Skip to main content

নান্দনিকতার গরজে প্রকাশিত - ‘মনুতট’ - সাহিত্যের অন্যভূমি


/৪ ক্রাউন সাইজে ৩৬ পৃষ্ঠার পত্রিকা পার্থ দাস-এর ছিমছাম, নান্দনিক একটি প্রচ্ছদ প্রথমেই দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম পাঠক/দর্শকের উত্তর ত্রিপুরার কুমারঘাট শহর একদিকে যেমন ঐতিহাসিক অন্যদিকে তেমনি প্রাকৃতিক প্রেক্ষাপটে এক স্বকীয় স্থান ধরে রেখেছে যুগ যুগ ধরে। এর বাইরেও দেও-মনু উপত্যকার এই জনপদের সামাজিক ও সাহিত্য-সংস্কৃতিমূলক প্রেক্ষাপটও যথেষ্ট প্রাচীন ও সমৃদ্ধ। তারই নিদর্শন সমাজ-সাহিত্য-সংস্কৃতি জগৎ থেকে উঠে আসা বহু বিদগ্ধ গুনীজন।
মনুতটের মানুষ গোপালচন্দ্র দাস এক নিরলস সাহিত্যিক তথা কবি ও সাহিত্য-কর্মী। তাঁরই সম্পাদনায় নিয়মিত প্রকাশিত হয়ে চলেছে মনুতট’ পত্রিকা। সম্প্রতি হাতে এসেছে পত্রিকাটির ষোড়শ বর্ষ, ত্রয়োদশ সংখ্যাটি। প্রকাশকাল ফেব্রুয়ারি ২০২৫। একগুচ্ছ কবিতা, দুটি ছড়া ও একটি একাঙ্ক অণুনাটকের সমাহারে সমৃদ্ধ হয়েছে এবারের সংখ্যাটি। সম্পাদকীয়টি হৃদয়গ্রাহী হলেও এতটাই সংক্ষিপ্ত যে পুরোটাই তুলে দেওয়া যায় - ‘মনুতট - পাড়ে ছিল অনেক কবিতা গল্প। আজও আছে। জীবন-দর্শনের মতোই আমার নদী দর্শন - থেমে থাকে না। মনু-পাড়ে জমে ওঠে জন্ম-মৃত্যু, ভাঙা-গড়ার খেলা। আমি ধ্যানী হয়ে সেই চক্রটাকে ভালোবেসে ফেলেছি। সেই ভালোবাসার ভাষাগুলোর তাগিদ আমার কথা ও কবিতা। ...একটি বিষয় ছেড়ে বহু বিষয় নিয়ে সাজিয়েছি কবিতার ছিটেফোঁটা জল। আমি অশান্ত মনু নদীর তটে উদ্যমী হয়ে রইলাম। জানি না নেবে কি না এ মহাসিন্ধু, মিলতে পারবে কি না - এই একবিন্দু ফোঁটা জল।’ - এক অন্তর নিংড়ানো নিবেদন, বাসভূমি ও মাতৃভাষার প্রতি এক অনবদ্য আকুতি, প্রেম ও গরজ ফুটে ওঠে এমন সম্পাদকীয় বয়ানে।
