হে উড়ন্ত আমার প্রেমিকা
এ প্রান্তে সবাই রাখাল
স্বামীর রুমাল ও নর্তক কুমকুম
কলহের পরিপূর্ণ ঘ্রাণ নিতে রাতের নক্ষত্রে
আড়ি পাতে অশুদ্ধ জানালায়
তখন চাঁদ আলগা বেণীতে ঢেলে দেয়
দূরধ্বনি অশোক চেতনা
আমি তার অশুদ্ধ বেপথু বর্ণমালা
(কবিতা - বর্ণমালার ঠিকানা)।
গ্রন্থের শেষ মলাটে কবির সংক্ষিপ্ত পরিচিতির বাইরে দুটি ব্লার্বই খালি। গ্রন্থের নেই কোন সার্বিক ভূমিকা। আসলে এসব কোনও নঞর্থকতা কিংবা কোনও ত্রুটি নয়। একাধিক কাব্যগ্রন্থে প্রকাশিত সব কবিতার ৪৭১ পৃষ্ঠার সংকলন - ‘কবিতাসংগ্রহ ১’-এর বিশালতা নিয়ে ব্লার্বের কীই বা করার থাকে? সূচিপত্রই যেখানে ৭ পৃষ্ঠার সেখানে কয়েক পৃষ্ঠার ভূমিকায়ই বা কত কথা আর লেখা যায়? পেশায় ইঞ্জিনিয়ার কবি চিরঞ্জীব হালদারের আলোচ্য কবিতাসংগ্রহটি হচ্ছে এই ধারার প্রথম পর্ব, যেখানে সন্নিবিষ্ট আছে ১১টি কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া শিরোনামযুক্ত ৪৩২টি কবিতার বাইরে ১১৩ পৃষ্ঠাব্যাপী একের পর এক শিরোনামহীন কবিতা।
কবিতার যাত্রাপথ শুরু হয়েছে ১৯৯০-১৯৯৫ এর মধ্যে লেখা কবিতার সমাহার - ‘দু’পায়ের মূর্খ তুমি হাঁটতে শেখো’ গ্রন্থটির অন্তর্গত কবিতা দিয়ে। এরপর ক্রমান্বয়ে আসছে ১৯৯৬-২০০৩ সময়ে প্রকাশিত ‘বাহান্নটা টেক্কা ফিরে ফিরে আসে’, ‘গরলভাষ’ (২০০৯-২০১০), ‘তরাজুপত্রে ভেসে যাও বর্ণমালা’ (২০০৫-২০০৯), অবিনশ্বর সত্যের লণ্ঠন (২০১৩-২০১৪), ‘আমি ঈশ্বরকে ডাউনলোড করেছি’ (২০১০-২০১৪), ‘সহিস ও ঘোড়ার মধ্যবর্তী যে নদী’ (২০১৪-২০১৬), ‘আয় চাঁদ প্রেমিকার কপালে টি দিয়ে যা’ (২০১৭-১৯), ‘ছায়া সেলাই করা মানুষের ঠিকানা’ (২০২০-২০২১), ‘অবিদ্যাবিনোদিনীর পাঠশালা’ (২০২০-২০২১) ও ‘বসন্তবৃক্ষ ও ধ্বনিময় শোক’ (২০২২-২০২৩)। সূচিপত্রানুযায়ী এই তালিকা থেকে খুবই প্রাসঙ্গিক ও প্রণিধানযোগ্য বলে মনে হতে পারে গ্রন্থনাম নিরূপণ। প্রকৃতার্থে প্রতিটি গ্রন্থনামেই রয়েছে এমন এক কাব্যিক উচ্চারণ যা ভেতরের কবিতাসমূহের পাঠপূর্ব এক ধারণা স্বাভাবিক প্রক্রিয়াতেই দানা বাঁধতে সক্ষম পাঠকমননে।
