Skip to main content

সুপাঠ্য প্রবন্ধ সংকলন ‘দিগ্‌দিগন্ত’


সাহিত্যসৃষ্টির ক্ষেত্রটিতে প্রবন্ধ একটি বিশেষ স্থান অধিকার করে রয়েছে যুগ যুগ ধরে। এ নিয়ে এক ধরনের বিতর্ক বা বলা ভালো রসিকতাও প্রচলিত আছে সাহিত্যসমাজে যে- গল্প, কবিতা, উপন্যাস কিংবা নাটক ইত্যাদির রচনায় যে সৃষ্টিশীলতার প্রয়োজন - প্রবন্ধের ক্ষেত্রে তা নেই। প্রবন্ধ হচ্ছে ইতিপূর্বে বিদ্যমান তথ্যাদির আহরণ ও উপস্থাপন। কথাটি আসলে একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয়। বরং এর বিপরীত বলা হলেও আপত্তির কিছু নেই। প্রবন্ধ রচনার ক্ষেত্রে তথ্যাদি আহরণের বাইরেও রয়েছে তার যথোপযুক্ত উপস্থাপন বা প্রতিস্থাপন যেখানে সৃষ্টিশীল বয়ানে সজ্জিত ও পাঠকের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলার দায় রয়েছে একশভাগ। সেই দায় যথাযথ পালনের মাধ্যমেই এক একটি প্রবন্ধ হয়ে ওঠে সাহিত্যের অঙ্গনে এক একটি মূল্যবান দলিল। তাই কবি, গল্পকারদের পাশাপাশি একজন প্রাবন্ধিকও যে সাহিত্যক্ষেত্রে সমমানবিশিষ্ট স্রষ্টা এতে কোনও সন্দেহ থাকার কথা নয়।
প্রবন্ধ রচনার এই কলাকৌশল ও শৈলীর এক যথাযথ নিদর্শন অনুধাবন করা গেল উত্তরপূর্বের বরাক উপত্যকার হাইলাকান্দি থেকে প্রকাশিত প্রাবন্ধিক মানিক চক্রবর্তীর প্রবন্ধ সংকলন ‘দিগ্‌দিগন্ত’তে। ১৫৬ পৃষ্ঠার পেপারব্যাকে ১৪৪ পৃষ্ঠা জুড়ে রয়েছে মোট ৩৩টি প্রবন্ধ। বিভিন্ন বিষয়ের উপর বহুলাংশেই ব্যতিক্রমী ধাঁচে লেখা এক একটি প্রবন্ধে লেখক মেদবাহুল্য বর্জিত তথ্যের উপযুক্ত সমাহারে লিপিবদ্ধ করেছেন তাঁর রচনা। যতটুকু প্রয়োজন, ঠিক ততটাই - অথচ ভাষায়, উপস্থাপনায় সাজিয়ে, গুছিয়ে।
গ্রন্থে লেখকের তরফে কোনো ভূমিকা না থাকলেও গ্রন্থপাঠের খেই ধরিয়ে দিয়েছেন হাইলাকান্দির শ্রীকিষণ সারদা কলেজের বাংলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক তথা ভূমিকাকার ড. ইন্দিরা ভট্টাচার্য। বিস্তৃত ভূমিকায় তিনি প্রনন্ধসমূহের গভীর পর্যালোচনার অবকাশে লিখছেন - ‘একজন প্রাবন্ধিক তাঁর চিন্তাশক্তি, বুদ্ধিমত্তা ও যুক্তির মাধ্যমে যেকোনো বিষয়কে তাঁর প্রবন্ধে ভাষ্য দিতে পারেন। লেখকের মনস্বিতা ও বিশ্লেষণী দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে প্রবন্ধ সাহিত্যের বিষয় নতুনভাবে বিনির্মিত হতে পারে। ‘দিগ্‌দিগন্ত’ প্রবন্ধ গ্রন্থটি মোট তেত্রিশটি নিবন্ধের একটি সংকলন। লেখক মানিক চক্রবর্তী নিজের মেধা, বিচার-বুদ্ধি প্রয়োগ করেই নিবন্ধগুলো রচনা করেছেন যা বিভিন্ন সময়ে কোনো পত্রিকায় বা কোনো ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়েছে...।’ ভূমিকাকার বেশ কয়েকটি নিবন্ধের সারমর্মের উল্লেখ করে পাঠককে গ্রন্থপাঠে যথাযথভাবেই উৎসাহী করে তোলার চেষ্টা করেছেন।