কবিতা রয়েছে মোট ৬৯টি ত্রিপুরা তথা বহি:রাজ্য ও বহি:রাষ্ট্রের একগুচ্ছ প্রতিষ্ঠিত তথা উদীয়মান কবিদের কবিতা সন্নিবিষ্ট হওয়ায় একাধারে যেখানে মান বৃদ্ধি পেয়েছে সংখ্যাটির তেমনি ছোট পত্রিকার দায়বদ্ধতাও রক্ষিত হয়েছে একশো শতাংশ কবিতার মান কিংবা ভালো লাগা না লাগা বিষয়ে আলোচনার আগে চোখ বুলানো যেতে পারে সমৃদ্ধ কবিতালিকায় লিখেছেন - দিলীপ দাস, কিশোর ভট্টাচার্য, অপাংশু দেবনাথ, মন্টু দাস, শুভ্রশংকর দাস, গোপেশ চক্রবর্তী, নিবারণ নাথ, বিল্লাল হোসেন, জহর দেবনাথ, অভীককুমার দে, চিরশ্রী দেবনাথ, অর্পিতা দাস, সুশান্ত নন্দী, পদ্মশ্রী মজুমদার, হাসনাইন সাজ্জাদি, অর্পিতা আচার্য, তমা বর্মন, আদিমা মজুমদার, সুজিত দেব, নারায়ণ মোদক, বিদ্যুৎ চক্রবর্তী, মাহফুজ রিপন, মধুমিতা ভট্টাচার্য, নিতাইচরণ দেবনাথ, অমলকান্তি চন্দ, জাকির আহমেদ, সঞ্জীব দে, সুচিত্রা দাস, নবীনকিশোর রায়্রণিতা নাথ, শিবানী গুপ্ত, কৃষ্ণকুসুম পাল, অভিজিৎ দাস, মীনাক্ষী চক্রবর্তী সোম, পরিমল কর্মকার, সুজয় নিয়োগী, বিধানচন্দ্র দে, . নির্মল দেবনাথ, অনিতা ভট্টাচার্য, টিংকুরঞ্জন দাস, সম্রাট শীল, বিভুলাল চক্রবর্তী, কামনা দেব, অসিত চক্রবর্তী, দিব্যেন্দু নাথ, কুণাল নন্দী, শৈলেন দাস, যূথিকা দাস, পাপিয়া রায়চৌধুরী, কৌশিক বণিক, নিশীথরঞ্জন পাল, চন্দন পাল, মিনারা বসুনীয়া, মিতালি দে, আশিসকান্তি সাহা, মজনুর রহমান, এম এ সুয়েব দুলাল, মানচিত্র পাল, প্রসেনজিৎ রায়, সুপ্রিয়া দাস, গণেশ দে, মৃদুলা ভট্টাচার্য, উত্তম সরকার, নৃপেশ আনন্দ দাস, অমিশা দাস, সংগীত শীল, বাবুলচন্দ্র সূত্রধর, রাজু ভৌমিক ও সম্পাদক গোপালচন্দ্র দাস
বহু কবিতা রয়েছে যা কাব্যগুণে ও লিখনশৈলীতে উন্নত মানের ছোটপত্রিকার দায়বদ্ধতার কথা আবারও উল্লেখ করে একথা মেনে নিতেই হয় যে একটি পত্রিকা-সংখ্যায় সব কবিতা উচ্চমানের হতেই পারে না হৃদয়স্পর্শী সব কবিতার উল্লেখ এই পরিসরে অসম্ভব, তবু কিছু কবিতার কিছু পঙ্ক্তি উল্লেখ করতেই হয় -
জীবনের কাছে জানু ভেঙে বসে প্রার্থনা করি
শান্তিসুখ একজীবনের মতো যতটুকু প্রয়োজন
হাজার ফুলের আতরগন্ধ মাখা সুগন্ধি জীবন
হোক না অলীক মন্দ থেকে ভালোয় উত্তরণ
(কবিতা - শান্তিসুখ, মীনাক্ষী চক্রবর্তী সোম)
 
