Skip to main content

সম্পর্কের সাতকাহন - ‘মুখের মিছিল মনের মিছিল’


পরিবর্তনশীল সংসারে সুন্দর ও অসুন্দরের ছবি ভিন্ন ভিন্ন সময়ে নানাভাবে ফুটে উঠে। আর তাই চোখে দেখা স্বপ্ন আর বাস্তবের ভিত কখনও কখনও একেবারেই আলাদা হয়। সংঘর্ষ, লড়াই এসব কিছুই জীবনকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করে। তাতেও শেষ নয়। সমাজ সংসারে মানুষের ব্যবহার ও চেহারা বারবার পালটে যায় সময়ের সাথে সাথে। সুখ-দুঃখ, আনন্দ বেদনার লহর বয়ে যায় সংসার সমুদ্রে। সংসারের নানা ওঠাপড়া ও ভিন্ন ভিন্ন সময়ে মানুষের পরিবর্তনের নানান কথা তুলে ধরা হয়েছে আমার এই গল্পগ্রন্থে। বলা হয়েছে মানুষের ব্যক্তিসত্তার কথা, মানুষের স্বভাবগত পরিবর্তনের কথা। ….সংসারের ভিন্ন ভিন্ন সত্য রূপের আভাস তুলে ধরার চেষ্টা করেছি মাত্র। আমাদের সম্পূর্ণ জীবনে ভাবনার অস্তিত্ব অনেক সময় শূন্যে বিলীন হয়। তখন সংসারের ছন্দ, সুর ফিরিয়ে আনতে সম্পর্কের ডোর আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চাই আমরা। কিন্তু সে বাঁধনও সময়ের সাথে সাথে আলগা হয়ে যায়…।’ - ‘আমার কথা’ শিরোনামে গল্পকার অনুপমা পাল এভাবেই আলোচ্য গল্পগ্রন্থে সন্নিবিষ্ট গল্পসমূহের একটি সারাংশ তথা মূল উপজীব্য বিষয়কে পরিস্ফুট করেছেন।
পাকা বাঁধাইয়ে ১২৮ পৃষ্ঠার গ্রন্থের অন্তর্গত ১২০ পৃষ্ঠা জুড়ে মোট ২৩টি গল্পে বস্তুত সংসার নামক একত্রবাসের পরিধির সীমার মধ্যে রচিত, আবর্তিত ও সংঘটিত সুখ দুঃখের যাপন কথাই গল্পের আবহে তুলে ধরেছেন সরল, সপাট কথনে। মনের ভাব অনেকটাই ফুটে ওঠে মুখের অভিব্যক্তিতে যদিও কখনও কখনও মুখ হয়ে ওঠে মুখোশ। অনুপমার গল্পে তারই প্রতিচ্ছবি। মন ও মুখের যুগপৎ মিছিল। সেই অর্থে শিরোনাম সার্থক যদিও অন্যভাবে চিন্তা করলে দেখা যায় প্রায় প্রতিটি গল্পই যেখানে সম্পর্কের বৈচিত্র তথা বিশ্লেষণে গড়ে উঠেছে সেখানে গ্রন্থনাম শুধু ‘সম্পর্ক’ হলেও অপ্রাসঙ্গিক হতো না। কিছু গল্পে চরিত্রের ভিড় পরিলক্ষিত হলেও প্রায় প্রতিটি গল্প এতটাই গোছানো যে কোথাও অনাবশ্যক মেদ চোখে পড়ে না। বর্ণনার আধিক্য অনুভূত হলেও এক সৃষ্টিমূলক ভাবনায় সমাপন ঘটেছে সব গল্প। দু’একটি ব্যতিক্রমের বাইরে এগিয়ে গেছে এক সুখ সমাপনের দিকে - ইঙ্গিতে, ইশারায় হলেও। তবে শেষ হয়েও শেষ না হওয়ার মতো পরিস্থিতি চৈরি হয়নি। ছোটগল্পের সংজ্ঞায়িত সমাপন তাই অনুপস্থিত মনে হলেও মন ও মননের এই নিরলস চলন প্রথম থেকেই সরল। কোথাও জটিলতার অত্যাচার নেই। পাঠক তাই বুকে ধরে রাখেন কথাবাক।
আজকের অতি আধুনিক মানসিকতার পূর্ববর্তী সময়ে আমাদের অতি পরিচিত মা-মাসির সংসারের টানাপোড়েন ও জীবনযাত্রার আধারে নির্মিত অধিকাংশ গল্প আজকের পাঠককে নিশ্চিত নিয়ে যাবে ফেলে আসা সময়ের সরেজমিনে। ‘বেলাশেষে’, ‘শিউলি গাছের নীচে’, ‘অচেনা’, ‘সতী’, ‘চোখের আড়ালে’ জাতীয় উৎকৃষ্ট মানের গল্পের পাশাপাশি বাঁধনে, বুনোটে কিছু গল্প অপেক্ষাকৃত গড়ে ওঠেনি সেভাবে। উদাহরণ ‘ভয়’, ‘খোঁজ’, ‘শেষ অবলম্বন’ ইত্যাদি।
বানান ভুলের আধিক্য এতটাই যে গল্পের শিরোনাম, নায়কের নামের বানানেও ত্রুটি লক্ষ করা গেছে। কিছু শব্দ - যেমন ‘সত্যি’, ‘দৃপ্ত’ ইত্যাদির বানান গ্রন্থের আগাগোড়াই ভুল ছাপা হয়েছে। ‘ড়’ ও ‘র’-এর বিচলন, দাঁড়িহীন বাক্য আছে বেশ কিছু। ‘সবিতা দেবী বলেছে...’, ‘প্রণয়বাবু রিটায়ার করেছে...’ জাতীয় বাক্য সংলাপের মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করেছে বেশ কিছু জায়গায়।
কাগজের মান, ছাপা, বর্ণ সংস্থাপন, অক্ষরাকার সবই যথাযথ। ব্লার্বে গ্রন্থ সম্পর্কিত কোনো তথ্য নেই। বিপরীতে গল্পকারের পরিচিতি ও সাহিত্যকৃতি রয়েছে দুই ব্লার্ব জুড়ে। গল্পকার গ্রন্থটি উৎসর্গ করেছেন তাঁর বাবাকে। প্রচ্ছদ সৌজন্যে গল্পকার নিজেই। প্রাসঙ্গিক হলেও রঙের ক্ষেত্রে কিছু হালকা টাচ্‌ থাকলে দৃষ্টিসুখকর হতো বলে মনে হয়। সব মিলিয়ে বেশ কিছু পঠনসুখের গল্প সংকলন ‘মুখের মিছিল মনের মিছিল’ যেখানে সুস্থ মানসিকতা, মানবিকতা, সংসারে সম্পর্কের বৈচিত্র ও মর্যাদার পাশাপাশি উন্মোচিত হয়েছে সমাজের অন্দরে লুকিয়ে থাকা কিছু অনাচার, অনিয়মের মুখোশ, স্বার্থপরতার পরাকাষ্ঠা।
বিদ্যুৎ চক্রবর্তী

