেমন রচনাগুলিকে করে তুলেছে সুখপাঠ্য তেমনি নির্ণীত হয়েছে প্রাসঙ্গিকতা।
গ্রন্থে একাধারে সন্নিবিষ্ট হয়েছে একাধিক ছড়া, কবিতা ও লিমেরিক। লিমেরিককে আবার বর্ধিত আকারেও উপস্থাপন করেছেন কবি। হয়তো এও এক পরীক্ষানিরীক্ষা। ছড়ার প্রাথমিক শর্তই হচ্ছে অন্ত্যমিল। সেই ধারা একশো ভাগ বজায় রেখে অধিকাংশ ছড়াই ছোটদের উপযোগী হিসেবে উপস্থাপিত হয়েছে। সঙ্গে স্বরবৃত্ত ছন্দের উৎকৃষ্ট উদাহরণ। শব্দ চয়নে, স্বরের সামঞ্জস্য এনে দিয়েছে এক অনাবিল পঠনসুখ -
কাটা কুটি বসে বসে একমনে খেলে
কুটি খুব ভালো মেয়ে, কাটা ভালো ছেলে।
কুটি আঁকে ক্রস আর কাটা আঁকে গোল
কুটি খায় মোমো আর কাটা খায় রোল।
দুই ভাই বোন পড়ে ইংলিশ স্কুলে
সব ভাষা শেখে তারা বাংলাকে ভুলে।
ডগিকে শেখায় তারা ‘কাম, ‘সিট’, ‘গো’
কাটাকুটি নয় - খেলে টিক ট্যাক টো।
(ছড়া - কাটাকুটি)
এমনি স্বরে ও অন্ত্যমিলে রয়েছে একাধিক অর্থপূর্ণ তথা শিক্ষামূলক ও শ্লেষাত্মক কবিতা ও ছড়া। ছন্দ, মাত্রা বজায় থাকলেও অনর্থক কিংবা নিরর্থক সৃষ্টির তো কোনো প্রাসঙ্গিকতা থাকে না। ছড়া হবে আর ভূত থাকবে না এমন তো হতে পারে না। তাই রয়েছে একাধিক কবিতা। একের থেকে আরেক উৎকৃষ্ট। এইসব ধারার কবিতা ‘আমি এক কবি’, ‘প্যাঁচা ও সরস্বতী’, ‘দুখানা ভূতের লিমেরিক’, ‘অদ্ভুতুড়ে’, ‘ব্যাপারটা অদ্ভুত’ ইত্যাদি। রয়েছে একাধিক সরেস রচনা। বহুবিধ প্রসঙ্গ ও বিষয়ের উপর লেখা পদ্য।
কবির সন্দেহ থাকলেও পাঠান্তে কয়েকটি কবিতারও সন্ধান কিন্তু খুঁজে পাওয়া যায় গ্রন্থে। উল্লেখযোগ্য - ‘কবির স্বপ্ন’, ‘একটি অসম্ভব রূপকথা’, ‘আষাঢ় মাসে’, ‘ঘর কই তোর’ ইত্যাদি। প্রথাগত ছন্দের জায়গায় অন্তর্নিহিত ছন্দের দোলায় মূর্ত হয়েছে কবিতা। বানান তথা ছন্দের ধারণা ও ব্যবহার অনেকের কাছেই দুর্বোধ্য কিংবা জটিল। সেক্ষেত্রে ছন্দের বিরোধিতা করতে দেখা যায় অনেককেই। এ নিয়ে প্রাসঙ্গিক কিছু লাইন খুঁজে পাওয়া গেল কবির কবিতায় -
‘...বানান ফানান নিয়ে ভাবছি না ভাই
অতটা সময় বল কোনখানে পাই ?
বলি বটে তেজি ঘাড়, ‘ছন্দকে মানি না’
ভেতরে ভয়ের কাঁটা, ‘ছন্দ তো জানি না।...’
(কবিতা - আমি এক কবি)।
সব মিলিয়ে ৮৭ পৃষ্ঠার এই গ্রন্থে ৩৬টি পদ্যের বাইরে আর যা রয়েছে তা হল প্রতি পৃষ্ঠায় অসাধারণ, অনবদ্য সব প্রাসঙ্গিক সাদা-কালো ছবি। হার্ড-বোর্ড বাঁধাই গ্রন্থের নান্দনিক প্রচ্ছদের সৌজন্যে কবি নিজেই যদিও অঙ্কন ও প্রচ্ছদ পরিকল্পনায় সাহায্য নেওয়া হয়েছে আন্তর্জাল/এ আই-এর। শেষ ব্লার্বে রয়েছে কবির সচিত্র সংক্ষিপ্ত পরিচিতি। স্পষ্ট ছাপা, যথাযথ শব্দবিন্যাস। আধুনিক বানান অনুসৃত হলেও ফাঁক গলে কিছু পুরোনো বানান রয়েই গেছে। গ্রন্থটি উৎসর্গ করা হয়েছে কবির প্রয়াত মা, বাবা ও বাংলা ভাষার শহিদদের উদ্দেশে। সব মিলিয়ে আলোচ্য গ্রন্থটি এক ব্যতিক্রমী ধারার পদ্য সংকলন।
বিদ্যুৎ চক্রবর্তী
প্রকাশক - পান্থজন প্রিন্টিং অ্যান্ড পাবলিকেশন, শিলচর
মূল্য - ২৫০ টাকা