বৃষ্টি হয়েই ভিজিয়েছ
মাঘের বসতবাড়ি
বাম থেকে ডান পাশ
এখনও ভিজে মাটির গন্ধ ছড়ায়
এমন তর্জমা কখনও হয়নি আগে
নদীর সাথে বরাবরের মতো
মুগ্ধ আমাদের দিনলিপি
(কবিতা - কাটলেট, সম্রাট শীল)
 
যতটুকু হেঁটে যাই আধা সাদাসিধা লোক
সে দলে আমার শেকড় মানুষ
মানুষ ভেসে গেলে বন্যায়
খামোকা বন্যার নামকরণ
এ পথই শ্মশান রোড
তারা কি আমার শেকড় মানুষ ?...
(কবিতা - শেকড় মানুষ, গোপালচন্দ্র দাস)
এইচ এস সরোয়ারদি ও অহর্নিশ মাস্টার অন্তিম-এর ছড়া ছন্দে, ভাবে যথার্থ শেষ পৃষ্ঠায় একই শিরোনামে গোপালচন্দ্র দাসের একটি গল্পচোর’-এর নাট্যরূপ দিয়েছেন নিবারণ নাথ করোনাকালীন সময়কে ধরে রেখে এক পরিযায়ী শ্রমিক ও জনতার সংলাপে ধরে রাখা হয়েছে সময়ের বিভীষিকা ও যাপনের প্রহসন
কাগজের মান, ছাপার স্পষ্টতা, বর্ণ, শব্দ ও পঙ্ক্তির বিন্যাস যথাযথ কিছু বানানপ্রমাদের বাইরে দেও-মনুর স্বচ্ছ জলধারার মতো, জম্পুই পাহাড়ের অনাবিল সারল্য, সৌন্দর্যের মতোই একটি স্বচ্ছ মনন, স্বচ্ছ গরজের পত্রিকাসংখ্যা - ‘মনুতট’ - সাহিত্যের অন্যভূমি

বিদ্যুৎ চক্রবর্তী

মূল্য - ১৫০ টাকা
যোগাযোগ - ৭০০৫২৪১০৮৫ 

Comments

  1. সুন্দর আলোচনা।
    আপনাকে এবং মনুতট পত্রিকার সম্পাদক মহাশয়কে অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা জানাই।

    ReplyDelete

Post a Comment

Popular posts from this blog

শেকড়ের টানে নান্দনিক স্মরণিকা - ‘পরিযায়ী’

রামকৃষ্ণনগর । প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আবহে বরাক উপত্যকার এক ঐতিহ্যময় শহর । বিশেষ করে শিক্ষাদীক্ষার ক্ষেত্রে চিরদিনই এক অগ্রণী স্থান হিসেবে উচ্চারিত হয়ে আসছে এই নাম । বৃহত্তর রামকৃষ্ণনগরের গোড়াপত্তনের ইতিহাস বহুদিনের । দেশভাগের আগে ও পরে , উত্তাল সময়ে স্থানচ্যূত হয়ে এখানে থিতু হতে চাওয়া মানুষের অসীম ত্যাগ ও কষ্টের ফলস্বরূপ গড়ে ওঠে এক বিশাল বাসযোগ্য অঞ্চল । শুধু রুটি , কাপড় ও ঘরের স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রই নয় , এর বাইরে শিক্ষা অর্জনের ও শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে মমনশীলতার পরিচয় দিয়েছিলেন সেইসব মহামানবেরা । ফলস্বরূপ এক শিক্ষিত সমাজব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল যদিও উচ্চশিক্ষার জন্য পরবর্তী প্রজন্মকে বেরোতে হয়েছিল নিজ বাসস্থান ছেড়ে । শিলচর তখন এ অঞ্চলের প্রধান শহর হওয়ায় স্বভাবতই শিক্ষা ও উপার্জনের স্থান হিসেবে পরিগণিত হয় । এবং স্বভাবতই রামকৃষ্ণনগর ছেড়ে এক বৃহৎ অংশের মানুষ এসে পাকাপাকিভাবে থাকতে শুরু করেন এই শিলচরে । এই ধারা আজও চলছে সমানে । শিলচরে এসেও শেকড়ের টানে পরস্পরের সাথে যুক্ত থেকে রামকৃষ্ণনগর মূলের লোকজনেরা নিজেদের মধ্যে গড়ে তোলেন এক সৌহার্দমূলক বাতাবরণ । এবং সেই সূত্রেই ২০০০ সালে গঠিত হয় ‘ ...

