Skip to main content

দ্বৈত সম্পাদনায় মহৎ উদ্যোগ ‘উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বাংলা সাহিত্যচর্চা (খণ্ডিত) - একটি প্রবন্ধ সংকলন’


জ্যাকেট কভারের দুই ব্লার্বে রয়েছে দুই সম্পাদকের সচিত্র পরিচিতি। উত্তরপূর্বের সমকালিক বাংলা সাহিত্যচর্চার স্বরূপ উদ্ঘাটনের লক্ষ্যে গবেষক, আলোচক ও সম্পাদক ড. বাপি চন্দ্র দাস ও নিত্যানন্দ দাস যে পদক্ষেপ নিয়েছেন তারই ফলস্বরূপ সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে যে আলোচ্য গ্রন্থটি তার শিরোনামেই বর্ণিত আছে সেই উদ্দেশ্য যদিও এই বিশাল সাহিত্যবিশ্ব থেকে তুলে আনা মোট আঠারোটি গ্রন্থ বা রচনার আলোচনামূলক নিবন্ধের মাধ্যমে এই লক্ষ্যের কত শতাংশ পূরণ করা যায় সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ রয়েছে নিশ্চিতভাবেই। তবু স্বস্তির বিষয় এই যে অন্তত মূল্যায়ন বা বহিরাঞ্চলে পরিচিতির এক মহৎ উদ্যোগ তো হাতে নেওয়া হয়েছে। এই উদ্যোগও যে প্রথম তাও নয়। ইতিমধ্যেই এই বিষয়ক আলোচনা বা বিশ্লেষণধর্মী প্রবন্ধনিবন্ধ তথা সংকলন প্রকাশিত হয়েছে। তবু এটাও সত্য এ নিয়ে যত কাজ হবে সবই আখেরে ফলদায়ক তথা আবশ্যক। উত্তরপূর্বের কবি-সাহিত্যিকদের সত্যিকারের মূল্যায়ন যে আজও বৃহত্তর সাহিত্যভুবনে যথাযথ মর্যাদায় হয়নি তাতে কোনও সন্দেহ থাকার কথা নয়। এমন একটি সংকলন গ্রন্থ প্রকাশ করা সহজ কথা নয় মোটেও। কারণ এর মাধ্যমে স্থান ও কালভিত্তিক সাহিত্যচর্চার এক ঐতিহাসিক মূল্যায়ন আবিশ্ব পাঠকের দরবারে তুলে ধরা হয়। সেক্ষেত্রে লেখার মান ও বিষয় বিশেষ উপযুক্ততার দাবি রাখে। অন্যথায় বহিরাঞ্চলে এক ভুল বার্তা পৌঁছে যাওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়। সেই দিকে সংকলক বা সম্পাদকদের দায়বদ্ধতা অস্বীকার করার নয়।  
এখানে পরকৃত ভূমিকার পরিবর্তে সন্নিবিষ্ট প্রতিটি নিবন্ধের সংক্ষিপ্ত সারমর্ম সহ আলোচ্য গ্রন্থের বিষয়ে এক সার্বিক ধারণা তুলে ধরা হয়েছে প্রথমেই সম্পাদকদ্বয়ের তরফে - ‘সম্পাদকীয় কলমে’ শিরোনামে। কিছু উদ্ধৃতি সেখান থেকে - ‘...উত্তর-পূর্ব ভারতের সাহিত্য-সংস্কৃতি নিয়ে চিন্তাচর্চা হচ্ছে প্রতিনিয়ত। কিন্তু তার বিচ্ছুরণ অসমাপ্ত। বিশ্বায়ন, ডিজিটাল সমাজ ব্যবস্থা, মূল্যবোধের অবক্ষয়ে সমাজ প্রতিনিয়ত তার খোলস বদলাচ্ছে। ফলে সমাজ নিরীক্ষক কবি সাহিত্যিক পেয়ে যান তাঁর সৃষ্টির নতুন উপাদান। এতে ক্ষেত্র তৈরি হয়ে যায় তার সমালোচনার। উত্তর-পূর্ব