Skip to main content

ব্যতিক্রমী ধাঁচের গল্প সংকলন - ‘জমিন আসমান’


হাতে এল উত্তর-পূর্বের ত্রিপুরা রাজ্যের বাসিন্দা কবি, গল্পকার, ঔপন্যাসিক দিব্যেন্দু নাথ-এর গল্প সংকলনজমিন আসমান মানুষ দিব্যেন্দু এবং তাঁর লেখালেখির সঙ্গে যতটুকু পরিচয় তাতে মাটির সঙ্গে তাঁর আজন্ম হার্দ সম্পর্কের কথা উঠে এসেছে নানাসময়ে, নানা আঙ্গিকে গ্রামপাহাড়ের মাটি, মানুষ ও তাদের নিত্য দিনের সুখ দুঃখের সতত অংশীদার দিব্যেন্দু স্বভূম, স্বজাতি থেকে উঠে আসা তৃণমূল স্তরের মানুষদের নিয়েই তাঁর লেখালেখির বিস্তৃত জগৎ সুতরাং গল্প সংকলনের শিরোনাম যে এমনই সার্থকতায় স্থিরীকৃত হবে তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ থাকার কথা নয় সংকলনের গল্পসমূহ নিয়ে ভূমিকায় বিশিষ্ট কথাকার, ঔপন্যাসিক শ্যামল বৈদ্য লিখছেন -
‘…আজকাল ছোটগল্প নিয়ে অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা হচ্ছে কাহিনি ছেড়ে গল্প অন্য খাতে বইছে কখনও শুধুই মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ বা সামান্য অনুভূতি গল্পের মোড় বদলে দিচ্ছেজমিন আসমানগল্প সংকলনে লেখক কাহিনির প্রতি বিশ্বস্ত থাকতে চেয়েছেন। কিন্তু গল্প বারবার নানাদিকে স্বত:স্ফুর্ত বিচরণ করেছে। কাহিনির অবয়ব দিয়েছেন বাউল, চাষি থেকে সাধারণ মানুষ - সবাই আমাদের খুব চেনা স্বজন। সমাজের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লেখক এদের তুলে এনেছেন মরমি চোখে। সযতনে এক-এক করে রঙিন পালক দিয়ে অর্ঘ্য সাজিয়েছেন। অন্ত্যজ, নিম্ন-মধ্যবিত্ত মানুষের জীবনের লড়াই, সম্পর্কের টানাপোড়েন তাঁর গল্পে পল্লবিত হয়েছে...
বস্তুত এই ভূমিকাটিই আলোচ্য গ্রন্থে সন্নিবিষ্ট প্রতিটি গল্পের আকরকথা। এরপর আর বিশেষ কিছু বলার থাকতে পারে না। বলা হয় জহুরি জহর চেনে। ঔপন্যাসিক শ্যামলের এহেন ভূমিকায় দিব্যেন্দু নাথের শুধু আলোচ্য গ্রন্থেরই নয়, সার্বিক লেখালেখিরও একটি সত্যসন্ধানী চিত্র চিত্রিত হয়ে গেছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে গ্রামের কৃষক, পাহাড়ের সহজ সরল অধিবাসী, দুঃস্থ, খেটে খাওয়া মানুষ ও ফকির বাউলের জীবন গল্পকারকে ভীষণভাবে প্রভাবিত করেছে। ফকির বাউলের আত্মভোলা যাপন সিঞ্চিত হয়েছে গল্পকারের জীবনে ও লেখালেখিতে। তাই একের পর এক গল্পে উঠে এসেছে এইসব চরিত্র। এবং আশ্চর্যজনকভাবে তাদের আত্মভোলা প্রকৃতির রেশ ধরেই দিব্যেন্দুর গল্পের ধারা ও বয়ে যেতে দেখা গেছে ভূমিকাকারের বলা মতো। কখনও কিঞ্চিৎ অবোধ্য হয়ে উঠেছে গল্পের ধারা, কখনও হারিয়ে যাওয়া খেই ফিরে পেতে অপেক্ষা করতে হয়েছে। অন্ত্যজ শ্রেণির অন্দরমহলে গল্পকারের প্রখর অনুপ্রবেশ যেন এক স্বত:স্ফুর্ত ঘটনা। সেইসব দিন আনি দিন খাই, গরিবি রেখার শত যোজন নীচে বসত করা লোকেদের অন্তরে প্রবেশ করে তাদের বিচিত্র দৈনন্দিন জীবনযাত্রার বাইরেও তাদের সুখদুঃখ, প্রেম-ভালোবাসাকে নিংড়ে আনতে ষোলোআনা সফল কাহিনিকার দিব্যেন্দু।
