গল্পের জগৎ বড়ই বিচিত্র। কিছু কথা, কিছু ভাবনাকে গদ্যে প্রকাশ করার এই শিল্প এতটাই বিস্তৃত যে সাহিত্যের অন্যতম এই শাখাটি সাহিত্য-ভুবনে আপন মহিমায় সততই মহিমান্বিত। বিস্তৃতি অনুযায়ী গল্পের আবার স্বীকৃত তিনটি ভাগ আছে। বড়গল্প, ছোটগল্প এবং অণুগল্প। বড়গল্প এবং ছোটগল্পে যেখানে ভাবপ্রকাশের বিস্তৃত সুযোগ থাকে সেখানে অণুগল্পের সেই বিস্তৃত পরিসর না থাকায় স্বল্প কথায় ফুটিয়ে তুলতে হয় কাহিনি। তাই অনেকের মতে অণুগল্পেই লেখার মুনশিয়ানার প্রয়োজন সবচাইতে বেশি। গল্পের ভাব, ভাষা, চরিত্র, সংলাপ, বুনোট, উপসংহার সবকিছুকেই সংকুচিত আকারে প্রকাশ করার জন্য প্রকৃতার্থেই প্রয়োজন এক ভিন্নতর মুনশিয়ানা।
উত্তরপূর্বের বাংলা সাহিত্যে গল্প অর্থাৎ ছোটগল্পের উপস্থিতি যথেষ্ট উপলব্ধ হলেও অণুগল্প বা অণুগল্পের সংকলন তেমন নেই। আজকের দিনে অণুগল্পে মুনশিয়ানা দেখাতে পারছেন যে ক’জন গল্পকার তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য নাম মঞ্জরী হীরামণি রায়। অজস্র অণুগল্পের স্রষ্টা এই লেখকের রয়েছে অণুগল্পের সংকলনও।
মৌপিয়া চৌধুরী নিয়মিত লেখক না হলেও গল্প, কবিতায় তাঁর উপস্থিতি অনস্বীকার্য। স্বাতন্ত্র্য আছে লেখায়। স্বল্পদৈর্ঘের গল্পের সংকলন রয়েছে তাঁরও। সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে মৌপিয়ার ২০টি এবং মঞ্জরীর ১০টি মোট ৩০টি অণুগল্পের একত্রে প্রকাশিত সংকলন - ‘মুঠোয় বকুল ফুল’। ১/৮ ডিমাই সাইজের ৭৬ পৃষ্ঠা জুড়ে রয়েছে ভাবনা ও বোধের দুই গুচ্ছ মুঠোভরা কথাফুল।
এখানে প্রধান গল্পকার স্বভাবতই মৌপিয়া। মঞ্জরী অনেকটা অংশগ্রহণকারী পর্যবেক্ষক বা তত্ত্বাবধায়কের মতো। ভূমিকাস্বরূপ ‘লেখকের কথা’য় তাই মঞ্জরী লিখেন - ‘…কিছু সম্পর্ক হয় সবুজ, সুন্দর। রক্তের বাঁধন হয়তো তাতে থাকে না, কিন্তু হৃদয়-নোঙর তোলে পাড়ি জমাতে অসুবিধে হয় না। মৌপিয়া আর আমি এমনি…।’ মৌপিয়ার গল্পের বিষয়বস্তু স্বভাবতই বহুমুখী যদিও অধিকাংশ গল্পেই এক সারস্বত শুভময় ধারণার ইঙ্গিত অনুধাবনযোগ্য। আখেরে কু-সমূহের বিপরীতে সু-এর জয় নিশ্চিত হয়েছে গল্পে। জীব ও জড় তথা জাতপাত, বর্ণ, ধর্ম, লিঙ্গ নির্বিশেষে গল্পকারের সমান অনুভূতির প্রকাশ জীবন্ত হয়ে উঠেছে গল্পে। এর কারণও খুঁজে পাওয়া যায় ‘লেখকের কথা’য়, যেখানে মৌপিয়া লিখছেন - ‘…পথ চলতে এমন কিছু মানুষের সাথে দেখা হয়েছে যাঁদের ভালোবাসা ও প্রশ্রয়ে আমার কলম আজ রানওয়েতে…।’ অর্থাৎ উড়তে উন্মুখ তাঁর গল্পের বিজয়রথ।
