Skip to main content

নিবিড় পাঠযোগ্য সমৃদ্ধ ‘মানবী’


‘উনিশ বছর, ৭২তম সংখ্যা ক্যালেন্ডারের হিসেবে দীর্ঘদিন এই দীর্ঘ চলার পথে নিঃসন্দেহে জীবনের অনেক কথাই লেখা হয়েছে; তবু মনে হয় অনেক কথাই তো লেখা হয়ে ওঠেনি মনের অবচেতনে সেসব কথা অস্পষ্ট ঘোরাফেরা করেছে, কিন্তু স্পষ্ট হয়ে লেখায় আসেনি আসলে আমাদের সংস্কার কিছু কিছু বিষয়ে আমাদেরকে এখনও শেকল বন্দি করে রেখেছে। আমরা সেই তালাবন্ধ শেকল নিয়ে কখনও কখনও নাড়াচাড়া হয়তো করেছি; কিন্তু সেই তালা ভাঙার সাহস এখনও অর্জন করতে পারিনি...
অকপট উচ্চারণে এই কথাটি রয়েছে উপর্যুক্ত সম্পাদকীয়তেবস্তুত ‘মানবী’ নিরন্তর এক উত্তরণের চেষ্টায় যে রত রয়েছে তা অনস্বীকার্য। তাই তো উত্তরপূর্বের, বিশেষ করে বরাক উপত্যকার শিলচর থেকে চারজন বিশিষ্ট কবি, লেখক দ্বারা সম্পাদিত এই পত্রিকা এক বিশেষ স্থান ধরে রাখতে পেরেছে নিরবধি। তাছাড়া বছরে চার চারটি সংখ্যা নিয়মিত ভাবে প্রকাশ করাও আজকের শত ব্যস্ততার দিনে যে এক অনবদ্য কৃতিত্ব তাতেও কোন সন্দেহ থাকার কথা নয়। আলোচ্য সংখ্যাটি অর্থাৎ এই ৭২তম সংখ্যা, জুলাই - সেপ্টেম্বর ২০২৫ প্রকাশিত হয়েছে শারদীয় সংখ্যা হিসেবে - চারের এক, দোলনচাঁপা দাসপাল-এর সম্পাদনায়।
রেগুলার ১/৪ হাফ ট্যাবলয়েড সাইজের, ১২৪ পৃষ্ঠার সম্ভারে সযত্নে স্থান দেওয়া হয়েছে গল্প, কবিতা, ভ্রমণ কাহিনি ও গ্রন্থ আলোচনা। অনেকেটাই স্বয়ংম্পূর্ণ। তবে সব মিলিয়ে কিন্তু গল্পবিভাগটিই অধিকতর সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছে। বিভাগ প্রারম্ভে না থাকলেও সূচিপত্রে থাকা সুচিন্তিত বিভাগবিন্যাস অনুযায়ী ‘কবিতার বাতিঘর’-এ যাঁরা রয়েছেন তাঁরা হলেন - চন্দ্রিমা দত্ত, শেলী দাসচৌধুরী, বিকাশ সরকার, কমলিকা মজুমদার, নীলাদ্রি ভট্টাচার্য, অভীককুমার দে, অপাংশু দেবনাথ, ড. লক্ষ্মী নাথ, শ্যামলী ভট্টাচার্য পাল, দেবাঙ্কিতা চক্রবর্তী। অধিকাংশ নামই কবিদের ভুবনে প্রোজ্জ্বল। কবিদের সেরা কবিতা না হলেও রয়েছে কারও কারও একাধিক কবিতা, কাব্যগুণসমৃদ্ধ কবিতা
‘গল্পের জানালা’ নামাঙ্কিত গল্পবিভাগে আছে ১৩টি গল্পের সম্ভারলিখেছেন শর্মিলা দত্ত, দোলনচাঁপা দাসপাল, জয়িতা দাস, বিদ্যুৎ চক্রবর্তী, মেঘদূত সেন, সুপ্রদীপ দত্তরায়, কনকদীপ শর্মা, তৃণময় সেন, চন্দ্রিমা দত্ত, মীনাক্ষী চক্রবর্তী সোম, অমিতাভ সেনগুপ্ত, বিশ্বরাজ ভট্টাচার্য ও দেবদত্ত চক্রবর্তী। বস্তুত গল্পকার হিসেবে আজকের দিনে সব পরিচিত নাম এবং সেই সুবাদে রয়েছে কিছু অনবদ্য গল্পও। প্রতিটি গল্পের আলাদা আলোচনা পরিসরের অভাবে সম্ভব নয় যদিও বলা যায় দোলনচাঁপা, সুপ্রদীপ ও জয়িতা এক কথায় অনবদ্য। মানসম্পন্ন ভালো গল্প এই অঞ্চলে লেখা হয় কি না বলে যাঁরা সন্দিহান তাঁরা একবার পড়ে দেখতে পারেন। চলনে সমৃদ্ধ তৃণময়, মেঘদূত, দেবদত্তের গল্পও অবশ্যপাঠ্য। শর্মিলার গল্পে ভাষাসাহিত্যের উৎকর্ষ লক্ষণীয়।
‘ভ্রমণ’ বিভাগে সংহিতা চক্রবর্তীর ‘কাশ্মীর ভ্রমণ কথা’ - সার্বিক ও সুসংহত। আলাদা আলাদা অন্তর্শিরোনামে সুবিন্যস্ত সব স্থান-কাল-পাত্রের বর্ণনাময় সুখপঠনে ভ্রমণপিপাসার জন্ম দেয়। ‘পাঠক মানসে’ বিভাগে লেখালেখি ও গ্রন্থ আলোচনা পর্যায়ে প্রথমেই রয়েছে মেঘমালা দে মহন্ত লিখিত ‘নিবিড় পাঠে বরাকপারের কয়েকটি গল্প’। বিগত পঁচিশ বছরের সময়কালে বরাকের কয়েকজন গল্পকারের এই অঞ্চলের জীবনধারার সার্বিক সংকট বিষয়ে লেখা গল্পসমূহের মধ্য থেকে শর্মিলা দত্তের ‘নিঝুম মাইলংডিসা’, দীপেন্দু দাসের ‘নিতান্তই অপ্রাসঙ্গিক গল্প’ ও দোলনচাঁপা দাসপালের ‘হামারী আজব কাহিনি’ গল্পগুলির সঙ্গে কথাকার রণবীর পুরকায়স্থের সার্বিক লেখালেখির কিছু হদিশ সহ নিবিড় আলোচনায় উঠে এসেছে বহু প্রাসঙ্গিক কথা। একটি অবশ্যপাঠ্য আলোচনা। সম্ভবত পরিসরের কথা ভেবেই মঞ্জরী হীরামণি রায়ের গ্রন্থ আলোচনা ‘দীপেন্দু দাসের ছোটগল্প - নিবিড় পাঠ’ কিছুটা সংক্ষিপ্ত যদিও আলোচক যথাসম্ভব ছুঁয়ে গেছেন আলোচ্য গ্রন্থের অধিকাংশ গল্প ও তার নির্যাস।
সংখ্যাটিতে ছাপার স্পষ্টতা যথাযথ হলেও ছাপার বিভ্রাটও রয়েছে গুটিকয়েক। বানানবিভ্রাট এ অঞ্চলের পত্রপত্রিকার এক অনিবার্য অভিশাপ। আলোচ্য সংখ্যাটির গদ্য বিভাগের প্রতিটি রচনায় এই বিভ্রাটের উপস্থিতি। লেখক সম্পাদকের এ নিয়ে অধিকতর দায়িত্বশীল হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। অন্যথায় এই উর্বর বাংলা ভুবনটি হয়তো সত্যিকার অর্থেই ‘তৃতীয় ভুবন’ হয়ে রইবে চিরদিন। প্রচ্ছদচিত্রটি প্রাসঙ্গিক হলেও অপেক্ষাকৃত কম স্পষ্ট প্রচ্ছদ অলংকরণ অধিকতর নান্দনিক হতে পারত। এর বাইরে গভীর চিন্তাশীলতা ও দায়বদ্ধতার এক উন্নত শারদ সম্ভার - ‘মানবী’।