আলোচ্য গ্রন্থে সন্নিবিষ্ট হয়েছে মোট ২১টি গল্প। তার অধিকাংশই অণুগল্প। রয়েছে গল্পের ধাঁচে একটি ভ্রমণ বৃত্তান্ত এবং সবশেষে একটি নিবন্ধসদৃশ লেখা। ভূমিকাকারের বলা মতোই অধিকাংশ গল্পে রয়েছে লেখকের অভিজ্ঞতাপ্রসূত দুঃস্থ মানুষের নিত্যদিনের ঘরকন্না, অনুভব অনুভূতির বয়ান। ঘোরের ঘরে অনেক ক্ষেত্রেই হারিয়ে গেছেন গল্পকার তাঁর স্বভাবজাত ভাবনায়, গল্প হয়ে ওঠেনি সেভাবে। এমনকি অধিকাংশ গল্পেরই নেই কোনো ধরাবাঁধা গৎ। নেই কোনো নির্দিষ্ট সমাপন। তবু পাঠক হৃদয়ে রয়ে যাবে কিছু গুঞ্জন। বহু গল্পে উঠে এসেছে প্রেম ভালোবাসা, বিরহ, বিচ্ছেদের বিচিত্র রূপ, প্রচ্ছন্ন যৌনতা - গ্রাম্য জীবনের নানা বয়সের মানুষের যাপন কথা, তীব্র গরিবির দহন জ্বালা। ‘দর্জির মেয়ে’ গল্পে রয়েছে সম্পর্ক, অনুভব ও প্রাচুর্যের কাটাছেঁড়া। চমৎকার একটি গল্প। গ্রন্থনাম শীর্ষক ‘জমিন আসমান’ গল্পটিও এক কথায় অনবদ্যলেখক নিপুণ মুনশিয়ানায় বর্ণনা করেছেন বাউল ফকিরের জীবনযাত্রা, প্রেম ভালোবাসার অনুষঙ্গে। ‘কবে আসছ রাঙ্গি’ গল্পটি এক সাহসী উচ্চারণ। ‘গল্প হলেও সত্যি’ ধাঁচের একটি পজিটিভ গল্প। যদিও গ্রাম্য গালিগালাজের উল্লেখে এতটা সাহসী না হওয়াই হয়তো শ্রেয়। ‘অর্বাচীন হাসি’ একটি সিদ্ধান্তের গল্প - পাহাড়, প্রকৃতি, বনবাসীদের, শিশুদের প্রতি ভালোবাসা, কৃতজ্ঞতা, দায়বদ্ধতার সুখপাঠ্য গল্প। এছাড়াও ‘শোক-পাখি’, ‘সন্ধ্যা তারা’, ‘গোলাইস দিদি’, ‘মশা’, ‘অন্ধকার কামরা’ ইত্যাদি গল্প ভিন্ন ভিন্ন প্রেক্ষিতসম্পন্ন সুলিখিত গল্প।
‘নাইসিং’ একটি ভ্রমণ বৃত্তান্ত যদিও তথ্যে, কাহিনির আদলে অনেকটাই গল্পের আদল পরিগ্রহ করতে সমর্থ হয়েছে। পাহাড় ও নদীর প্রতি লেখকের আজন্ম এক ভালোবাসার সার্থক প্রকাশ। শেষ গল্প - ‘জম্পুই ও তার সিঞ্চন’। রচনায় নিবন্ধের আদলে উঠে এসেছে পুরো জম্পুই পাহাড়, জম্পুই বৃত্তান্ত। উঠে এসেছে ভূগোল, ইতিহাস থেকে প্রকৃতির অনাবিল রস।
৭২ পৃষ্ঠার এই গ্রন্থটির কাগজের মান, ছাপা, হার্ড বোর্ড জ্যাকেট কভার বাঁধাই, বর্ণ সংস্থাপন, অক্ষর বিন্যাস সবই যথাযথ। প্রথম ব্লার্বে ‘লেখকের কথা’ থাকলেও দ্বিতীয় ব্লার্বটি খালি থেকে গেছে। কিছু বাক্য গঠনে অসংলগ্নতা, বেশ কিছু বানান বিভ্রাট, কিছু যতিচিহ্নের বিভ্রাটও রয়ে গেছে। আগরতলার ‘তিনকাল পাবলিশার্স’ কর্তৃক প্রকাশিত গ্রন্থটি লেখক উৎসর্গ করেছেন তাঁর মাতামহ ও মাতামহীকে। প্রকাশনা ও প্রচ্ছদের সৌজন্যে বিল্লাল হোসেন। সবকিছু ছাপিয়ে এক ভিন্নধর্মী, নিমগ্ন পঠনের ব্যতিক্রমী ধাঁচসম্পন্ন গল্পের সংকলন - ‘জমিন আসমান’।