নিবেদিত সাহিত্যচর্চার গর্বিত পুনরাবলোকন - ‘নির্বাচিত ঋতুপর্ণ’

সাধারণ অর্থে বা বলা যায় প্রচলিত অর্থে একটি সম্পাদনা গ্রন্থের মানে হচ্ছে মূলত অপ্রকাশিত লেখা একত্রিত করে তার ভুল শুদ্ধ বিচার করে প্রয়োজনীয় সংশোধন ও সম্পাদনার পর গ্রন্থিত করা । যেমনটি করা হয় পত্রপত্রিকার ক্ষেত্রে । অপরদিকে সংকলন গ্রন্থের অর্থ হচ্ছে শুধুই ইতিপূর্বে প্রকাশিত লেখাসমূহ এক বা একাধিক পরিসর থেকে এনে হুবহু ( শুধুমাত্র বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে ন্যূনতম সংশোধনসাপেক্ষে ) একত্রীকরণ । সেই হিসেবে আলোচ্য গ্রন্থটি হয়তো সম্পাদনা গ্রন্থ নয় , একটি সংকলন গ্রন্থ । বিস্তারিত জানতে হলে যেতে হবে সম্পাদক ( সংকলক ) সত্যজিৎ নাথের বিস্তৃত ভূমিকায় । পুরো ভূমিকাটিই যদি লেখা যেতো তাহলে যথাযথ হতো যদিও পরিসর সে সায় দেয় না বলেই অংশবিশেষ তুলে ধরা হলো এখানে - ‘ সালটা ১৯৯০ । ‘ দৈনিক সোনার কাছাড় ’- এ একবছর হল আসা - যাওয়া করছি । চাকরির বয়স হয়নি তাই চাকরি নয় , এই ‘ আসা - যাওয়া ’ । …. হঠাৎ করেই একদিন ভূত চাপল মাথায় - পত্রিকা বের করব । ‘… সেই শুরু । অক্টোবর ১৯৯০ সালে শারদ সংখ্যা দিয়ে পথচলা শুরু হল ‘ঋতুপর্ণ’র। পরপর দুমাস বের করার পর সেটা হয়ে গেল ত্রৈমাসিক। পুরো পাঁচশো কপি ছাপাতাম ‘মৈত্রী প্রকাশনী’ থেকে।...

মহানিষ্ক্ৰমণ

প্রায় চল্লিশ বছর আগে গ্রামের সেই মায়াময় বাড়িটি ছেড়ে আসতে বেজায় কষ্ট পেয়েছিলেন মা ও বাবা। স্পষ্ট মনে আছে অর্ঘ্যর, এক অব্যক্ত অসহায় বেদনার ছাপ ছিল তাঁদের চোখেমুখে। চোখের কোণে টলটল করছিল অশ্রু হয়ে জমে থাকা যাবতীয় সুখ দুঃখের ইতিকথা। জীবনে চলার পথে গড়ে নিতে হয় অনেক কিছু, আবার ছেড়েও যেতে হয় একদিন। এই কঠোর বাস্তব সেদিন প্রথমবারের মতো উপলব্ধি করতে পেরেছিল অর্ঘ্যও। সিক্ত হয়ে উঠছিল তার চোখও। জন্ম থেকে এখানেই যে তার বেড়ে ওঠা। খেলাধুলা, পড়াশোনা সব তো এখানেই। দাদাদের বাইরে চলে যাওয়ার পর বারান্দাসংলগ্ন বাঁশের বেড়াযুক্ত কোঠাটিও একদিন তার একান্ত ব্যক্তিগত কক্ষ হয়ে উঠেছিল। শেষ কৈশোরে এই কোঠাতে বসেই তার শরীরচর্চা আর দেহজুড়ে বেড়ে-ওঠা লক্ষণের অবাক পর্যবেক্ষণ। আবার এখানে বসেই নিমগ্ন পড়াশোনার ফসল ম্যাট্রিকে এক চোখধাঁধানো ফলাফল। এরপর একদিন পড়াশোনার পাট চুকিয়ে উচ্চ পদে চাকরি পেয়ে দাদাদের মতোই বাইরে বেরিয়ে যায় অর্ঘ্য, স্বাভাবিক নিয়মে। ইতিমধ্যে বিয়ে হয়ে যায় দিদিরও। সন্তানরা যখন বড় হয়ে বাইরে চলে যায় ততদিনে বয়সের ভারে ন্যুব্জ বাবা মায়ের পক্ষে আর ভিটেমাটি আঁকড়ে পড়ে থাকা সম্ভব হয়ে ওঠে না। বহু জল্পনা কল্পনার শেষে ত...