Skip to main content

গল্পে গল্পে উদ্ভাসিত মুদ্রার ভিন্ন পিঠ


খুব বেশি লেখা তাঁর প্রকাশিত হয় না যদিও মাঝে মাঝেই পাঠককে চমকে দিতে ভালোবাসেন সুপ্রদীপ দত্তরায়। পত্রপত্রিকায় মূলত ফরমায়েশি লেখাতেই তাঁকে খুঁজে পাওয়া যায়। অন্যদিকে জনসমক্ষের বাইরে থেকেই একেবারে গ্রন্থ প্রকাশের মতো বিলাসিতা বোধ করি তাকেই মানায়। ছোটগল্প ও কবিতা - সাহিত্যের এই দুটি ধারাতেই তাঁর সাবলীল বিচরণ। ইতিমধ্যেই প্রকাশিত হয়েছে তাঁর একাধিক গ্রন্থ। সম্প্রতি হাতে এসেছে তাঁর ছোটগল্পের সংকলন - ‘কাঠের চেয়ার’।
৬৮ পৃষ্ঠার হার্ড বোর্ড বাঁধাই, ভূমিকাবিহীন গ্রন্থটিতে সন্নিবিষ্ট হয়েছে মোট ১৪টি গল্প। ভূমিকা না থাকলেও রয়েছে ব্যতিক্রমী উৎসর্গ - তাঁর ‘সুখ-দুঃখের জীবনসাথি সংযুক্তা ও কন্যা অনন্যাকে’। বস্তুত এই উৎসর্গ থেকেই গল্পপাঠের একটা স্বরূপ জানা হয়ে যায়। সুপ্রদীপের গল্প পুরোপুরি ফিকশনদর্মী নয়। যদি কখনও তার ছোঁয়া থাকে কদাপি - সে কাহিনির স্বার্থে, বিষয়য়ের স্বার্থে। প্রতিটি গল্পই যথাসম্ভব ঘোর বাস্তবকে ভিত্তি করে লেখা যেখানে মূলত রয়েছে ধ্বস্ত সামাজিকতার রূপকল্প। তথাকথিত নিম্নবর্গের মানুষ, চোখের আড়ালে থেকে জীবনসংগ্রামে পর্যুদস্ত মানুষের কথাই বেশি করে উঠে আসে তাঁর গল্পে।
সংলাপ ও বুনোটে প্রতি গল্পই হয়ে ওঠে অবিরত পঠনের গল্প। খুব বেশি দীর্ঘ নয় কোনওটিই। মেদবর্জিত, সটান সপাট বয়ানেই গল্পকার সিদ্ধহস্ত। তা বলে পারিপার্শ্বিক প্রেক্ষাপটের সাহিত্যগুণসম্পন্ন চলন যে একেবারেই নেই তাও নয়। তবে তা নিতান্তই সীমিত, কিন্তু সুখপাঠ্য। উদাহরণস্বরূপ একটি বৃষ্টিমুখর সকালের উল্লেখ করা যেতেই পারে - ‘...আজ সকাল থেকেই বৃষ্টি হছে, থামার কোন লক্ষণ নেই। বিরক্তি এসে যায়। ভোলা তার জীবনে অনেক ধরনের বৃষ্টি দেখেছে। টিপটিপ বৃষ্টি, পশলা বৃষ্টি, ঝড়ো হাওয়া সহ বৃষ্টি, তুফানি বৃষ্টি আবার ঘ্যানঘ্যানে বৃষ্টি। বৃষ্টিরও কত রকম আছে ভোলা তার জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়ে জেনেছে...।’ (গল্প - ভোলা)। ভাষার চাকচিক্যের দিকে নয়, প্রেক্ষাপটের যাথার্থ্যে সুপ্রদীপের ঝোঁক বেশি। প্রতিটি গল্পেই এর ছাপ পাওয়া যায়।