ভারতের সাহিত্যকে একুশ শতকের সমালোচক মানসে বিচার-বিশ্লেষণে তাই আমরা সংকল্পবদ্ধ হয়েছি। মোট আঠারো জন প্রাবন্ধিক আলোচ্য গ্রন্থে কবিতা, গল্প, নাটক ও উপন্যাস ইত্যাদি বিষয়ে অনুসন্ধানমূলক বিচার-বিশ্লেষণ করে গ্রন্থটিকে সমৃদ্ধ করেছেন। ... উত্তর-পূর্বের রাজনীতির গতি-প্রকৃতি, সামাজিক নিয়ম-বিধি, ভাষা আগ্রাসন, সাহিত্যে আঞ্চলিক ভাষা, উপন্যাস-গল্পের ভাষা শৈলী, কবিতার স্বরূপ, সামাজিক বিপর্যয়, উদ্‌বাস্তু সমস্যা, নারীর সামাজিক অবস্থান, মূল্যবোধের অবক্ষয়, লিটল ম্যাগাজিনের ভূমিকা, স্বাধীনতা সংগ্রাম, দেশভাগ, বাঙালির সাম্প্রতিক জীবন-যন্ত্রণা, মধ্যবিত্তের অস্তিত্ব সংকট ও যৌন কদাচার ইত্যাদি বিষয়ে লেখক, প্রাবন্ধিক, গবেষক কর্তৃক যুক্তিসংগত ও নান্দনিক বিচার বিশ্লেষণ হওয়ায় উত্তর-পূর্বের একটি সার্বিক বৌদ্ধিক ক্ষেত্র-পরিসর আমাদের সম্মুখে উদ্ভাসিত হয়...।’
এছাড়াও সম্পাদকীয় কলমের এই বিস্তৃত দুই পৃষ্ঠা জোড়া বর্ণনার মধ্যে আছে একের পর এক আঠারোটি নিবন্ধের প্রতিটি নিয়ে দু-এক লাইন কথামুখ। তবে নিবন্ধসমূহের নিবদ্ধ পাঠের পর আমরা এক এক করে প্রতিটি অধ্যায়ের ভিতরে প্রবেশ করলে যা পাই তা এরকম -
১। ড. বাপি চন্দ্র দাস-এর ‘বরাক উপত্যকার জনবিন্যাসের নিরিখে কাব্যচর্চা’ - যদিও মূলত বরাকের কাব্যচর্চা বিষয়ক এই নিবন্ধ তবু বলা যায় এই দিকটিতে আলোচক কম আলোকপাত করেছেন। তিনি মূলত বরাকের ভাষা যে বাংলা সেই কথাটি তথ্যাদি সহকারে প্রতিপন্ন করতেই অধিক সচেষ্ট থেকেছেন। কাব্যচর্চার প্রসঙ্গে কম কথা হলেও কিছু স্বল্পশ্রুত কবির নামোল্লেখ নিঃসন্দেহে ব্যতিক্রমী। পাশাপাশি পরিসরের স্বল্পতায় বাদও পড়েছে বহু প্রথিতযশা কবির নাম। তবু বলা যায় আঠারোটির মধ্যে অন্যতম উৎকৃষ্ট একটি নিবন্ধ।
২। ড. নন্দিতা দাসের নিবন্ধ - ‘কবি তপোধীর ভট্টাচার্যের কবিতায় নাগরিক জীবনের আর্তনাদ’। শিক্ষাবিদ, প্রাবন্ধিক তপোধীর ভট্টাচার্যের কাব্যগুণ সম্পর্কিত আলোচনার সংখ্যা এযাবৎ নিতান্তই সীমিত। এটা দুর্ভাগ্যজনক। সেই হিসেবে এক সাধু প্রয়াস নিঃসন্দেহে। এখানে নাগরিক জীবনের আর্তনাদেই সীমাবদ্ধ থাকেননি নিবন্ধকার। কবির বিভিন্ন অনুষঙ্গের কবিতাগুলিও এসেছে স্বতঃস্ফুর্তভাবে। এবং এটাই স্বাভাবিক কারণ একজন কবিকে কোনও এক বিশেষ অনুষঙ্গের কবি হিসেবে আখ্যায়িত করা যায় না। কবির কবিতা সততই বহুমুখী।