প্রকাশক - নতুন দিগন্ত প্রকাশনী, শিলচর
মূল্য - ২০০ টাকা
যোগাযোগ - ৮৬৩৮৪২২২৬১

Comments

Popular posts from this blog

উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বাংলা গল্প : বিষয়ে বিশ্লেষণে

একক কিংবা যৌথ সম্পাদনায় বিগত কয়েক বছরে উত্তরপূর্বের বাংলা লেখালেখি বিষয়ক একাধিক গ্রন্থ সম্পাদনা করে এই সাহিত্যবিশ্বকে পাঠকের দরবারে পরিচিত করিয়ে দেওয়ার এক প্রচেষ্টা করে যাচ্ছেন নিবেদিতপ্রাণ তরুণ লেখক ও সম্পাদক নিত্যানন্দ দাস । হালে এপ্রিল ২০২৪ - এ প্রকাশিত হয়েছে তাঁর সম্পাদনা গ্রন্থ ‘ উত্তর - পূর্বাঞ্চলের বাংলা গল্প : বিষয়ে বিশ্লেষণে ’ ( প্রথম খণ্ড ) । প্রকাশক - একুশ শতক , কলকাতা । আলোচ্য গ্রন্থটিতে দুই ছত্রে মোট ২৮ জন বিশিষ্ট প্রাবন্ধিকের ২৮টি প্রবন্ধ রয়েছে । উপযুক্ত বিষয় ও আলোচকদের নির্বাচন বড় সহজ কথা নয় । এর জন্য প্রাথমিক শর্তই হচ্ছে নিজস্ব জ্ঞানার্জন । কালাবধি এই অঞ্চল থেকে প্রকাশিত উৎকৃষ্ট সাহিত্যকৃতির সম্বন্ধে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল না হলে তা সম্ভব নয় মোটেও । নিত্যানন্দ নিজেকে নিমগ্ন রেখেছেন গভীর অধ্যয়ন ও আত্মপ্রত্যয়কে সম্বল করে তা বলার অপেক্ষা রাখে না । আলোচ্য গ্রন্থের ভূমিকা লিখেছেন প্রতিষ্ঠিত কথাকার রণবীর পুরকায়স্থ । বস্তুত সাত পৃষ্ঠা জোড়া এই ভূমিকা এক পূর্ণাঙ্গ আলোচনা । ভূমিকা পাঠের পর আর আলাদা করে আলোচনার কিছু থাকে না । প্রতিটি নিবন্ধ নিয়ে পরিসরের অভাবে সংক্ষিপ্ত হলেও ...

