Skip to main content

গরজে, প্রত্যয়ে উজ্জ্বল - ‘মনুতৈসা’ ও ‘খুমতৈয়া’


ত্রিপুরা থেকে সদ্যপ্রকাশিত দুটি ছোটপত্রিকা ওজনে, অবয়বে, দর্শনে, লক্ষ্যে কোথাও যেন এক সাদৃশ্য প্রত্যক্ষ করা যায় উত্তরপূর্বে ত্রিপুরা রাজ্যেই সাহিত্য চর্চা সবচাইতে বেশি হয় বললেও অত্যুক্তি হবে না বাংলার পাশাপাশি ককবরক, রিয়াং ব্রু বা কাউব্রু কিংবা চাকমা ইত্যাদি ভাষায়ও সাহিত্য রচনা হয় নিয়মিত প্রকাশিত হয় গুচ্ছ গুচ্ছ লিটল ম্যাগাজিন, ফোল্ডার ইত্যাদি তবে বর্তমানে বাংলায় সাহিত্যচর্চাই সম্ভবত সবচাইতে বেশি হয় ত্রিপুরার বাংলা সাহিত্য চর্চার রয়েছে এক সমৃদ্ধ ইতিহাস
 
মনুতৈসা
লেখক কবি আশিষকান্তি সাহা সম্পাদিতমনুতৈসাপত্রিকার দ্বিতীয় বর্ষ, দ্বিতীয় সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছে সম্প্রতি ২৮ পৃষ্ঠার পেপারব্যাক সংখ্যায় একটি গদ্যের বাইরে রয়েছে ২০জন কবির কবিতা কবিতার অঙ্গনে প্রতিষ্ঠিত অধিকাংশ কবি স্বভাবতই রয়েছে একাধিক কাব্যসুষমামণ্ডিত কবিতা, সুখপঠনের কবিতামনুতৈসা অর্থে মনু নদীককবরক ভাষায়তৈসাশব্দের অর্থ হচ্ছে নদীত্রিপুরা রাজ্যের অন্যতম প্রধান নদীকবিমন সততই নদীপ্রেমে মাতোয়ারাসুতরাং কবি, সম্পাদকের নদীকেন্দ্রিক নাম সততই এক পছন্দের জায়গাএবং এমন একটি পত্রিকানাম স্বভাবতই এক সম্প্রীতি সহাবস্থানেরও সূচক
সংক্ষিপ্ত সম্পাদকীয়তে সম্পাদক অস্থির সময়ের আবহে নিজের উদ্বেগ প্রকাশ করে লিখছেন - ‘…দেশ আজ নেশার সাগরে ভাসছেযুবসমাজ দিশাহীন, একাংশ বিভিন্ন নেশায় আসক্ত হয়ে মৃত্যুর প্রহর গুনছেশিশু-কিশোরী থেকে নারী প্রতিনিয়ত আক্রান্ত হচ্ছেএই পশ্চাদপদ বন্ধ্যা অবস্থা থেকে দেশকে মুক্ত করতে সাহিত্য সংস্কৃতিকে হাতিয়ার করে অগ্রসর হতে হবে এবং কলমের খোঁচায় ঘুমন্ত সমাজকে জাগিয়ে তুলতে হবেযথার্থ সম্পাদকীয়
এই সংখ্যায় কবিতা লিখেছেন গোবিন্দ ধর, কুশসিং চাকমা, আশিষকান্তি সাহা, সুতপা ভট্টাচার্য, মিলনকান্তি দত্ত, বেবী সাউ, মন্টু দাস, বিদ্যুৎ চক্রবর্তী, কৃপা মোহন চাকমা, পরিমল কর্মকার, টিংকুরঞ্জন দাস, দিব্যেন্দু নাথ, হারাধন বৈরাগী, মধুমিতা ভট্টাচার্য, সংহিতা চৌধুরী, শাশ্বতী দাস, আলাল উদ্দিন, বিজন বোস, শচীন্দ্র চৌধুরী . বিথীকা চৌধুরীকুশসিং কৃপা মোহনের চাকমা ভাষার কবিতার পাশাপাশি অসাধারণ সব বাংলা কবিতাকিছু অনাবিল পঙ্ক্তির উল্লেখ পরিসরের অভাবে অনুক্ত রইল
শেষের পাতায় রয়েছে সুমিতা দেব-এর গদ্যসুস্থ সমাজ গড়িমাদকাশক্তি কিশোর কচি প্রাণের মৃত্যু তার প্রতিকার নিয়ে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক একটি গদ্য
স্বল্প পরিসরে যতটা সম্ভব একটি গোছানো, নিটোল একটি পত্রিকাছাপা, কাগজের মান যথাযথঅরুণকুমার দত্তের প্রচ্ছদ মিলনকান্তি দত্তের নামলিপি নান্দনিকপ্রায়নির্ভুল বানানে স্বচ্ছসলিলামনু মতোই সমৃদ্ধ একটি ছিমছাম, নান্দনিক পত্রিকা সংখ্যা - ‘মনুতৈসা
মূল্য - ৩০ টাকা, যোগাযোগ - ৮৪১৩০০৭১০৩
 