৩। পঙ্কজ কান্তি মালাকার লিখেছেন - ‘আদিমা মজুমদারের ‘অস্ফুটে দ্রোহ’ : অবলার দ্রোহ কাব্যে বলা’। একটু হলেও কেমন অপরিণত শিরোনাম। সংকলন গ্রন্থে আলোচনার পরিসর বৃহৎ। পত্রপত্রিকায় সেই সুযোগ নেই। পঙ্কজ আলোচ্য গ্রন্থটির যথাযথ আলোচনা করেছেন বিষয়কে অগ্রাধিকার নিয়ে। এখানে কাব্যশৈলীর প্রসঙ্গ আনেননি এবং আলোচনা খানিকটা বিস্তৃত হতেও পারত আরোও কিছু কবিতাকে সামনে এনে।
৪। জুলি আখতারীর নিবন্ধ ‘উত্তর-পূর্ব ভারতের বাংলা কবিতায় লিটিল ম্যাগাজিন’। প্রথমেই প্রশ্ন জাগে ‘লিটিল’ কেন ? ‘লিটল’ বা ‘লিট্‌ল’ নয় কেন ? অথচ নিবন্ধে ‘লিটল’ও আছে। অনেকেই ‘আঁতুড়ঘর’কে কেন যে ‘আঁতুরঘর’ লিখেন তা বোধ্য নয়। অথচ উপর্যুপরি আছে তা। বরাক উপত্যকাকে বাড়া বা বারাক উপত্যকা কেন ? ‘ড়’ ও ‘র’-এর একাধিক স্থানচ্যুতি। সে যাই হোক বানান ইত্যাদির কথায় পরে আসা যাবে। এই বিশাল বিষয়টিকে এত কম পরিসরে নামিয়ে আনা প্রায় অসাধ্য। তাই স্বভাবতই বাদ পড়েছে বহু ম্যাগাজিনের নাম। সব মিলিয়ে সাধু প্রচেষ্টা বলা যায়।
৫। পরবর্তী নিবন্ধ বিদ্যুৎ চক্রবর্তীর ‘মিথিলেশ ভট্টাচার্যের ‘শ্রেষ্ঠ গল্প’ : গল্পবিশ্বে সাহিত্যসুধা’। পরিসর বিস্তৃত হলে গল্পসমূহের নির্যাস অধিকতর গ্রহণের সুযোগ ছিল।
৬। আঞ্জু মনোয়ারা বেনজির চৌধুরীর ‘বদ্‌রুজ্জামান চৌধুরীর ছোটগল্পে সমাজ বাস্তবতা’। জ্যেষ্ঠ সাহিত্যিক বদরুজ্জামানের গল্পবিশ্বে বরাকের আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি ও বেদনার যে প্রতিবিম্ব দর্শিত হয় তা নিয়ে সীমিত পরিসরে যথাযোগ্য আলোচনা।
৭। অঙ্কিতা গুহ লিখেছেন - ‘শ্যামলেন্দু চক্রবর্তীর গল্পে ‘অপরাধ’ প্রসঙ্গ’। শ্যামলেন্দুর ‘অক্টোপাশ’ গল্প বহুচর্চিত ও নন্দিত গল্প। ব্যতিক্রমী বিষয় ও প্রসঙ্গ। কবিই নন শুধু, গল্পকাররাও একই বিষয়ের উপর থেমে থাকেন না। ফলত একটি বিষয়ের উপর গল্পের সংখ্যা অধিক থাকে না। নিবন্ধকার তাই বিন্দু থেকে সিন্ধু রচনার যে প্রয়াস করেছেন তা প্রশংসার্হ।
৮। নিবন্ধ - ‘এক মৃত্যুমুখীর আত্মকথনে দেবব্রত দেবের ‘বিষকরবী কথা’ : মধ্যবিত্ত যৌন জীবনের বিকৃত মুখ ও মুখোশ’। নিবন্ধকার মহেন্দ্র নাথ পাল। গল্পকার ও তাঁর বিষয়ভিত্তিক গল্প নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা। এখান একটি কথার উল্লেখ অপরিহার্য। একজন গল্পকার ক্ষুদ্র থেকে বৃহৎ যেকোনও বিষয় নিয়ে গল্প লিখতেই পারেন। আলোচনার জন্য কোন বিষয়ের প্রাসঙ্গিকতা কতটুকু সেই সিদ্ধান্ত আলোচকের। গল্পের ভাষা, সংলাপ, চলমানতা এবং গল্পের মূল ভাববিষয়ক উল্লেখ এই নিবন্ধে সেরকম ভাবে উঠে আসেনি বলে প্রতীয়মান হয়েছে।