শেকড়ের টানে নান্দনিক স্মরণিকা - ‘পরিযায়ী’

রামকৃষ্ণনগর । প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আবহে বরাক উপত্যকার এক ঐতিহ্যময় শহর । বিশেষ করে শিক্ষাদীক্ষার ক্ষেত্রে চিরদিনই এক অগ্রণী স্থান হিসেবে উচ্চারিত হয়ে আসছে এই নাম । বৃহত্তর রামকৃষ্ণনগরের গোড়াপত্তনের ইতিহাস বহুদিনের । দেশভাগের আগে ও পরে , উত্তাল সময়ে স্থানচ্যূত হয়ে এখানে থিতু হতে চাওয়া মানুষের অসীম ত্যাগ ও কষ্টের ফলস্বরূপ গড়ে ওঠে এক বিশাল বাসযোগ্য অঞ্চল । শুধু রুটি , কাপড় ও ঘরের স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রই নয় , এর বাইরে শিক্ষা অর্জনের ও শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে মমনশীলতার পরিচয় দিয়েছিলেন সেইসব মহামানবেরা । ফলস্বরূপ এক শিক্ষিত সমাজব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল যদিও উচ্চশিক্ষার জন্য পরবর্তী প্রজন্মকে বেরোতে হয়েছিল নিজ বাসস্থান ছেড়ে । শিলচর তখন এ অঞ্চলের প্রধান শহর হওয়ায় স্বভাবতই শিক্ষা ও উপার্জনের স্থান হিসেবে পরিগণিত হয় । এবং স্বভাবতই রামকৃষ্ণনগর ছেড়ে এক বৃহৎ অংশের মানুষ এসে পাকাপাকিভাবে থাকতে শুরু করেন এই শিলচরে । এই ধারা আজও চলছে সমানে । শিলচরে এসেও শেকড়ের টানে পরস্পরের সাথে যুক্ত থেকে রামকৃষ্ণনগর মূলের লোকজনেরা নিজেদের মধ্যে গড়ে তোলেন এক সৌহার্দমূলক বাতাবরণ । এবং সেই সূত্রেই ২০০০ সালে গঠিত হয় ‘ ...

প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'স্বপ্নতরী'

  স্বপ্নতরী                         বিদ্যুৎ চক্রবর্তী   গ্রন্থ বিপণী প্রকাশনা  বাবা - স্বর্গীয় সুধীর চন্দ্র চক্রবর্তী মা - শ্রীমতী বীণাপাণি চক্রবর্তী               জনম দিয়েছ মোরে এ ভব ধরায় গড়েছ সযতনে শিক্ষায় দীক্ষায় জীবনে কখনো কোথা পাইনি দ্বন্দ্ব দেখিনি হারাতে পূত - আদর্শ ছন্দ বিন্দু বিন্দু করি গড়ি পদ্য সংকলন তোমাদেরই চরণে করি সমর্পণ প্রথম ভাগ ( কবিতা )   স্বপ্নতরী ১ স্বপ্ন - তরী   নিটোল , নিষ্পাপ কচিপাতার মর্মর আর কাঁচা - রোদের আবোল - তাবোল পরিধিস্থ নতুন আমি ।   আনকোরা নতুন ঝরনাবারি নিয়ে এখন নদীর জলও নতুন বয়ে যায় , তাই শেওলা জমে না ।   দুঃখ আমার রয়ে গেছে এবার আসবে স্বপ্ন - তরী চেনা পথ , অচেনা ঠিকানা ।         ২ পাখমারা   সেই উথাল - পাথাল পাখশাট আজও আনে আরণ্যক অনুভূতি । একটু একটু হেঁটে গিয়ে বয়সের ফল্গুধারায় জগৎ নদীর দু ’ পার ছাড়ে দীর্ঘশ্বাস - সময়ের কাঠগড়াতে আমি বন...