Skip to main content

সুখপাঠ্য অণুগল্প সংকলন ‘ডজন দুই গপ্পো’


গল্প ও গপ্পো শব্দদু’টির মূল উপাদান যদিও কাহিনি বা গল্প তবু এর মধ্যে কিছু ব্যুৎপত্তিগত, কিছু অর্থগত ভিন্নতা রয়েছে। গপ্পো (কথ্য) শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে গালগল্প, খোশগল্প, হালকা বা শিশুবোধ্য গল্প, অতিরঞ্জিত কাহিনি ইত্যাদি।
কবি, অনুবাদক সত্যজিৎ চৌধুরীর সদ্য প্রকাশিত গল্প সংকলনের নাম ‘ডজন দুই গপ্পো’। সংকলনে উপরোক্ত সব উপাদানই রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন গল্পে। গ্রন্থনামেই প্রতীয়মান যে এই গ্রন্থে সন্নিবিষ্ট হয়েছে মোট ২৪ টি গল্প। সাকুল্যে ৫২ পৃষ্ঠার সংকলনে গ্রন্থনাম, ভূমিকা আদি বাদ দিলে গল্পের ভাগ ৪৪ পৃষ্ঠা। আসলে শুধু একটি গল্পের বাইরে সবগুলিই এক থেকে দুই পৃষ্ঠার অণুগল্প। তাই প্রথমেই বলে নেওয়া ভালো যে এটি কোনোভাবেই ছোটগল্পের সংকলন নয়।
কৃতী সাহিত্যিক বিশ্বজিত নাগ-এর ভূমিকায় সম্যক পরিচিতি লাভ করা যায় কিছু গল্পের। ভিন্নতর প্রেক্ষিতে বিভিন্ন বিষয়ের উপর লিখা হয়েছে গল্পগুলি। ধর্মীয় সমন্বয়ের উপর রয়েছে একাধিক গল্প যেগুলো আজকের পরিবর্তিত দিনে কিছুটা সেকেলে মনে হতে পারে। গল্পের মধ্য দিয়ে বর্তমানকে ধরে রাখার প্রয়াসে হয়তো এই গল্পগুলি খাপ খায় না তবে অতীত স্মৃতিচারণের মাধ্যমে শুভচিন্তাকে ফিরিয়ে আনার প্রয়াসও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।
বেশ কিছু গল্প অনায়াসে ছোটগল্পের অবয়বে পর্যবসিত হতে পারত। কিন্তু সে পথে ইচ্ছে করেই হয়তো হাঁটেননি গল্পকার। ‘বনানী, গারোপাহাড় ও কিছু স্মৃতি’ গল্পটিই গ্রন্থের একমাত্র ছোটগল্প। স্মৃতিচারণমূলক লেখা হলেও গল্পের বুনোটে একটি সুখপাঠ্য গল্প। বিষয়ে, বয়ানে তরতরিয়ে এগিয়েছে গল্প।
আলোচনার শুরুতেই লিখা মতো কিছু অণুগল্প রয়েছে শিশু কিশোরদের উপযোগীও। আছে বেশক’টি নিটোল সুখের গল্প। করোনার আবহে রয়েছে ভিন্নতর ভাবনার কিছু গল্প। ‘প্রকৃত মা’ গল্পটি সিদ্ধান্তের উৎকৃষ্টতায় এক চমৎকার গল্প। একজন নারী হয়ে আরেক নারীর, মা হয়ে কন্যার সুখী জীবনের সন্ধান দেওয়ার মতো একটি আদর্শগত ভাবনার সার্থক অণুগল্প। ‘সন্তান’ গল্পটিও সম্পর্কের ব্যতিক্রমী রূপের উপর লিখিত স্নিগ্ধতায় ভরপুর একটি গল্প। ধর্মাধর্মের যুগোপযোগী গল্প ‘সান্তা দাদু’। ‘সুখ’ গল্পটিও বাস্তবের ভিত্তিতে লিখিত এক ভিন্ন অবস্থার নির্মোহ বিশ্লেষণ। শেষ দু’টি লাইন উল্লেখযোগ্য -
‘আজ সুবীরের কাছে কেউ নেই। একমাত্র পুত্র সৌরভ বিদেশে ছয় বছর হয়ে গেল। নাতির মুখ তিন বছর হল দেখা হয়নি। নাতি দাদুর কথা ভুলেই গেছে হয়তো।’ অন্যদিকে -
‘সাধারণ মানের ছাত্র হরিপদ আজ পত্নী-ছেলে-পুত্রবধূ-নাতি-নাতনি নিয়ে কী আনন্দেই না আছে। সুখ যে কার কাছে কীভাবে ধরা দেয়, ঈশ্বরই একমাত্র জানেন।‘
আধখানা পৃষ্ঠাজোড়া অণুগল্প ‘বৃদ্ধাশ্রম’ একটি অসাধারণ মানবিকতা গুণসম্পন্ন রচনা। আদর্শ ও বেঁচে থাকার তাগিদ - এই দুয়ের বিচিত্র টানাপোড়েনের গল্প ‘সংঘর্ষ’। চমৎকার বুনোট। ভাষা নিয়ে একটি মজাদার হাসির গল্প ‘ভাষাবিভ্রাট’। ‘ভোরের কুয়াশা’ গল্পটিতে লুকিয়ে রয়েছে একটি বড় গল্প হয়ে ওঠার যাবতীয় উপাদান। তবু অণুগল্পেও যতটা সম্ভব নিজেকে মেলে ধরেছেন গল্পকার। আজকের দিনে অফিস কালচারের ক্ষয়িষ্ণু দিকটায় আলোকপাত করে বিষয় বৈচিত্র্যেও এক ভিন্নতা এনে দিতে সক্ষম হয়েছেন। ‘উচ্চাকাঙ্ক্ষা’ গল্পটিতে বর্তমান সমাজে শিশু কিশোর ছাত্রছাত্রীদের অভিভাবকদের ক্ষয়প্রাপ্ত মানসিকতার চরিত্র উদঘাটিত হয়েছে। ‘শ্রেষ্ঠ উপহার’ ও ‘জলছবি’ গল্প দু’টি সুখানুভূতির এক একটি নিটোল বাখান।
কিছু গল্প ঠিক জমে ওঠেনি যদিও গল্পকার একটি বার্তা পোয়ঁছে দেওয়ার চেষ্টায় কোনও খামতি রাখেননি। কিছু গল্পে চাওয়া না চাওয়া - পাওয়া না পাওয়ার বিরল অনুভূতি প্রকাশ পেয়েছে। জীবনের সুখ দুঃখের টুকরো কথা, জীবনবোধের কথা এসেছে একাধিক গল্পে। ব্যস্ত পাঠকের কাছে ছোট ছোট সুখ দুঃখের এই গল্পসমূহ সততই সুখপাঠ্য হয়ে থাকবে। বোদ্ধা পাঠকের অনুভবে - আরোও খানিকটা বিস্তৃতি নিয়ে এক একটি সার্থক ছোটগল্প হয়ে ওঠার আকুতি থেকে যেতেই পারে।
পাকা বাঁধাইয়ের সংকলনে চব্বিশটি কড়ি সম্বলিত ছিমছাম নান্দনিক প্রচ্ছদ পরিকল্পনায় শ্রাবন্তী চৌধুরী। গ্রন্থটি উৎসর্গ করা হয়েছে লেখকের ‘স্বর্গগত বাবা-মা সুধাংশু রঞ্জন চৌধুরী ও ননীবালা চৌধুরীর চরণকমলে’। কলকাতার পৌষালী প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত গ্রন্থে অনেকগুলি ভুল বানান থেকে গেছে। এছাড়াও বাক্যের শেষে ক্রিয়াপদে ও-কারের বহুল ব্যবহার পঠনকটু হয়েছে। যেমন গেলো, দিলো ইত্যাদি। পরবর্তীতে এদিকটায় অধিক যত্নবান হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে বইকী। ছাপাই ও বর্ণবিন্যাস যথাযথ।  
সব মিলিয়ে একটি সুখপাঠ্য সংকলন একথা বলা যায় নিঃসন্দেহে। পরবর্তীতে সার্থক ছোটগল্পের আশা করা যেতেই পারে গ্রন্থকার থেকে।