খুমতৈয়া
প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী রিয়াং ব্রু ভাষার শব্দ খুমতৈয়া হল পথের পাশে প্রস্ফুটিত একটি সুন্দর ফুলের নাম তিপ্রাসাদের খুবই প্রিয় একটি ফুল লেখক কবি ভুলুকুমার দেববর্মা সম্পাদিতখুমতৈয়াএকটি ত্রিভাষিক পত্রিকা ককবরক, কাউব্রু ও বাংলা ভাষার এই পত্রিকাটির চতুর্থ সংখ্যাটি প্রকাশিত হয়েছে সম্প্রতি একটি মনোরম প্রচ্ছদ সংবলিত ৪০ পৃষ্ঠার এই পত্রিকার মূল বার্তাই হল বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষের মধ্যে সম্প্রীতি ও সহাবস্থানের বার্তা পৌঁছে দেওয়া এবং সম্পাদকীয়তে উল্লেখ করা মতো রিয়াংদের জীবনের ছবি সমক্ষে উদ্ভাসিত করা এই সংক্ষিপ্ত পরিসরে রয়েছে নেই নেই করেও ৫টি অণুগল্প, ১টি ছোটগল্প, ১০টি কবিতা ও ৫টি ছড়া প্রতিটি রচনাই যথেষ্ট মানসম্পন্ন গল্প বিভাগে হারাধন বৈরাগী, দিব্যেন্দু নাথ, রেনুকুমার দেববর্মা ও ভুলুকুমার দেববর্মার নিবেদন সুখপাঠ্য বিশেষ করে রেনুকুমার দেববর্মারমামা কালচারছোটগল্পটি পাঠকের চোখের সামনে উদ্ভাসিত করে তৎকালিক ত্রিপুরার আর্থসামাজিক ও শৈক্ষিক উত্তরণের অম্লমধুর এক অনাবিল ছবি গল্পের চলন ও বুনোট নিখুঁত
বাংলা ও কাউব্রু ভাষার কবিতা যাঁরা লিখেছেন তাঁরা হলেন - গোবিন্দ ধর, উমারানি মলসই, সংহিতা চৌধুরী, ভুলুকুমার দেববর্মা, হারাধন বৈরাগী, মন্টু দাস, মধুমিতা ভট্টাচার্য ও শাশ্বতী দাস অধিকাংশ কবিতাই সুখপাঠ্য আলাদা করে নামোল্লেখ সংগত হবে না ছড়া বিভাগে ককবরক ও কাউব্রু ভাষার ছড়া নিয়ে রয়েছেন মধুসূদন দেববর্মা ও ভুলুকুমার দেববর্মা
সব মিলিয়ে গভীর ভালোবাসা ও প্রত্যয়ের এক নিরলস প্রচেষ্টা আলোচ্য পত্রিকা সংখ্যাটি মিলনকান্তি দিত্তের প্রাকৃতিক আবহের ছবিসংবলিত প্রচ্ছদ ও নামলিপি সৌন্দর্যময় তবে প্রচ্ছদে খুমতৈয়া ফুলের ছবি হয়তো অধিক পাঠকপ্রিয় হতো কিছু ত্রুটি কাটিয়ে উঠতে হবে সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে যেমন প্রতিটি ভাষার বিভাগকে আলাদা করে রাখা, একজন কবি-লেখকের একের অধিক রচনা সন্নিবিষ্ট না করা ইত্যাদি এর বাইরেও বানানবিষয়ক সচেতনতা বৃদ্ধিরও সুযোগ রয়েছে পত্রিকা প্রকাশের প্রাথমিক পর্যায়ে এইসব ত্রুটি থাকাটা অস্বাভাবিক নয় ধীরে ধীরে তা কাটিয়ে ওঠা যাবে এমন প্রত্যয় করাই যায়
সূচিপত্রের বিন্যাসও যথাযথ হয়নি ছাপা ও কাগজের মান যথাযথ হলেও ফন্টের ধারাবাহিকতা ব্যাহত হয়েছে এতসব জড়তা কাটিয়ে যে বিষয়টিকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে অর্থাৎ তিন তিনটি ভাষাকে একত্রে উপস্থাপন করার গরজ তা যথার্থ অনুভূত হয়েছে বলাই যায় এক কথায় গরজ ও প্রতীতির পত্রিকাখুমতৈয়া 
মূল্য - ৬০ টাকা, যোগাযোগ - ৮৯৭৪৬৭৫১৪৮
বিদ্যুৎ চক্রবর্তী 

