Skip to main content

তিনটি শ্রুতি নাটকের সংকলন 'এক পলকে'

 


তিনটি আকর্ষণীয় শ্রুতি নাটকের সংকলন - 

‘এক পলকে’


বিদ্যুৎ চক্রবর্তী


একটা সময় ছিল যখন মঞ্চে নাটকের অভিনয় করতে হলে প্রথমেই যে কাজটি করতে হতো তা হল কলকাতা থেকে ভালো নাটকের বই আনানো। এর বাইরে কোনো বিকল্প ছিল না। আজকের দিনে পরিস্থিতি আর তেমনটা হয়ত নেই। এই উত্তর পূর্বের সাহিত্য জগতে একাধিক মঞ্চোপযোগী নাটকের সৃষ্টি হয়েছে। তবে শ্রুতি নাটক ব্যাপারটি অনেকটাই আলাদা। এখানে অভিনয়ের কোনো ব্যাপার নেই। শুধু সংলাপের মাধ্যমে শ্রোতাদের নিয়ে যেতে হয় বিষয়বস্তুর গভীরে। শ্রোতাদের গভীর মনোযোগের পাশাপাশি নাট্যকারের রয়েছে এক বিশাল দায়িত্ব। সংলাপ এমন হবে যে চোখের সামনে কোনো অভিনেতা অভিনেত্রীদের না দেখেই শুধু সংলাপ শুনে শ্রোতারা অনুধাবন করতে পারবেন নাটকের কাহিনি।

এখানে শ্রুতি নাটক খুব একটা লিখা হয়েছে বলে জানা নেই। সেদিক দিয়ে নাট্যকার, কবি, সাহিত্যিক ও কৃতী শিক্ষাবিদ শিল্পজিৎ পাল-এর তিনটি শ্রুতি নাটকের সংকলন ‘এক পলকে’ একাধারে ব্যতিক্রমী এবং নান্দনিক সাহিত্যকর্ম। সংকলনটিতে আছে সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়ের উপর লিখিত তিনটি শ্রুতি নাটক। নাটক, শ্রুতি নাটক এবং শিল্পজিৎ পাল-এর এই গ্রন্থটি নিয়ে আছে বিশিষ্ট কবি ও সাহিত্যিক মহুয়া চৌধুরীর একটি ভূমিকা - ‘প্রাসঙ্গিক কিছু কথা’। কিছু কথার ছলে অনেক কথাই লিখেছেন তিনি যা সংকলনটির সাথে পাঠকের এক প্রাথমিক পরিচয় করিয়ে দেয়। 

প্রথম নাটক - ‘পরকীয়া’। কুশীলব শুধুই স্বামী-স্ত্রী। পরকীয়া সম্পর্কের প্রথাগত রগরগে প্রেমপর্বের কোনও বিষয় এখানে নেই। বরং এক ব্যতিক্রমী চিন্তাপ্রসূত বয়ান আছে নাটকটিতে। একটি পরকীয়া সম্পর্কের জেরে কীভাবে ধ্বংস হয়ে যেতে পারে একটি পরিবার, কীভাবে ভালোবাসার সৌধ খসে পড়ে বেরিয়ে আসে এক নিষ্ঠুর মানবিক কঙ্কাল তারই এক বেদনাত্মক কাহিনি। পরকীয়ার প্রভাবে লিখিত এক নির্মোহ ভাঙনের সবাক চিত্র। একজন নাট্যকারের পক্ষে শুধু দুই জন কুশীলবের মাধ্যমে এভাবে একটি বিষয়কে তুলে ধরা অত্যন্ত কঠিন কাজ এবং এই কঠিন কাজটিকেই সার্থক করে তুলতে পেরেছেন শিল্পজিৎ।

দ্বিতীয় নাটক - ‘লকডাউন’। করোনা বা কোভিড-১৯ নামক অতিমারির কালে দেশজোড়া লক ডাউনের ফলে উদ্ভূত এক নিদারুণ কাহিনি। এখানে কুশীলব-এর সংখ্যা মোট চার জন। এঁরা প্রত্যেকেই বাইরে থেকে আগত মেলায় অংশগ্রহণকারী ব্যবসায়ী। লক ডাউনের ফলে সবার নিজ নিজ ঘরে ঘটে যাওয়া ঘটনাবলির বয়ানের পাশাপাশি আছে সমাজের এক পরহিতৈষী চিত্র। লেখক, নাট্যকার এখানে এই নাটকটির মাধ্যমে লক ডাউনের একটি স্পষ্ট দলিল রচনা করতে চেয়েছেন। তাই সংলাপের মধ্য দিয়ে এসেছে নানা ঘটনাবলির উল্লেখ। দলিল রচিত হয়েছে ঠিকই তবে সাল মাস তারিখ সমূহের উল্লেখে স্বাভাবিক সংলাপ-প্রবণতা হয়ত ব্যাহত হয়েছে খানিকটা। অনেক দুঃখসুখের কাহিনির অন্তে নাটকের শেষটা অত্যন্ত গোছানো হয়েছে। 