বিদ্যুৎ চক্রবর্তী

মূল্য - ২০০ টাকা
যোগাযোগ - ৯৮৬২৪৭৩৩২৬ 

Comments

  1. আলোচক বিদ্যুৎ চক্রবর্তী দাদা ও পত্রিকার সম্পাদক সহ সংশ্লিষ্ট সকলকে জানাই শুভেচ্ছা অভিনন্দন ও ধন্যবাদ

    ReplyDelete

Post a Comment

Popular posts from this blog

শেকড়ের টানে নান্দনিক স্মরণিকা - ‘পরিযায়ী’

রামকৃষ্ণনগর । প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আবহে বরাক উপত্যকার এক ঐতিহ্যময় শহর । বিশেষ করে শিক্ষাদীক্ষার ক্ষেত্রে চিরদিনই এক অগ্রণী স্থান হিসেবে উচ্চারিত হয়ে আসছে এই নাম । বৃহত্তর রামকৃষ্ণনগরের গোড়াপত্তনের ইতিহাস বহুদিনের । দেশভাগের আগে ও পরে , উত্তাল সময়ে স্থানচ্যূত হয়ে এখানে থিতু হতে চাওয়া মানুষের অসীম ত্যাগ ও কষ্টের ফলস্বরূপ গড়ে ওঠে এক বিশাল বাসযোগ্য অঞ্চল । শুধু রুটি , কাপড় ও ঘরের স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রই নয় , এর বাইরে শিক্ষা অর্জনের ও শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে মমনশীলতার পরিচয় দিয়েছিলেন সেইসব মহামানবেরা । ফলস্বরূপ এক শিক্ষিত সমাজব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল যদিও উচ্চশিক্ষার জন্য পরবর্তী প্রজন্মকে বেরোতে হয়েছিল নিজ বাসস্থান ছেড়ে । শিলচর তখন এ অঞ্চলের প্রধান শহর হওয়ায় স্বভাবতই শিক্ষা ও উপার্জনের স্থান হিসেবে পরিগণিত হয় । এবং স্বভাবতই রামকৃষ্ণনগর ছেড়ে এক বৃহৎ অংশের মানুষ এসে পাকাপাকিভাবে থাকতে শুরু করেন এই শিলচরে । এই ধারা আজও চলছে সমানে । শিলচরে এসেও শেকড়ের টানে পরস্পরের সাথে যুক্ত থেকে রামকৃষ্ণনগর মূলের লোকজনেরা নিজেদের মধ্যে গড়ে তোলেন এক সৌহার্দমূলক বাতাবরণ । এবং সেই সূত্রেই ২০০০ সালে গঠিত হয় ‘ ...