Comments

Popular posts from this blog

শেকড়ের টানে নান্দনিক স্মরণিকা - ‘পরিযায়ী’

রামকৃষ্ণনগর । প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আবহে বরাক উপত্যকার এক ঐতিহ্যময় শহর । বিশেষ করে শিক্ষাদীক্ষার ক্ষেত্রে চিরদিনই এক অগ্রণী স্থান হিসেবে উচ্চারিত হয়ে আসছে এই নাম । বৃহত্তর রামকৃষ্ণনগরের গোড়াপত্তনের ইতিহাস বহুদিনের । দেশভাগের আগে ও পরে , উত্তাল সময়ে স্থানচ্যূত হয়ে এখানে থিতু হতে চাওয়া মানুষের অসীম ত্যাগ ও কষ্টের ফলস্বরূপ গড়ে ওঠে এক বিশাল বাসযোগ্য অঞ্চল । শুধু রুটি , কাপড় ও ঘরের স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রই নয় , এর বাইরে শিক্ষা অর্জনের ও শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে মমনশীলতার পরিচয় দিয়েছিলেন সেইসব মহামানবেরা । ফলস্বরূপ এক শিক্ষিত সমাজব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল যদিও উচ্চশিক্ষার জন্য পরবর্তী প্রজন্মকে বেরোতে হয়েছিল নিজ বাসস্থান ছেড়ে । শিলচর তখন এ অঞ্চলের প্রধান শহর হওয়ায় স্বভাবতই শিক্ষা ও উপার্জনের স্থান হিসেবে পরিগণিত হয় । এবং স্বভাবতই রামকৃষ্ণনগর ছেড়ে এক বৃহৎ অংশের মানুষ এসে পাকাপাকিভাবে থাকতে শুরু করেন এই শিলচরে । এই ধারা আজও চলছে সমানে । শিলচরে এসেও শেকড়ের টানে পরস্পরের সাথে যুক্ত থেকে রামকৃষ্ণনগর মূলের লোকজনেরা নিজেদের মধ্যে গড়ে তোলেন এক সৌহার্দমূলক বাতাবরণ । এবং সেই সূত্রেই ২০০০ সালে গঠিত হয় ‘ ...