এটাও স্বাভাবিক এবং অনস্বীকার্য যে এই বিশাল সম্ভারে যেহেতু সন্নিবিষ্ট হয়েছে একাধিক গ্রন্থান্তর্গত কবিতা তাই কবিতার স্বরূপ, ভাব, শৈলীও বিস্তৃত তথা সার্বিক হবে। ছন্দ, ছন্দহীনতা, পরিসর (২ লাইন থেকে কয়েক পৃষ্ঠা), গদ্যকবিতা, শব্দ-শব্দদ্বিত্ব-শব্দগুচ্ছের অপরূপ প্রয়োগ, যতিচিহ্নযুক্ত/যতিচিহ্নবিহীন, ভাষাশিল্পের নব নব আঙ্গিক তথা নান্দনিক প্রয়োগ, বিষয়ের/ভাবের সুসংঘবদ্ধ ব্যবহার - সবকিছু মিলিয়ে যে আখ্যাটি সর্বাধিক সার্থকনামা তা হল - ‘অ্যা কমপ্লিট প্যাকেজ’। কবি যেন নির্বিঘ্নে খেলা করেছেন, বলা ভালো জাগলিং করেছেন আপন মনে - অক্ষর, শব্দ, পঙ্ক্তি নিয়ে -
...যদি কাদম্বরী হতে
এক নৌকা সিঁদুর পাঠাতাম।
ওই আঁচল-আঁচল কথোপকথন।
নৌকা ও তুমি।
তার হরফগুলো স্বপ্নের মধ্যে চাঁদিনী জিরাফ।
এই হিজল মোড়।
প্রত্যেকেই এক একটা সুপ্রাচীন পাত্রবদ্ধ সুরা।
এক উৎকৃষ্ট আধার মনষ্কতায় আমৃত্যু উথলে উঠছে। ...
(‘সহিস ও ঘোড়ার মধ্যবর্তী যে নারী’ কাব্যগ্রন্থ থেকে)
মাঝের ২০০৪ বর্ষটি বাদ দিলে ১৯৯০ থেকে ২০২৩ - দীর্ঘ ৩৩ বছরের কবিতা লিখনে কবিতার স্বরূপ যে স্বাভাবিক নিয়মেই বদলাবে তা অনস্বীকার্য। কবিতার শরীরে মেদ ছিল না কদাপি। ফর্ম ও প্যাটার্নের বৈচিত্রে ধীরে ধীরে কবিতা হয়ে উঠেছে অধিক নান্দনিক, অধিক তাৎপর্যবহুল, অধিক শব্দালংকারভূষিত। অথচ গ্রন্থের প্রথমদিককার কবিতাও রয়ে গেছে একই রকম উৎকর্ষযুক্ত, একই রকম সুপাঠ্য, সুখপাঠ্য। সংকলনে সন্নিবিষ্ট প্রতিটি কাব্যগ্রন্থ অনুযায়ী আলোচনা পরিসরের অভাবে নিতান্তই অসম্ভব। তবে এটাও উল্লেখযোগ্য যে প্রতিটি কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত কবিতাই এক নিজস্ব মহিমায় মহিমান্বিত।
সংকলনটির ছাপা, বাঁধাই, অক্ষরবিন্যাস, বর্ণসংস্থাপন সবই যথাযথ। রোচিষ্ণু সান্যালের প্রচ্ছদ প্রাসঙ্গিক ও নান্দনিক। গ্রন্থটি উৎসর্গ করা হয়েছে আবির্ভাব হালদারকে। এছাড়া সংকলনের অন্তর্গত প্রতিটি কাব্যগ্রন্থের আলাদা উৎসর্গ রয়েছে যা লিপিবদ্ধ হয়েছে এক ব্যতিক্রমী ধারায়। ভেতরে নগণ্য সংখ্যক কিছু বানানবিভ্রাট রয়ে গেছে - রয়ে গেছে এমনকি সূচিপত্রে উল্লিখিত কাব্যগ্রন্থের নামেও। এর বাইরে চিরঞ্জীবের আলোচ্য কবিতাসংগ্রহ (প্রথম খণ্ড) গ্রন্থটি যেন কবিতাপথের যাত্রায় এক প্রত্যয় ও নান্দনিকতায় ভরপুর দৃপ্ত পদসঞ্চার যা কবিতার ভাবীকালকে প্রতিষ্ঠিত করবে নতুনতর আঙ্গিক ও গ্রহণযোগ্যতার প্রত্যাশিত শিখরচূড়ায়।
বিদ্যুৎ চক্রবর্তী
প্রকাশক - অক্ষরযাত্রা প্রকাশন, হুগলি
মূল্য - ৬৫০ টাকা
Comments
Post a Comment