ধ্বস্ত, স্খলিত সিদ্ধান্তের প্রথম গল্প ‘বন্যা’। বানপীড়িত গ্রামবাসীদের দুরবস্থায় মন গলে না শহর থেকে বন্যা দেখতে যাওয়া হাল ফ্যাশনের মানুষের। তীব্র শ্লেষে তাদের বিদ্ধ করেছেন গল্পকার। সংলাপে বুনোটে জমজমাট গল্প। প্রজন্মের স্খলন, বার্ধক্যের যন্ত্রণা এবং সম্পর্কের অবমূল্যায়ন নিয়ে চমৎকার রূপকধর্মী পরবর্তী গল্প ‘ও এল এক্স’। ‘পার্বতীর সংসার’ গল্পে গরিবের সংসার যাপন, টানাপোড়েন আর দিনাতিপাতের করুণ বয়ান। শক্ত বুনোটে বাঁধা সরল পাঠের গল্প। স্খলিত প্রজন্ম, স্খলিত সিদ্ধান্ত, স্খলিত সমাজের একাধিক করুণ ও দুঃখজনক ঘটনার প্রেক্ষাপটে রয়েছে একাধিক গল্প। যেমন - ‘নোটা’, ‘ভোলা’, ‘বাগানবাড়ি’, ‘এক রাতে প্রতি রাতে’ ইত্যাদি। শেষোক্ত গল্পটিকেও অন্যতম সেরা গল্পের মর্যাদায় অভিষিক্ত করা যায়। উপযুক্ত বিস্তৃতির মাধ্যমে এক অন্ধকার কালো অধ্যায়ের পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণন। গ্রন্থনাম শীর্ষক ‘কাঠের চেয়ার’ গল্পটিকেই সেরা হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়। অতিমারির প্রকোপে খেটে খাওয়া মানুষের এক ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্তের গল্প। সুলিখিত এই গল্পের সমাপনও ভিন্ন আঙ্গিকের। সমৃদ্ধ বুনোট ও সংলাপে বাস্তবভিত্তিক জমজমাট গল্প ‘শিকড়’। এক অস্বস্তিকর বাস্তবতা নিয়ে গল্প ‘লিসি’। নায়িকার নাম কি প্রকৃতার্থেই ‘কিনকিনি’ নাকি বানানবিভ্রাটে এটা ‘কিঙ্কিণী’র অপভ্রংশ বোঝা গেল না। পরাবাস্তববাদী গল্প ‘ছায়া’। বড্ড সংক্ষিপ্ত। বিস্তৃতির সুযোগ ছিল হয়তো। একেবারেই ব্যতিক্রমী প্রেক্ষাপটে লেখা ‘খোলা চিঠি’ গল্পটি পাঠককে ভাবাতে বাধ্য করবে নিশ্চিত। বইয়ের জগৎ ও বইকে ভালোবাসার এক নান্দনিক গল্প ‘অন্য মাতাল’। শেষ গল্প ‘অসময়ে বৃষ্টি’তে উপস্থাপিত হয়েছে একটুকরো প্রেমের অপরূপ রূপমাধুরী।
আসলে প্রতিটি গল্পেই প্রাধান্য পেয়েছে বিষয়, প্রেক্ষাপট। সচরাচর প্রকাশিত গল্পসমূহে যেমন ভাষা, সাহিত্য, সমান্তরাল ঘটনাবলি, পরিবেশ বর্ণন, চরিত্রের ভিড় আদি সংযুক্ত হয়ে এক বিস্তৃত পাঠের ক্ষেত্র পরিলক্ষিত হয় - সুপ্রদীপ সেই পথে হাঁটেননি। ফলত আজকের ব্যস্ত দিনের ব্যস্ত পাঠকের কাছে আকর্ষণীয় হয়ে ওঠার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে এই লেখকের গল্পে।
কাগজের মান, ছাপার স্পষ্টতা যথাযথ। কলকাতা থেকে প্রকাশিত গ্রন্থে এতটা বানান বিভ্রাট কাম্য নয় মোটেও। প্রাসঙ্গিক প্রচ্ছদের সৌজন্যে মনোজুল ইসলাম। শেষ প্রচ্ছদে রয়েছে সচিত্র সংক্ষিপ্ত লেখক পরিচিতি, যদিও ব্লার্বগুলো রয়ে গেছে খালি। সব মিলিয়ে এক সরল পঠন, সুখপঠনের গল্প সংকলন যা আখেরে ভাবতে বাধ্য করে সচেতন পাঠককে।
বিদ্যুৎ চক্রবর্তী
‘কাঠের চেয়ার’
সুপ্রদীপ দত্তরায়
প্রকাশক - নীরব আলো প্রকাশনী, কলকাতা
মূল্য - ১৬০ টাকা