নিবেদিত সাহিত্যচর্চার গর্বিত পুনরাবলোকন - ‘নির্বাচিত ঋতুপর্ণ’

সাধারণ অর্থে বা বলা যায় প্রচলিত অর্থে একটি সম্পাদনা গ্রন্থের মানে হচ্ছে মূলত অপ্রকাশিত লেখা একত্রিত করে তার ভুল শুদ্ধ বিচার করে প্রয়োজনীয় সংশোধন ও সম্পাদনার পর গ্রন্থিত করা । যেমনটি করা হয় পত্রপত্রিকার ক্ষেত্রে । অপরদিকে সংকলন গ্রন্থের অর্থ হচ্ছে শুধুই ইতিপূর্বে প্রকাশিত লেখাসমূহ এক বা একাধিক পরিসর থেকে এনে হুবহু ( শুধুমাত্র বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে ন্যূনতম সংশোধনসাপেক্ষে ) একত্রীকরণ । সেই হিসেবে আলোচ্য গ্রন্থটি হয়তো সম্পাদনা গ্রন্থ নয় , একটি সংকলন গ্রন্থ । বিস্তারিত জানতে হলে যেতে হবে সম্পাদক ( সংকলক ) সত্যজিৎ নাথের বিস্তৃত ভূমিকায় । পুরো ভূমিকাটিই যদি লেখা যেতো তাহলে যথাযথ হতো যদিও পরিসর সে সায় দেয় না বলেই অংশবিশেষ তুলে ধরা হলো এখানে - ‘ সালটা ১৯৯০ । ‘ দৈনিক সোনার কাছাড় ’- এ একবছর হল আসা - যাওয়া করছি । চাকরির বয়স হয়নি তাই চাকরি নয় , এই ‘ আসা - যাওয়া ’ । …. হঠাৎ করেই একদিন ভূত চাপল মাথায় - পত্রিকা বের করব । ‘… সেই শুরু । অক্টোবর ১৯৯০ সালে শারদ সংখ্যা দিয়ে পথচলা শুরু হল ‘ঋতুপর্ণ’র। পরপর দুমাস বের করার পর সেটা হয়ে গেল ত্রৈমাসিক। পুরো পাঁচশো কপি ছাপাতাম ‘মৈত্রী প্রকাশনী’ থেকে।...

মহানিষ্ক্ৰমণ

প্রায় চল্লিশ বছর আগে গ্রামের সেই মায়াময় বাড়িটি ছেড়ে আসতে বেজায় কষ্ট পেয়েছিলেন মা ও বাবা। স্পষ্ট মনে আছে অর্ঘ্যর, এক অব্যক্ত অসহায় বেদনার ছাপ ছিল তাঁদের চোখেমুখে। চোখের কোণে টলটল করছিল অশ্রু হয়ে জমে থাকা যাবতীয় সুখ দুঃখের ইতিকথা। জীবনে চলার পথে গড়ে নিতে হয় অনেক কিছু, আবার ছেড়েও যেতে হয় একদিন। এই কঠোর বাস্তব সেদিন প্রথমবারের মতো উপলব্ধি করতে পেরেছিল অর্ঘ্যও। সিক্ত হয়ে উঠছিল তার চোখও। জন্ম থেকে এখানেই যে তার বেড়ে ওঠা। খেলাধুলা, পড়াশোনা সব তো এখানেই। দাদাদের বাইরে চলে যাওয়ার পর বারান্দাসংলগ্ন বাঁশের বেড়াযুক্ত কোঠাটিও একদিন তার একান্ত ব্যক্তিগত কক্ষ হয়ে উঠেছিল। শেষ কৈশোরে এই কোঠাতে বসেই তার শরীরচর্চা আর দেহজুড়ে বেড়ে-ওঠা লক্ষণের অবাক পর্যবেক্ষণ। আবার এখানে বসেই নিমগ্ন পড়াশোনার ফসল ম্যাট্রিকে এক চোখধাঁধানো ফলাফল। এরপর একদিন পড়াশোনার পাট চুকিয়ে উচ্চ পদে চাকরি পেয়ে দাদাদের মতোই বাইরে বেরিয়ে যায় অর্ঘ্য, স্বাভাবিক নিয়মে। ইতিমধ্যে বিয়ে হয়ে যায় দিদিরও। সন্তানরা যখন বড় হয়ে বাইরে চলে যায় ততদিনে বয়সের ভারে ন্যুব্জ বাবা মায়ের পক্ষে আর ভিটেমাটি আঁকড়ে পড়ে থাকা সম্ভব হয়ে ওঠে না। বহু জল্পনা কল্পনার শেষে ত...