বিদ্যুৎ চক্রবর্তী

‘মানবী’
সম্পাদক - দোলনচাঁপা দাসপাল
মূল্য - ১০০ টাকা। 

Comments

Popular posts from this blog

শেকড়ের টানে নান্দনিক স্মরণিকা - ‘পরিযায়ী’

রামকৃষ্ণনগর । প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আবহে বরাক উপত্যকার এক ঐতিহ্যময় শহর । বিশেষ করে শিক্ষাদীক্ষার ক্ষেত্রে চিরদিনই এক অগ্রণী স্থান হিসেবে উচ্চারিত হয়ে আসছে এই নাম । বৃহত্তর রামকৃষ্ণনগরের গোড়াপত্তনের ইতিহাস বহুদিনের । দেশভাগের আগে ও পরে , উত্তাল সময়ে স্থানচ্যূত হয়ে এখানে থিতু হতে চাওয়া মানুষের অসীম ত্যাগ ও কষ্টের ফলস্বরূপ গড়ে ওঠে এক বিশাল বাসযোগ্য অঞ্চল । শুধু রুটি , কাপড় ও ঘরের স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রই নয় , এর বাইরে শিক্ষা অর্জনের ও শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে মমনশীলতার পরিচয় দিয়েছিলেন সেইসব মহামানবেরা । ফলস্বরূপ এক শিক্ষিত সমাজব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল যদিও উচ্চশিক্ষার জন্য পরবর্তী প্রজন্মকে বেরোতে হয়েছিল নিজ বাসস্থান ছেড়ে । শিলচর তখন এ অঞ্চলের প্রধান শহর হওয়ায় স্বভাবতই শিক্ষা ও উপার্জনের স্থান হিসেবে পরিগণিত হয় । এবং স্বভাবতই রামকৃষ্ণনগর ছেড়ে এক বৃহৎ অংশের মানুষ এসে পাকাপাকিভাবে থাকতে শুরু করেন এই শিলচরে । এই ধারা আজও চলছে সমানে । শিলচরে এসেও শেকড়ের টানে পরস্পরের সাথে যুক্ত থেকে রামকৃষ্ণনগর মূলের লোকজনেরা নিজেদের মধ্যে গড়ে তোলেন এক সৌহার্দমূলক বাতাবরণ । এবং সেই সূত্রেই ২০০০ সালে গঠিত হয় ‘ ...