তৃতীয় তথা শেষ নাটক - ‘শাশুড়ি বনাম বৌমা’। চিরন্তন এক সমস্যার অম্লমধুর নাটক। কুশীলব সাকুল্যে তিন। স্বামী স্ত্রী ও শাশুড়ি। সমস্যার ফাঁকে ফাঁকে বিন্যস্ত রয়েছে এক সুখী পরিবারের অন্তর্নিহিত আকুতি - যা আকৃষ্ট করে পাঠককে। নাটকের অন্তে আছে এক অনাকাঙ্ক্ষিত সমাধান।

তিনটি নাটকই বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গিতে লিখা। কোথাও অতিকথন কিংবা অতিরঞ্জন নেই। তবে সংলাপের গাম্ভীর্য বজায় থেকেছে আগাগোড়া। মঞ্চায়নের ক্ষেত্রে আধ ঘণ্টা থেকে এক ঘণ্টার মধ্যে সমাপ্য সব নাটকই যথার্থ প্রাসঙ্গিক। অর্থাৎ এক কথায় বলা যায় স্বল্পকালীন বৈঠকেই সেরে নেওয়া যায় প্রতিটি শ্রুতি নাটকের পরিবেশনা। 

সব মিলিয়ে ২০২০ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে লিখা সমকালীন এক বৈচিত্র্যময় নাট্য সংকলন - ‘এক পলকে’। সংকলনের আদিতেই শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করা হয়েছে ‘মাতৃভাষা ও বাংলা ভাষার জন্য যাঁরা শহিদ হয়েছেন’ তাঁদের। বিপ্লব পাল-এর প্রচ্ছদ যথাযথ এবং আকর্ষণীয়। পেপারব্যাকে ৪৭ পৃষ্ঠার সংকলনটির প্রতিটি নাটকের নামলিপির সঙ্গে সত্যজিৎ দাস-এর রেখাচিত্র সংকলনটিকে ঋদ্ধ করেছে। সংলাপের সঙ্গে খাপ খাইয়ে প্রস্তাবিত গানের কলি নাট্যকারের সুচিন্তিত নাট্য ভাবনা এবং রুচিশীল সংস্কৃতিমনস্কতার পরিচায়ক। প্রকাশক পূর্ণিমা পাল। গ্রন্থের শেষ প্রচ্ছদে রয়েছে নাট্যকার শিল্পজিৎ পাল-এর বিশদ পরিচিতি।


‘এক পলকে’

শিল্পজিৎ পাল

মূল্য - ৫০ টাকা

যোগাযোগ - ৯৪৩৫১৭২৪১৫

ইয়ুটিউব লিংক - Silpajit Paul’s Creation

Comments

Popular posts from this blog

উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বাংলা গল্প : বিষয়ে বিশ্লেষণে

একক কিংবা যৌথ সম্পাদনায় বিগত কয়েক বছরে উত্তরপূর্বের বাংলা লেখালেখি বিষয়ক একাধিক গ্রন্থ সম্পাদনা করে এই সাহিত্যবিশ্বকে পাঠকের দরবারে পরিচিত করিয়ে দেওয়ার এক প্রচেষ্টা করে যাচ্ছেন নিবেদিতপ্রাণ তরুণ লেখক ও সম্পাদক নিত্যানন্দ দাস । হালে এপ্রিল ২০২৪ - এ প্রকাশিত হয়েছে তাঁর সম্পাদনা গ্রন্থ ‘ উত্তর - পূর্বাঞ্চলের বাংলা গল্প : বিষয়ে বিশ্লেষণে ’ ( প্রথম খণ্ড ) । প্রকাশক - একুশ শতক , কলকাতা । আলোচ্য গ্রন্থটিতে দুই ছত্রে মোট ২৮ জন বিশিষ্ট প্রাবন্ধিকের ২৮টি প্রবন্ধ রয়েছে । উপযুক্ত বিষয় ও আলোচকদের নির্বাচন বড় সহজ কথা নয় । এর জন্য প্রাথমিক শর্তই হচ্ছে নিজস্ব জ্ঞানার্জন । কালাবধি এই অঞ্চল থেকে প্রকাশিত উৎকৃষ্ট সাহিত্যকৃতির সম্বন্ধে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল না হলে তা সম্ভব নয় মোটেও । নিত্যানন্দ নিজেকে নিমগ্ন রেখেছেন গভীর অধ্যয়ন ও আত্মপ্রত্যয়কে সম্বল করে তা বলার অপেক্ষা রাখে না । আলোচ্য গ্রন্থের ভূমিকা লিখেছেন প্রতিষ্ঠিত কথাকার রণবীর পুরকায়স্থ । বস্তুত সাত পৃষ্ঠা জোড়া এই ভূমিকা এক পূর্ণাঙ্গ আলোচনা । ভূমিকা পাঠের পর আর আলাদা করে আলোচনার কিছু থাকে না । প্রতিটি নিবন্ধ নিয়ে পরিসরের অভাবে সংক্ষিপ্ত হলেও ...