Comments

Popular posts from this blog

উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বাংলা গল্প : বিষয়ে বিশ্লেষণে

একক কিংবা যৌথ সম্পাদনায় বিগত কয়েক বছরে উত্তরপূর্বের বাংলা লেখালেখি বিষয়ক একাধিক গ্রন্থ সম্পাদনা করে এই সাহিত্যবিশ্বকে পাঠকের দরবারে পরিচিত করিয়ে দেওয়ার এক প্রচেষ্টা করে যাচ্ছেন নিবেদিতপ্রাণ তরুণ লেখক ও সম্পাদক নিত্যানন্দ দাস । হালে এপ্রিল ২০২৪ - এ প্রকাশিত হয়েছে তাঁর সম্পাদনা গ্রন্থ ‘ উত্তর - পূর্বাঞ্চলের বাংলা গল্প : বিষয়ে বিশ্লেষণে ’ ( প্রথম খণ্ড ) । প্রকাশক - একুশ শতক , কলকাতা । আলোচ্য গ্রন্থটিতে দুই ছত্রে মোট ২৮ জন বিশিষ্ট প্রাবন্ধিকের ২৮টি প্রবন্ধ রয়েছে । উপযুক্ত বিষয় ও আলোচকদের নির্বাচন বড় সহজ কথা নয় । এর জন্য প্রাথমিক শর্তই হচ্ছে নিজস্ব জ্ঞানার্জন । কালাবধি এই অঞ্চল থেকে প্রকাশিত উৎকৃষ্ট সাহিত্যকৃতির সম্বন্ধে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল না হলে তা সম্ভব নয় মোটেও । নিত্যানন্দ নিজেকে নিমগ্ন রেখেছেন গভীর অধ্যয়ন ও আত্মপ্রত্যয়কে সম্বল করে তা বলার অপেক্ষা রাখে না । আলোচ্য গ্রন্থের ভূমিকা লিখেছেন প্রতিষ্ঠিত কথাকার রণবীর পুরকায়স্থ । বস্তুত সাত পৃষ্ঠা জোড়া এই ভূমিকা এক পূর্ণাঙ্গ আলোচনা । ভূমিকা পাঠের পর আর আলাদা করে আলোচনার কিছু থাকে না । প্রতিটি নিবন্ধ নিয়ে পরিসরের অভাবে সংক্ষিপ্ত হলেও ...