ভূমিকার পর রয়েছে প্রকাশক সপ্তাশ্ব প্রকাশনীর পক্ষ থেকে সম্পাদক তথা বিশিষ্ট কবি ও লেখক রাণা চক্রবর্তীর একটি ‘লেখক পরিচিতি’ যেখানে উল্লেখ রয়েছে গ্রন্থকারের ব্যক্তিগত ও সামাজিক পরিচিতি তথা তাঁর সাহিত্যকৃতি ও মেধা-মননের বিষয়টি।
আলাদা করে প্রতিটি নিবন্ধের, এমনকী সংক্ষিপ্ত আলোচনাও পরিসরের অভাবে সম্ভব নয়। এবং তার প্রয়োজনও নেই কারণ আগেই বলা হয়েছে প্রতিটি নিবন্ধের বিষয়, ভাষা, শৈলী এক ভিন্নতর আঙ্গিকে হয়ে উঠেছে সুপাঠের আকর। সুচয়িত ও সুলিখিত যে ৩৩টি প্রবন্ধ এখানে সন্নিবিষ্ট হয়েছে তার তালিকায় এ কথাটি প্রতীয়মান হয়ে উঠবে নিশ্চিত। বিবিধ প্রসঙ্গের উপর লেখা নিবন্ধগুলি হচ্ছে - ‘অসমে শক্তিপূজার ক্রমবিকাশ’, ‘আলোর দিশারি : মহাত্মা ডেভিড হেয়ার’, ‘আরণ্যকের একটি চরিত্র’, ‘ইতিহাসে মহামারি’, ‘ঈশ্বরতত্ত্বের মানবীয় প্রতিধ্বনি : ভগবান শ্রীকৃষ্ণ’, ‘উপনিষদ ও রবীন্দ্রনাথ’, ‘উনিশের স্মৃতি’, ‘এক সত্যসন্ধানীর জীবন-যুদ্ধ’, ‘কালী কল্পতরু’, ‘ক্ষুধার পৃথিবী, ‘উদলা চাঁদ আর ঝিঙেফুলের কবি ব্রজেন্দ্রকুমার সিংহ’, ‘জল পড়ে পাতা নড়ে’, ‘তন্ত্র : দর্শন ও বিজ্ঞানের যুগলবন্দি’, ‘দুর্গাপূজা - জড়ত্ব থেকে চৈতন্যে উত্তরণ’, ‘দীপান্বিতা - পুরাণে, ইতিহাসে’, ‘দুর্গাপ্রতিমার বিজ্ঞান ও রূপক’, ‘দণ্ডিতের সাথে দণ্ডদাতা যবে কাঁদে’, ‘নিম্বার্কাচার্য ও নিম্বার্ক দর্শন’, ‘পান্থজনের সখা’, ‘পৌরাণিক আখ্যানে গুরুপূর্ণিমা’, ‘পতিতপাবন শ্রীরাধারমণ’, ‘ব্যাসদেব - এক বিশাল অভ্যুদয়’, ‘মাতৃপূজায় আত্মতত্ত্বের সাধন’, ‘মানবধর্ম’, ‘মোগল হারেমের কবি জেব-উন-নিসা’, ‘যোগীশ্বর’, ‘রথাগ্রে শ্রীচৈতন্য’, ‘শ্যামা মা উড়াচ্ছ ঘুড়ি’, ‘’শক্তিবাদ : বিজ্ঞানে, অধ্যাত্মভাবনায়’, ‘সম্প্রীতির আলেখ্য - আজান ফকিরের জিকির’, ‘সোশ্যাল মিডিয়া ডেকে আনছে সামাজিক অস্থিরতা’, ‘সত্যপথের তিন অভিযাত্রী’, ‘স্বদেশ চেতনার দিশারি - শ্রী অরবিন্দ’ ও ‘হিন্দুধর্মে যজ্ঞভাবনা’।
উপর্যুক্ত তালিকা ও শিরোনামসমূহ দেখে সহজেই অনুমেয় যে অধিকাংশ প্রবন্ধই অধ্যাত্মভাবনা সম্বন্ধীয়। যদিও রয়েছে একাধিক ভাবনান্তরের বিষয়। কিছু প্রবন্ধ অধিক বিস্তৃতির দাবি রাখে নিশ্চিত। গ্রন্থের কাগজের মান, ছাপা, অক্ষরবিন্যাস যথাযথ হলেও বানানের ক্ষেত্রে রয়ে গেছে অনেক ত্রুটি যা পরবর্তী সংস্করণে সংশোধনের দাবি রাখে। এমনকী কিছু প্রবন্ধের শিরোনাম ও প্রচ্ছদ-নামলিপিও এর বাইরে থেকে থাকেনি। লেখকের স্বকৃত প্রচ্ছদ প্রাসঙ্গিক ও নান্দনিক যা গ্রন্থের মর্যাদা বৃদ্ধি করেছে নি:সন্দেহে। গ্রন্থটি লেখক উৎসর্গ করেছেন তাঁর - ‘মাতৃদেবীর চরণ কমলে...’। সব মিলিয়ে এক সুপাঠ্য ও সুখপাঠ্য প্রবন্ধ সংকলন - ‘দিগ্‌দিগন্ত’।
বিদ্যুৎ চক্রবর্তী
মূল্য - ২০০ টাকা
যোগাযোগ - ৯৯৫৪৫৫২৯৭৬