৯। ‘শর্মিলা দত্তের ছোটগল্প : একটি ভিন্ন পাঠ’, নিবন্ধকার সঙ্গীতা কর - শুরুতেই ‘উনি’, ‘উনার’ ইত্যাদি ভুল শব্দের উল্লেখ এড়িয়ে গেলে পাওয়া যাবে ‘শর্মিলা দত্তের গল্প গুলির মধ্যে যেন অনেকটাই বাস্তব।’ বা ‘ছেলেকে নিয়ে চিন্তা মঙ্গলমাভ (বিশুর মা) হয়েছে অনেকটা।’ - জাতীয় কিছু অবোধ্য, অসম্পূর্ণ বাক্য যা বজায় থেকেছে আগাগোড়া। তবু নিবন্ধকার চেষ্টা করেছেন উপলব্ধ সম্ভারের যতটা সম্ভব গভীরে প্রবেশ করার।
১০। ড. পারমিতা আচার্য লিখেছেন ‘দীপঙ্কর করের ‘হুমকির পরে কী ঘটে’ : একটি বিশ্লেষণাত্মক আলোচনা’। একটি বহিচর্চিত গল্প। নিবন্ধে যে সময়কালকে সত্তরের দশক বলে অভিহিত করা হয়েছে তা সম্ভবত আশির দশক হবে। একটি গল্পের আলোচনায় ব্র্যাকেটে পৃষ্ঠা সংখ্যা ১২৫ বা ১২৮ কী করে এল ? এর বাইরে আলোচনা হয়েছে সরল ও মূল্যবান।
১১। ‘শিলঙের গল্পকার উমা পুরকায়স্থের ‘লালসূর্য’ : একটি আলোচনা’। নিবন্ধকার ড. অগ্নিমিত্রা পাণ্ডা। স্বল্প পরিসরে নিবন্ধকার অত্যন্ত পারিপাট্যের মধ্যে একটি পুরো গল্পকে তুলে ধরেছেন। আলোচনার অর্ধেক পর্বই ভূমিকায় সম্পৃক্ত থাকায় স্বল্প পরিসরে গল্পের ‘কাহিনি’ অংশটুকুই প্রাধান্য পেয়েছে। আলোচনার আঙ্গিকে বিস্তৃত বিশ্লেষণের সুযোগ থাকেনি। তবু চরিত্রের বিশ্লেষণ ছুঁয়ে গেছেন কিছুটা হলেও।
১২। অন্যতম সম্পাদক নিত্যানন্দ দাসের নিবন্ধের শিরোনাম ‘বাঙালি জীবনের সাম্প্রতিক যন্ত্রণা : প্রসঙ্গ জ্যোতির্ময় সেনগুপ্তের ‘শিকড়ের নথিপত্র’ ও ‘লক্ষ্মীর পাঁচালি’। কয়েকটি বাক্য উল্লেখনীয় - ‘তাঁর (গল্পকারের) দুটি চোখ। একটিতে দেখেন এবং আরেকটিতে তাদের ফ্রেমে ধরেন। গল্পকে ছবি অবধি নিয়ে যাওয়ায় তাঁর দক্ষতা সর্বাধিক...’, ‘অসমের বাঙালি সমাজের দুঃখ-দুর্দশার এক জ্বলন্ত দলিল ‘শিকড়ের নথিপত্র’ গল্প...’। দেশভাগের উপর অদ্যাবধি যে সমস্ত লেখালেখি হয়েছে তার সবই শুধু দুঃখ দুর্দশার দলিল। গল্পকারের গল্পে প্রতিবাদ কতড়ুকু সাব্যস্ত হয়েছে কিংবা অপরাধী কতটা শনাক্ত হয়েছে সেই ইঙ্গিত আলোচনায় গুরুত্ব পায়নি। তবে দুটি গল্পেরই যাথার্থ্য নিরুপণে লেখক সফল হয়েছেন।
১৩। ড. হামিদা খাতুন লিখেছেন ‘ত্রিপুরার বাংলা ছোটগল্পে জনজাতি সংস্কৃতি’। এ নিয়ে খুব বেশি গল্প হয়তো রচনা হয়নি তবে বেশ কিছু সাড়া জাগানো গল্প প্রকাশিত হয়েছে। এবং তার প্রায় সবটুকু সন্নিবিষ্ট করে যথাসম্ভব আলোচনা সেরেছেন নিবন্ধকার।