প্রথম গল্পেই বলতে গেলে বাজিমাত করেছেন মৌপিয়া। অণুগল্পের ধারা মেনে এগোতে এগোতে শেষ মুহুর্তে যে অপ্রত্যাশিত মোচড় নিয়েছে গল্প তাতে পাঠক যে পাঠশেষে ফের শুরু থেকে অন্তত আরও একবার গল্পটি পড়বেন এটা বলা যায় হলফ করেই। এরপর থেকে সতর্ক পাঠক হয়তো আর দু’বার পড়বেন না তবে গল্পের স্বাদ নিশ্চিতই উপভোগ করবেন তারিয়ে তারিয়ে। গল্পের প্লট বিস্তৃত। একেবারে তৃণমূল স্তর থেকে হাই সোসাইটির মানুষের চরিত্র বিশ্লেষণ করেছেন গল্পকার মৌপিয়া - সুনিপুণ ধারায়। ‘শরবত’, ‘বহ্নি’, ‘নীড়’, ‘ধাক্কা’ আদি গল্প একদিকে যেমন প্রেক্ষাপটে, কাহিনিতে, অনবদ্য তেমনি অন্যদিকে বয়ে আনে সমাজের জন্য এক শুভঙ্কর বার্তা। এখানেই গল্পকারের সার্বিক সাফল্য। সমাজের অন্দরে লুকিয়ে থাকা নানা কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস আদিকে তর্জনী উঁচিয়ে উদ্ঘাটিত করে বাকি গল্পগুলিতেও গল্পকার ছড়িয়ে দিয়েছেন এক উত্তরণের বোধ। নৈর্ব্যক্তিকতা থেকে ব্যক্তিকরণের ট্র্যানজিশন মৌপিয়ার গল্পের এক বিশিষ্টতা। কিছু শব্দের সংস্থাপনজনিত বিভ্রাটের ফলে শেষের দিকের কয়েকটি গল্পের বাক্যবিন্যাস পাঠকের কাছে কিছুটা জটিল মনে হতে পারে যদিও যথেষ্ট দায়বদ্ধতা ও শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মনোভাব নিয়ে গল্পকার মৌপিয়া সজিয়েছেন তাঁর গল্পের ডালি।
মঞ্জরীর অপরাপর গল্পের চমৎকারিত্ব ও উৎকর্ষের পুরোটা হয়তো এখানে খুঁজে পাওয়া যাবে না তবে ‘আলো-বাতাস’, ‘লি নয় স্যার, এটা নয়। মানে…’, ‘অনুরাগের ছোঁয়া’ আদি গল্পে সেই রসেরই বহুরৈখিক ছোঁয়া পাওয়া যাবে নিশ্চিতই। পরিবর্তিত যুগধর্মের সঙ্গে খাপ খাইয়ে আধুনিকমনষ্কতা, লিঙ্গ বৈষম্যের বিরোধিতা ইত্যাদি এই গল্পকারের সহজাত গল্প-বিষয় যথারীতি উপস্থিত হয়েছে এখানেও। গ্রন্থটির ছাপা, বাঁধাই, অক্ষরবিন্যাস আদি যথাযথ। আধুনিক বানান অনুসৃত হলেও ফাঁক গলে রয়ে গেছে কিছু। গ্রন্থটি উৎসর্গ করা হয়েছে ‘বৃষ্টি ও কাহনকে… যারা অক্সিজেন জোগায় প্রতিনিয়ত…’। প্রচ্ছদ সৌজন্যে বিমলেন্দু সিনহা এবং নান্দনিক অলংকরণের সৌজন্যে উজ্জ্বলেন্দু দাস। সব মিলিয়ে নিশ্চিতই একমুঠো বকুল ফুলের মতো নান্দনিক ও ব্যতিক্রমী ভাবনার সার্বিক প্রকাশ আলোচ্য গ্রন্থটি।
বিদ্যুৎ চক্রবর্তী
প্রকাশক - মৌপিয়া চৌধুরী/সাইমা পাবলিকেশন, শিলচর
মূল্য - ১০০ টাকা, যোগাযোগ - ৯৪৩৫৬২২৯২৪
Comments
Post a Comment