Comments

Popular posts from this blog

শেকড়ের টানে নান্দনিক স্মরণিকা - ‘পরিযায়ী’

রামকৃষ্ণনগর । প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আবহে বরাক উপত্যকার এক ঐতিহ্যময় শহর । বিশেষ করে শিক্ষাদীক্ষার ক্ষেত্রে চিরদিনই এক অগ্রণী স্থান হিসেবে উচ্চারিত হয়ে আসছে এই নাম । বৃহত্তর রামকৃষ্ণনগরের গোড়াপত্তনের ইতিহাস বহুদিনের । দেশভাগের আগে ও পরে , উত্তাল সময়ে স্থানচ্যূত হয়ে এখানে থিতু হতে চাওয়া মানুষের অসীম ত্যাগ ও কষ্টের ফলস্বরূপ গড়ে ওঠে এক বিশাল বাসযোগ্য অঞ্চল । শুধু রুটি , কাপড় ও ঘরের স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রই নয় , এর বাইরে শিক্ষা অর্জনের ও শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে মমনশীলতার পরিচয় দিয়েছিলেন সেইসব মহামানবেরা । ফলস্বরূপ এক শিক্ষিত সমাজব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল যদিও উচ্চশিক্ষার জন্য পরবর্তী প্রজন্মকে বেরোতে হয়েছিল নিজ বাসস্থান ছেড়ে । শিলচর তখন এ অঞ্চলের প্রধান শহর হওয়ায় স্বভাবতই শিক্ষা ও উপার্জনের স্থান হিসেবে পরিগণিত হয় । এবং স্বভাবতই রামকৃষ্ণনগর ছেড়ে এক বৃহৎ অংশের মানুষ এসে পাকাপাকিভাবে থাকতে শুরু করেন এই শিলচরে । এই ধারা আজও চলছে সমানে । শিলচরে এসেও শেকড়ের টানে পরস্পরের সাথে যুক্ত থেকে রামকৃষ্ণনগর মূলের লোকজনেরা নিজেদের মধ্যে গড়ে তোলেন এক সৌহার্দমূলক বাতাবরণ । এবং সেই সূত্রেই ২০০০ সালে গঠিত হয় ‘ ...