Comments

Popular posts from this blog

শেকড়ের টানে নান্দনিক স্মরণিকা - ‘পরিযায়ী’

রামকৃষ্ণনগর । প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আবহে বরাক উপত্যকার এক ঐতিহ্যময় শহর । বিশেষ করে শিক্ষাদীক্ষার ক্ষেত্রে চিরদিনই এক অগ্রণী স্থান হিসেবে উচ্চারিত হয়ে আসছে এই নাম । বৃহত্তর রামকৃষ্ণনগরের গোড়াপত্তনের ইতিহাস বহুদিনের । দেশভাগের আগে ও পরে , উত্তাল সময়ে স্থানচ্যূত হয়ে এখানে থিতু হতে চাওয়া মানুষের অসীম ত্যাগ ও কষ্টের ফলস্বরূপ গড়ে ওঠে এক বিশাল বাসযোগ্য অঞ্চল । শুধু রুটি , কাপড় ও ঘরের স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রই নয় , এর বাইরে শিক্ষা অর্জনের ও শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে মমনশীলতার পরিচয় দিয়েছিলেন সেইসব মহামানবেরা । ফলস্বরূপ এক শিক্ষিত সমাজব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল যদিও উচ্চশিক্ষার জন্য পরবর্তী প্রজন্মকে বেরোতে হয়েছিল নিজ বাসস্থান ছেড়ে । শিলচর তখন এ অঞ্চলের প্রধান শহর হওয়ায় স্বভাবতই শিক্ষা ও উপার্জনের স্থান হিসেবে পরিগণিত হয় । এবং স্বভাবতই রামকৃষ্ণনগর ছেড়ে এক বৃহৎ অংশের মানুষ এসে পাকাপাকিভাবে থাকতে শুরু করেন এই শিলচরে । এই ধারা আজও চলছে সমানে । শিলচরে এসেও শেকড়ের টানে পরস্পরের সাথে যুক্ত থেকে রামকৃষ্ণনগর মূলের লোকজনেরা নিজেদের মধ্যে গড়ে তোলেন এক সৌহার্দমূলক বাতাবরণ । এবং সেই সূত্রেই ২০০০ সালে গঠিত হয় ‘ ...

নিবেদিত সাহিত্যচর্চার গর্বিত পুনরাবলোকন - ‘নির্বাচিত ঋতুপর্ণ’