১৪। মোনালিসা ঘোষের নিবন্ধ ‘মালিনীর উপাখ্যান : নিরক্ষরতার আঁধার বনাম শিক্ষার আভা’। ‘কাওর কাওর বা কাউর’ (কারো কারো}, ‘আগে দেখতে পাব’ (পরবর্তীতে দেখতে পাব} জাতীয় শব্দের বিড়ম্বনা দিয়ে শুরু হওয়া এই নিবন্ধ মনে হয় সম্পাদনার আওতার বাইরেই থেকে গেছে। একটি ঐতিহাসিক উপন্যাসের আলোচনার ধারা সরলরৈখিকভাবে এগোলেও এখানে কাহিনিকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। ভাব, ভাষা, শৈলীকে নয়।
১৫। নিবন্ধ ‘শেখর সাশের ‘বিন্দু বিন্দু জল’ : গঠনশৈলী প্রসঙ্গে কিছু কথা’ লিখেছেন প্রসেনজিৎ দাশগুপ্ত। উপন্যাস বা গল্প লিখনে শৈলীর কথা রচনাকারের কতটা ধর্তব্যের মধ্যে আসে তা এক বিতর্কিত বিষয় হলেও আলোচকের দায় থাকে সেসব চুলচেরা বিশ্লেষণ করার। নিবন্ধকার এখানে গবেষকের দায়বদ্ধতা নিয়ে শিরোনাম অনুযায়ী গোটা বিষয়টিকে উদাহরণস্বরূপ দেখিয়েছেন। যথার্থ কাজ নিঃসন্দেহে।
১৬। তৃপ্তি দাস-এর নিবন্ধ ‘ব্যতিক্রমী নারী : প্রেক্ষিত ‘বিলোরিস’ উপন্যাস’। চার পৃষ্ঠায় চমৎকার মুনশিয়ানায় আস্ত একটি উপন্যাসকে বিবৃত করেছেন নিবন্ধকার। তবে এটি উপন্যাসের সার্বিক আলোচনা নয়, শিরোনাম অনুযায়ী নারী মননের প্রেক্ষিতে এক বাহুল্যবর্জিত আত্মসমীক্ষামূলক বিশ্লেষণ।
১৭। বিশাল পাল লিখেছেন ‘রণবীর পুরকায়স্থের ‘সুরমা গাঙর পানি’ উপন্যাসে আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহার। ভিন্ন ভিন্ন আবহে সিলেটের আঞ্চলিক ভাষার প্রয়োগকে বিস্তৃত আঙ্গিকে ধৈর্য সহকারে তুলে ধরেছেন নিবন্ধকার।
১৮। শেষ নিবন্ধ ‘প্রদ্যোৎ চক্রবর্তীর ‘গুণধরের অসুখ’ নাটকের বিশ্লেষণাত্মক অধ্যয়ন’। নিবন্ধকার জয়ন্তী মজুমদার। প্রথমেই নাটকের বিষয়বস্তুর বর্ণনা ভূমিকা হিসেবে তুলে ধরা হলে আলোচনা সহজ হতো পাঠকের জন্য। অন্যথা কিছু অসংলগ্ন বাক্য বিন্যাস এবং একই কথার/বিষয়ের পুনরাবৃত্তিজনিত বর্ধিত পরিসর পূর্ণপাঠবিমুখ করে তুলতে পারে পাঠককে। নিবন্ধকার অবশ্য কলম ধরেছেন নাটকের বিভিন্ন দিক নিয়ে। প্রচেষ্টা প্রশংসাযোগ্য।
প্রতিটি নিবন্ধের আলোচনার শেষে যে সারসত্য উঠে আসে তার মধ্যে আছে -
(১) বরাক এবং ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার যেসব গ্রন্থ বা গল্পের আলোচনা সচরাচর সংকলনসমূহে দেখতে পাওয়া যায় তার বাইরে আমাদের পাঠ্যজগৎ প্রসারিত হতে পারেনি। সাড়া জাগানো এবং উন্নত মানের নতুন নতুন গ্রন্থ (কবিতা, গল্প, উপন্যাস) রচনা হচ্ছে কিন্তু সেসব থেকে যাচ্ছে আলোচনার বাইরে। হাতে গোনা কিছু গ্রন্থেরই পালাক্রমে আলোচনা প্রকাশিত হচ্ছে। এটা পরিতাপের বিষয়। পাঠক, গবেষকদের পাঠপরিসর বর্ধিত হওয়াটা বাঞ্ছনীয়।