কবির মজলিশ-গাথা

তুষারকান্তি সাহা   জন্ম ১৯৫৭ সাল৷ বাবা প্ৰয়াত নিৰ্মলকান্তি সাহা ও মা অমলা সাহার দ্বিতীয় সন্তান   তুষারকান্তির ৮ বছর বয়সে ছড়া রচনার মাধ্যমে সাহিত্য ভুবনে প্ৰবেশ৷ ‘ ছায়াতরু ’ সাহিত্য পত্ৰিকায় সম্পাদনার হাতেখড়ি হয় কলেজ জীবনে অধ্যয়নকালীন সময়েই৷ পরবৰ্তী জীবনে শিক্ষকতা থেকে সাংবাদিকতা ও লেখালেখিকেই পেশা হিসেবে গ্ৰহণ করেন৷ প্ৰথম ছড়া প্ৰকাশ পায় সাতের দশকে ‘ শুকতারা ’ য়৷ এরপর ‘ দৈনিক যুগশঙ্খ ’ পত্ৰিকার ‘ সবুজের আসর ’, দৈনিক সময়প্ৰবাহ ও অন্যান্য একাধিক কাগজে চলতে থাকে লেখালেখি৷ নিম্ন অসমের সাপটগ্ৰামে জন্ম হলেও বৰ্তমানে গুয়াহাটির স্থায়ী বাসিন্দা তুষারকান্তির এ যাবৎ প্ৰকাশিত গ্ৰন্থের সংখ্যা ছয়টি৷ এগুলো হচ্ছে নগ্ননিৰ্জন পৃথিবী (দ্বৈত কাব্যগ্ৰন্থ) , ভবঘুরের অ্যালবাম (ব্যক্তিগত গদ্য) , একদা বেত্ৰবতীর তীরে (কাব্যগ্ৰন্থ) , প্ৰেমের গদ্যপদ্য (গল্প সংকলন) , জীবনের আশেপাশে (উপন্যাস) এবং শিশু-কিশোরদের জন্য গল্প সংকলন ‘ গাবুদার কীৰ্তি ’ ৷ এছাড়াও বিভিন্ন পত্ৰপত্ৰিকায় প্ৰকাশিত হয়েছে শিশু কিশোরদের উপযোগী অসংখ্য অগ্ৰন্থিত গল্প৷ রবীন্দ্ৰনাথের বিখ্যাত ছড়া , কবিতা ও একাধিক ছোটগল্প অবলম্বনে লিখেছেন ...

প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'স্বপ্নতরী'

  স্বপ্নতরী                         বিদ্যুৎ চক্রবর্তী   গ্রন্থ বিপণী প্রকাশনা  বাবা - স্বর্গীয় সুধীর চন্দ্র চক্রবর্তী মা - শ্রীমতী বীণাপাণি চক্রবর্তী               জনম দিয়েছ মোরে এ ভব ধরায় গড়েছ সযতনে শিক্ষায় দীক্ষায় জীবনে কখনো কোথা পাইনি দ্বন্দ্ব দেখিনি হারাতে পূত - আদর্শ ছন্দ বিন্দু বিন্দু করি গড়ি পদ্য সংকলন তোমাদেরই চরণে করি সমর্পণ প্রথম ভাগ ( কবিতা )   স্বপ্নতরী ১ স্বপ্ন - তরী   নিটোল , নিষ্পাপ কচিপাতার মর্মর আর কাঁচা - রোদের আবোল - তাবোল পরিধিস্থ নতুন আমি ।   আনকোরা নতুন ঝরনাবারি নিয়ে এখন নদীর জলও নতুন বয়ে যায় , তাই শেওলা জমে না ।   দুঃখ আমার রয়ে গেছে এবার আসবে স্বপ্ন - তরী চেনা পথ , অচেনা ঠিকানা ।         ২ পাখমারা   সেই উথাল - পাথাল পাখশাট আজও আনে আরণ্যক অনুভূতি । একটু একটু হেঁটে গিয়ে বয়সের ফল্গুধারায় জগৎ নদীর দু ’ পার ছাড়ে দীর্ঘশ্বাস - সময়ের কাঠগড়াতে আমি বন...