শেকড়ের টানে নান্দনিক স্মরণিকা - ‘পরিযায়ী’

রামকৃষ্ণনগর । প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আবহে বরাক উপত্যকার এক ঐতিহ্যময় শহর । বিশেষ করে শিক্ষাদীক্ষার ক্ষেত্রে চিরদিনই এক অগ্রণী স্থান হিসেবে উচ্চারিত হয়ে আসছে এই নাম । বৃহত্তর রামকৃষ্ণনগরের গোড়াপত্তনের ইতিহাস বহুদিনের । দেশভাগের আগে ও পরে , উত্তাল সময়ে স্থানচ্যূত হয়ে এখানে থিতু হতে চাওয়া মানুষের অসীম ত্যাগ ও কষ্টের ফলস্বরূপ গড়ে ওঠে এক বিশাল বাসযোগ্য অঞ্চল । শুধু রুটি , কাপড় ও ঘরের স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রই নয় , এর বাইরে শিক্ষা অর্জনের ও শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে মমনশীলতার পরিচয় দিয়েছিলেন সেইসব মহামানবেরা । ফলস্বরূপ এক শিক্ষিত সমাজব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল যদিও উচ্চশিক্ষার জন্য পরবর্তী প্রজন্মকে বেরোতে হয়েছিল নিজ বাসস্থান ছেড়ে । শিলচর তখন এ অঞ্চলের প্রধান শহর হওয়ায় স্বভাবতই শিক্ষা ও উপার্জনের স্থান হিসেবে পরিগণিত হয় । এবং স্বভাবতই রামকৃষ্ণনগর ছেড়ে এক বৃহৎ অংশের মানুষ এসে পাকাপাকিভাবে থাকতে শুরু করেন এই শিলচরে । এই ধারা আজও চলছে সমানে । শিলচরে এসেও শেকড়ের টানে পরস্পরের সাথে যুক্ত থেকে রামকৃষ্ণনগর মূলের লোকজনেরা নিজেদের মধ্যে গড়ে তোলেন এক সৌহার্দমূলক বাতাবরণ । এবং সেই সূত্রেই ২০০০ সালে গঠিত হয় ‘ ...

প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'স্বপ্নতরী'

  স্বপ্নতরী                         বিদ্যুৎ চক্রবর্তী   গ্রন্থ বিপণী প্রকাশনা  বাবা - স্বর্গীয় সুধীর চন্দ্র চক্রবর্তী মা - শ্রীমতী বীণাপাণি চক্রবর্তী               জনম দিয়েছ মোরে এ ভব ধরায় গড়েছ সযতনে শিক্ষায় দীক্ষায় জীবনে কখনো কোথা পাইনি দ্বন্দ্ব দেখিনি হারাতে পূত - আদর্শ ছন্দ বিন্দু বিন্দু করি গড়ি পদ্য সংকলন তোমাদেরই চরণে করি সমর্পণ প্রথম ভাগ ( কবিতা )   স্বপ্নতরী ১ স্বপ্ন - তরী   নিটোল , নিষ্পাপ কচিপাতার মর্মর আর কাঁচা - রোদের আবোল - তাবোল পরিধিস্থ নতুন আমি ।   আনকোরা নতুন ঝরনাবারি নিয়ে এখন নদীর জলও নতুন বয়ে যায় , তাই শেওলা জমে না ।   দুঃখ আমার রয়ে গেছে এবার আসবে স্বপ্ন - তরী চেনা পথ , অচেনা ঠিকানা ।         ২ পাখমারা   সেই উথাল - পাথাল পাখশাট আজও আনে আরণ্যক অনুভূতি । একটু একটু হেঁটে গিয়ে বয়সের ফল্গুধারায় জগৎ নদীর দু ’ পার ছাড়ে দীর্ঘশ্বাস - সময়ের কাঠগড়াতে আমি বন...