(২) আলোচ্য গ্রন্থের প্রায় প্রতি পৃষ্ঠায় বানান ভুল, অসংলগ্ন বাক্য ও শব্দ বিন্যাস এতটাই বেশি যে বাক্যের অর্থ পালটে গেছে, অবোধ্য থেকে গেছে। এদিকে অধিকতর মনোযোগী না হলে এক ভুল বার্তা পৌঁছে যাবে ভৌগোলিক সীমানার বাইরে। পরবর্তীতে এ নিয়ে অধিক সচেতনতার প্রয়োজন রয়েছে। এই গ্রন্থেরই একটি জায়গায় রয়েছে - Quality matters, not the quantity. একটি আলোচনামূলক সংকলন গ্রন্থের ক্ষেত্রে এটাই শেষ কথা।
কাগজ, ছাপার স্পষ্টতা, বাঁধাই যথাযথ। প্রাসঙ্গিক প্রচ্ছদ পরিকল্পনায় সম্পাদকদ্বয়। শেষ পৃষ্ঠার লেখক পরিচিতিও প্রাসঙ্গিক। নগাঁও-এর আনন্দ প্রকাশ কর্তৃক প্রকাশিত গ্রন্থটি উৎসর্গ করা হয়েছে ড. শিবতপন বসু ও নাছিম মজুমদারকে। তাঁদের নামের আগে পরিচিতিসুলভ দুটি শব্দ সংযোজন করাই যেত। সব মিলিয়ে দ্বৈত সম্পাদনায় এক মহৎ উদ্যোগ নিঃসন্দেহে।
বিদ্যুৎ চক্রবর্তী
মূল্য - ২৫০ টাকা।
যোগাযোগ - ৮৬৩৮২৭৯৬৯৯

Comments

Popular posts from this blog

উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বাংলা গল্প : বিষয়ে বিশ্লেষণে

একক কিংবা যৌথ সম্পাদনায় বিগত কয়েক বছরে উত্তরপূর্বের বাংলা লেখালেখি বিষয়ক একাধিক গ্রন্থ সম্পাদনা করে এই সাহিত্যবিশ্বকে পাঠকের দরবারে পরিচিত করিয়ে দেওয়ার এক প্রচেষ্টা করে যাচ্ছেন নিবেদিতপ্রাণ তরুণ লেখক ও সম্পাদক নিত্যানন্দ দাস । হালে এপ্রিল ২০২৪ - এ প্রকাশিত হয়েছে তাঁর সম্পাদনা গ্রন্থ ‘ উত্তর - পূর্বাঞ্চলের বাংলা গল্প : বিষয়ে বিশ্লেষণে ’ ( প্রথম খণ্ড ) । প্রকাশক - একুশ শতক , কলকাতা । আলোচ্য গ্রন্থটিতে দুই ছত্রে মোট ২৮ জন বিশিষ্ট প্রাবন্ধিকের ২৮টি প্রবন্ধ রয়েছে । উপযুক্ত বিষয় ও আলোচকদের নির্বাচন বড় সহজ কথা নয় । এর জন্য প্রাথমিক শর্তই হচ্ছে নিজস্ব জ্ঞানার্জন । কালাবধি এই অঞ্চল থেকে প্রকাশিত উৎকৃষ্ট সাহিত্যকৃতির সম্বন্ধে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল না হলে তা সম্ভব নয় মোটেও । নিত্যানন্দ নিজেকে নিমগ্ন রেখেছেন গভীর অধ্যয়ন ও আত্মপ্রত্যয়কে সম্বল করে তা বলার অপেক্ষা রাখে না । আলোচ্য গ্রন্থের ভূমিকা লিখেছেন প্রতিষ্ঠিত কথাকার রণবীর পুরকায়স্থ । বস্তুত সাত পৃষ্ঠা জোড়া এই ভূমিকা এক পূর্ণাঙ্গ আলোচনা । ভূমিকা পাঠের পর আর আলাদা করে আলোচনার কিছু থাকে না । প্রতিটি নিবন্ধ নিয়ে পরিসরের অভাবে সংক্ষিপ্ত হলেও ...