সাধারণ অর্থে বা বলা যায় প্রচলিত অর্থে একটি সম্পাদনা গ্রন্থের মানে হচ্ছে মূলত অপ্রকাশিত লেখা একত্রিত করে তার ভুল শুদ্ধ বিচার করে প্রয়োজনীয় সংশোধন ও সম্পাদনার পর গ্রন্থিত করা । যেমনটি করা হয় পত্রপত্রিকার ক্ষেত্রে । অপরদিকে সংকলন গ্রন্থের অর্থ হচ্ছে শুধুই ইতিপূর্বে প্রকাশিত লেখাসমূহ এক বা একাধিক পরিসর থেকে এনে হুবহু ( শুধুমাত্র বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে ন্যূনতম সংশোধনসাপেক্ষে ) একত্রীকরণ । সেই হিসেবে আলোচ্য গ্রন্থটি হয়তো সম্পাদনা গ্রন্থ নয় , একটি সংকলন গ্রন্থ । বিস্তারিত জানতে হলে যেতে হবে সম্পাদক ( সংকলক ) সত্যজিৎ নাথের বিস্তৃত ভূমিকায় । পুরো ভূমিকাটিই যদি লেখা যেতো তাহলে যথাযথ হতো যদিও পরিসর সে সায় দেয় না বলেই অংশবিশেষ তুলে ধরা হলো এখানে - ‘ সালটা ১৯৯০ । ‘ দৈনিক সোনার কাছাড় ’- এ একবছর হল আসা - যাওয়া করছি । চাকরির বয়স হয়নি তাই চাকরি নয় , এই ‘ আসা - যাওয়া ’ । …. হঠাৎ করেই একদিন ভূত চাপল মাথায় - পত্রিকা বের করব । ‘… সেই শুরু । অক্টোবর ১৯৯০ সালে শারদ সংখ্যা দিয়ে পথচলা শুরু হল ‘ঋতুপর্ণ’র। পরপর দুমাস বের করার পর সেটা হয়ে গেল ত্রৈমাসিক। পুরো পাঁচশো কপি ছাপাতাম ‘মৈত্রী প্রকাশনী’ থেকে।...

মহানিষ্ক্ৰমণ

প্রায় চল্লিশ বছর আগে গ্রামের সেই মায়াময় বাড়িটি ছেড়ে আসতে বেজায় কষ্ট পেয়েছিলেন মা ও বাবা। স্পষ্ট মনে আছে অর্ঘ্যর, এক অব্যক্ত অসহায় বেদনার ছাপ ছিল তাঁদের চোখেমুখে। চোখের কোণে টলটল করছিল অশ্রু হয়ে জমে থাকা যাবতীয় সুখ দুঃখের ইতিকথা। জীবনে চলার পথে গড়ে নিতে হয় অনেক কিছু, আবার ছেড়েও যেতে হয় একদিন। এই কঠোর বাস্তব সেদিন প্রথমবারের মতো উপলব্ধি করতে পেরেছিল অর্ঘ্যও। সিক্ত হয়ে উঠছিল তার চোখও। জন্ম থেকে এখানেই যে তার বেড়ে ওঠা। খেলাধুলা, পড়াশোনা সব তো এখানেই। দাদাদের বাইরে চলে যাওয়ার পর বারান্দাসংলগ্ন বাঁশের বেড়াযুক্ত কোঠাটিও একদিন তার একান্ত ব্যক্তিগত কক্ষ হয়ে উঠেছিল। শেষ কৈশোরে এই কোঠাতে বসেই তার শরীরচর্চা আর দেহজুড়ে বেড়ে-ওঠা লক্ষণের অবাক পর্যবেক্ষণ। আবার এখানে বসেই নিমগ্ন পড়াশোনার ফসল ম্যাট্রিকে এক চোখধাঁধানো ফলাফল। এরপর একদিন পড়াশোনার পাট চুকিয়ে উচ্চ পদে চাকরি পেয়ে দাদাদের মতোই বাইরে বেরিয়ে যায় অর্ঘ্য, স্বাভাবিক নিয়মে। ইতিমধ্যে বিয়ে হয়ে যায় দিদিরও। সন্তানরা যখন বড় হয়ে বাইরে চলে যায় ততদিনে বয়সের ভারে ন্যুব্জ বাবা মায়ের পক্ষে আর ভিটেমাটি আঁকড়ে পড়ে থাকা সম্ভব হয়ে ওঠে না। বহু জল্পনা কল্পনার শেষে ত...