কবির মজলিশ-গাথা

তুষারকান্তি সাহা   জন্ম ১৯৫৭ সাল৷ বাবা প্ৰয়াত নিৰ্মলকান্তি সাহা ও মা অমলা সাহার দ্বিতীয় সন্তান   তুষারকান্তির ৮ বছর বয়সে ছড়া রচনার মাধ্যমে সাহিত্য ভুবনে প্ৰবেশ৷ ‘ ছায়াতরু ’ সাহিত্য পত্ৰিকায় সম্পাদনার হাতেখড়ি হয় কলেজ জীবনে অধ্যয়নকালীন সময়েই৷ পরবৰ্তী জীবনে শিক্ষকতা থেকে সাংবাদিকতা ও লেখালেখিকেই পেশা হিসেবে গ্ৰহণ করেন৷ প্ৰথম ছড়া প্ৰকাশ পায় সাতের দশকে ‘ শুকতারা ’ য়৷ এরপর ‘ দৈনিক যুগশঙ্খ ’ পত্ৰিকার ‘ সবুজের আসর ’, দৈনিক সময়প্ৰবাহ ও অন্যান্য একাধিক কাগজে চলতে থাকে লেখালেখি৷ নিম্ন অসমের সাপটগ্ৰামে জন্ম হলেও বৰ্তমানে গুয়াহাটির স্থায়ী বাসিন্দা তুষারকান্তির এ যাবৎ প্ৰকাশিত গ্ৰন্থের সংখ্যা ছয়টি৷ এগুলো হচ্ছে নগ্ননিৰ্জন পৃথিবী (দ্বৈত কাব্যগ্ৰন্থ) , ভবঘুরের অ্যালবাম (ব্যক্তিগত গদ্য) , একদা বেত্ৰবতীর তীরে (কাব্যগ্ৰন্থ) , প্ৰেমের গদ্যপদ্য (গল্প সংকলন) , জীবনের আশেপাশে (উপন্যাস) এবং শিশু-কিশোরদের জন্য গল্প সংকলন ‘ গাবুদার কীৰ্তি ’ ৷ এছাড়াও বিভিন্ন পত্ৰপত্ৰিকায় প্ৰকাশিত হয়েছে শিশু কিশোরদের উপযোগী অসংখ্য অগ্ৰন্থিত গল্প৷ রবীন্দ্ৰনাথের বিখ্যাত ছড়া , কবিতা ও একাধিক ছোটগল্প অবলম্বনে লিখেছেন ...

শুদ্ধ বানানচর্চার প্রয়োজনীয়তা ও সচেতনতা

উত্তরপূর্বের বাংলা সাহিত্যচর্চার পরিসরকে কেউ কেউ অভিহিত করেন তৃতীয় ভুবন বলে , কেউ আবার বলেন ঈশান বাংলা । অনেকেই আবার এই জাতীয় ভুবনায়নকে তীব্র কটাক্ষ করে বলেন - সাহিত্যের কোনও ভুবন হয় না । সাহিত্যকে ভৌগোলিক গণ্ডির মধ্যে আটকে রাখা যায় না । কারও ব্যক্তিগত অভিমতের পক্ষে বা বিপক্ষে বলার কিছুই থাকতে পারে না । যে যেমন ভাবতে বা বলতেই পারেন । কিন্তু প্রকৃত অবস্থাটি অনুধাবন করতে গেলে দেখা যায় বাংলার এই যে অখণ্ড বিশ্বভুবন সেখানে কিন্তু কয়েকটি স্পষ্ট বিভাজন রয়েছে । আঞ্চলিক ভাষায় বাংলা সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রটি ধর্তব্যের মধ্যে না আনলেও মান্য বাংলা চর্চার ক্ষেত্রে আমরা প্রথমেই দেখব যে বাংলাদেশের বাংলা ও পশ্চিমবঙ্গের বাংলার মধ্যে শব্দরূপ তথা গৃহীত বানানের ক্ষেত্রেও বহু তারতম্য রয়েছে । সংলাপ বা প্রেক্ষাপট অনুযায়ী মান্য বাংলারও ভিন্ন ভিন্ন রূপের প্রয়োগ দেখতে পাওয়া যায় । যেমন পানি / জল , গোসল / স্নান , নাস্তা / প্রাত : রাশ ইত্যাদি । সেসবের উৎস সন্ধানে না গিয়ে শুধু এটাই বলার যে বাংলা সাহিত্য চর্চার ক্ষেত্রে আঞ্চলিকতা এক অমোঘ পর্যায় । বিহার / ঝাড়খণ্ডের বাংলা আর নিউইয়র্কের বাংলা এক হলেও সাহিত্যে তা...