শেকড়ের টানে নান্দনিক স্মরণিকা - ‘পরিযায়ী’

রামকৃষ্ণনগর । প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আবহে বরাক উপত্যকার এক ঐতিহ্যময় শহর । বিশেষ করে শিক্ষাদীক্ষার ক্ষেত্রে চিরদিনই এক অগ্রণী স্থান হিসেবে উচ্চারিত হয়ে আসছে এই নাম । বৃহত্তর রামকৃষ্ণনগরের গোড়াপত্তনের ইতিহাস বহুদিনের । দেশভাগের আগে ও পরে , উত্তাল সময়ে স্থানচ্যূত হয়ে এখানে থিতু হতে চাওয়া মানুষের অসীম ত্যাগ ও কষ্টের ফলস্বরূপ গড়ে ওঠে এক বিশাল বাসযোগ্য অঞ্চল । শুধু রুটি , কাপড় ও ঘরের স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রই নয় , এর বাইরে শিক্ষা অর্জনের ও শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে মমনশীলতার পরিচয় দিয়েছিলেন সেইসব মহামানবেরা । ফলস্বরূপ এক শিক্ষিত সমাজব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল যদিও উচ্চশিক্ষার জন্য পরবর্তী প্রজন্মকে বেরোতে হয়েছিল নিজ বাসস্থান ছেড়ে । শিলচর তখন এ অঞ্চলের প্রধান শহর হওয়ায় স্বভাবতই শিক্ষা ও উপার্জনের স্থান হিসেবে পরিগণিত হয় । এবং স্বভাবতই রামকৃষ্ণনগর ছেড়ে এক বৃহৎ অংশের মানুষ এসে পাকাপাকিভাবে থাকতে শুরু করেন এই শিলচরে । এই ধারা আজও চলছে সমানে । শিলচরে এসেও শেকড়ের টানে পরস্পরের সাথে যুক্ত থেকে রামকৃষ্ণনগর মূলের লোকজনেরা নিজেদের মধ্যে গড়ে তোলেন এক সৌহার্দমূলক বাতাবরণ । এবং সেই সূত্রেই ২০০০ সালে গঠিত হয় ‘ ...

প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'স্বপ্নতরী'

  স্বপ্নতরী                         বিদ্যুৎ চক্রবর্তী   গ্রন্থ বিপণী প্রকাশনা  বাবা - স্বর্গীয় সুধীর চন্দ্র চক্রবর্তী মা - শ্রীমতী বীণাপাণি চক্রবর্তী               জনম দিয়েছ মোরে এ ভব ধরায় গড়েছ সযতনে শিক্ষায় দীক্ষায় জীবনে কখনো কোথা পাইনি দ্বন্দ্ব দেখিনি হারাতে পূত - আদর্শ ছন্দ বিন্দু বিন্দু করি গড়ি পদ্য সংকলন তোমাদেরই চরণে করি সমর্পণ প্রথম ভাগ ( কবিতা )   স্বপ্নতরী ১ স্বপ্ন - তরী   নিটোল , নিষ্পাপ কচিপাতার মর্মর আর কাঁচা - রোদের আবোল - তাবোল পরিধিস্থ নতুন আমি ।   আনকোরা নতুন ঝরনাবারি নিয়ে এখন নদীর জলও নতুন বয়ে যায় , তাই শেওলা জমে না ।   দুঃখ আমার রয়ে গেছে এবার আসবে স্বপ্ন - তরী চেনা পথ , অচেনা ঠিকানা ।         ২ পাখমারা   সেই উথাল - পাথাল পাখশাট আজও আনে আরণ্যক অনুভূতি । একটু একটু হেঁটে গিয়ে বয়সের ফল্গুধারায় জগৎ নদীর দু ’ পার ছাড়ে দীর্ঘশ্বাস - সময়ের কাঠগড়াতে আমি বন...