নিবেদিত সাহিত্যচর্চার গর্বিত পুনরাবলোকন - ‘নির্বাচিত ঋতুপর্ণ’

সাধারণ অর্থে বা বলা যায় প্রচলিত অর্থে একটি সম্পাদনা গ্রন্থের মানে হচ্ছে মূলত অপ্রকাশিত লেখা একত্রিত করে তার ভুল শুদ্ধ বিচার করে প্রয়োজনীয় সংশোধন ও সম্পাদনার পর গ্রন্থিত করা । যেমনটি করা হয় পত্রপত্রিকার ক্ষেত্রে । অপরদিকে সংকলন গ্রন্থের অর্থ হচ্ছে শুধুই ইতিপূর্বে প্রকাশিত লেখাসমূহ এক বা একাধিক পরিসর থেকে এনে হুবহু ( শুধুমাত্র বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে ন্যূনতম সংশোধনসাপেক্ষে ) একত্রীকরণ । সেই হিসেবে আলোচ্য গ্রন্থটি হয়তো সম্পাদনা গ্রন্থ নয় , একটি সংকলন গ্রন্থ । বিস্তারিত জানতে হলে যেতে হবে সম্পাদক ( সংকলক ) সত্যজিৎ নাথের বিস্তৃত ভূমিকায় । পুরো ভূমিকাটিই যদি লেখা যেতো তাহলে যথাযথ হতো যদিও পরিসর সে সায় দেয় না বলেই অংশবিশেষ তুলে ধরা হলো এখানে - ‘ সালটা ১৯৯০ । ‘ দৈনিক সোনার কাছাড় ’- এ একবছর হল আসা - যাওয়া করছি । চাকরির বয়স হয়নি তাই চাকরি নয় , এই ‘ আসা - যাওয়া ’ । …. হঠাৎ করেই একদিন ভূত চাপল মাথায় - পত্রিকা বের করব । ‘… সেই শুরু । অক্টোবর ১৯৯০ সালে শারদ সংখ্যা দিয়ে পথচলা শুরু হল ‘ঋতুপর্ণ’র। পরপর দুমাস বের করার পর সেটা হয়ে গেল ত্রৈমাসিক। পুরো পাঁচশো কপি ছাপাতাম ‘মৈত্রী প্রকাশনী’ থেকে।...

মহানিষ্ক্ৰমণ

প্রায় চল্লিশ বছর আগে গ্রামের সেই মায়াময় বাড়িটি ছেড়ে আসতে বেজায় কষ্ট পেয়েছিলেন মা ও বাবা। স্পষ্ট মনে আছে অর্ঘ্যর, এক অব্যক্ত অসহায় বেদনার ছাপ ছিল তাঁদের চোখেমুখে। চোখের কোণে টলটল করছিল অশ্রু হয়ে জমে থাকা যাবতীয় সুখ দুঃখের ইতিকথা। জীবনে চলার পথে গড়ে নিতে হয় অনেক কিছু, আবার ছেড়েও যেতে হয় একদিন। এই কঠোর বাস্তব সেদিন প্রথমবারের মতো উপলব্ধি করতে পেরেছিল অর্ঘ্যও। সিক্ত হয়ে উঠছিল তার চোখও। জন্ম থেকে এখানেই যে তার বেড়ে ওঠা। খেলাধুলা, পড়াশোনা সব তো এখানেই। দাদাদের বাইরে চলে যাওয়ার পর বারান্দাসংলগ্ন বাঁশের বেড়াযুক্ত কোঠাটিও একদিন তার একান্ত ব্যক্তিগত কক্ষ হয়ে উঠেছিল। শেষ কৈশোরে এই কোঠাতে বসেই তার শরীরচর্চা আর দেহজুড়ে বেড়ে-ওঠা লক্ষণের অবাক পর্যবেক্ষণ। আবার এখানে বসেই নিমগ্ন পড়াশোনার ফসল ম্যাট্রিকে এক চোখধাঁধানো ফলাফল। এরপর একদিন পড়াশোনার পাট চুকিয়ে উচ্চ পদে চাকরি পেয়ে দাদাদের মতোই বাইরে বেরিয়ে যায় অর্ঘ্য, স্বাভাবিক নিয়মে। ইতিমধ্যে বিয়ে হয়ে যায় দিদিরও। সন্তানরা যখন বড় হয়ে বাইরে চলে যায় ততদিনে বয়সের ভারে ন্যুব্জ বাবা মায়ের পক্ষে আর ভিটেমাটি আঁকড়ে পড়ে থাকা সম্ভব হয়ে ওঠে না। বহু জল্পনা কল্পনার শেষে ত...