নিবেদিত সাহিত্যচর্চার গর্বিত পুনরাবলোকন - ‘নির্বাচিত ঋতুপর্ণ’

সাধারণ অর্থে বা বলা যায় প্রচলিত অর্থে একটি সম্পাদনা গ্রন্থের মানে হচ্ছে মূলত অপ্রকাশিত লেখা একত্রিত করে তার ভুল শুদ্ধ বিচার করে প্রয়োজনীয় সংশোধন ও সম্পাদনার পর গ্রন্থিত করা । যেমনটি করা হয় পত্রপত্রিকার ক্ষেত্রে । অপরদিকে সংকলন গ্রন্থের অর্থ হচ্ছে শুধুই ইতিপূর্বে প্রকাশিত লেখাসমূহ এক বা একাধিক পরিসর থেকে এনে হুবহু ( শুধুমাত্র বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে ন্যূনতম সংশোধনসাপেক্ষে ) একত্রীকরণ । সেই হিসেবে আলোচ্য গ্রন্থটি হয়তো সম্পাদনা গ্রন্থ নয় , একটি সংকলন গ্রন্থ । বিস্তারিত জানতে হলে যেতে হবে সম্পাদক ( সংকলক ) সত্যজিৎ নাথের বিস্তৃত ভূমিকায় । পুরো ভূমিকাটিই যদি লেখা যেতো তাহলে যথাযথ হতো যদিও পরিসর সে সায় দেয় না বলেই অংশবিশেষ তুলে ধরা হলো এখানে - ‘ সালটা ১৯৯০ । ‘ দৈনিক সোনার কাছাড় ’- এ একবছর হল আসা - যাওয়া করছি । চাকরির বয়স হয়নি তাই চাকরি নয় , এই ‘ আসা - যাওয়া ’ । …. হঠাৎ করেই একদিন ভূত চাপল মাথায় - পত্রিকা বের করব । ‘… সেই শুরু । অক্টোবর ১৯৯০ সালে শারদ সংখ্যা দিয়ে পথচলা শুরু হল ‘ঋতুপর্ণ’র। পরপর দুমাস বের করার পর সেটা হয়ে গেল ত্রৈমাসিক। পুরো পাঁচশো কপি ছাপাতাম ‘মৈত্রী প্রকাশনী’ থেকে।...

মহানিষ্ক্ৰমণ

প্রায় চল্লিশ বছর আগে গ্রামের সেই মায়াময় বাড়িটি ছেড়ে আসতে বেজায় কষ্ট পেয়েছিলেন মা ও বাবা। স্পষ্ট মনে আছে অর্ঘ্যর, এক অব্যক্ত অসহায় বেদনার ছাপ ছিল তাঁদের চোখেমুখে। চোখের কোণে টলটল করছিল অশ্রু হয়ে জমে থাকা যাবতীয় সুখ দুঃখের ইতিকথা। জীবনে চলার পথে গড়ে নিতে হয় অনেক কিছু, আবার ছেড়েও যেতে হয় একদিন। এই কঠোর বাস্তব সেদিন প্রথমবারের মতো উপলব্ধি করতে পেরেছিল অর্ঘ্যও। সিক্ত হয়ে উঠছিল তার চোখও। জন্ম থেকে এখানেই যে তার বেড়ে ওঠা। খেলাধুলা, পড়াশোনা সব তো এখানেই। দাদাদের বাইরে চলে যাওয়ার পর বারান্দাসংলগ্ন বাঁশের বেড়াযুক্ত কোঠাটিও একদিন তার একান্ত ব্যক্তিগত কক্ষ হয়ে উঠেছিল। শেষ কৈশোরে এই কোঠাতে বসেই তার শরীরচর্চা আর দেহজুড়ে বেড়ে-ওঠা লক্ষণের অবাক পর্যবেক্ষণ। আবার এখানে বসেই নিমগ্ন পড়াশোনার ফসল ম্যাট্রিকে এক চোখধাঁধানো ফলাফল। এরপর একদিন পড়াশোনার পাট চুকিয়ে উচ্চ পদে চাকরি পেয়ে দাদাদের মতোই বাইরে বেরিয়ে যায় অর্ঘ্য, স্বাভাবিক নিয়মে। ইতিমধ্যে বিয়ে হয়ে যায় দিদিরও। সন্তানরা যখন বড় হয়ে বাইরে চলে যায় ততদিনে বয়সের ভারে ন্যুব্জ বাবা মায়ের পক্ষে আর ভিটেমাটি আঁকড়ে পড়ে থাকা সম্ভব হয়ে ওঠে না। বহু জল্পনা কল্পনার শেষে ত...