- বিদ্যুৎ চক্রবর্তী।

‘ডজন দুই গপ্পো’
সত্যজিৎ চৌধুরী
মূল্য - ১৫০ টাকা
যোগাযোগ - ৯৪০২৬৯৮৩৫৫

Comments

Popular posts from this blog

উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বাংলা গল্প : বিষয়ে বিশ্লেষণে

একক কিংবা যৌথ সম্পাদনায় বিগত কয়েক বছরে উত্তরপূর্বের বাংলা লেখালেখি বিষয়ক একাধিক গ্রন্থ সম্পাদনা করে এই সাহিত্যবিশ্বকে পাঠকের দরবারে পরিচিত করিয়ে দেওয়ার এক প্রচেষ্টা করে যাচ্ছেন নিবেদিতপ্রাণ তরুণ লেখক ও সম্পাদক নিত্যানন্দ দাস । হালে এপ্রিল ২০২৪ - এ প্রকাশিত হয়েছে তাঁর সম্পাদনা গ্রন্থ ‘ উত্তর - পূর্বাঞ্চলের বাংলা গল্প : বিষয়ে বিশ্লেষণে ’ ( প্রথম খণ্ড ) । প্রকাশক - একুশ শতক , কলকাতা । আলোচ্য গ্রন্থটিতে দুই ছত্রে মোট ২৮ জন বিশিষ্ট প্রাবন্ধিকের ২৮টি প্রবন্ধ রয়েছে । উপযুক্ত বিষয় ও আলোচকদের নির্বাচন বড় সহজ কথা নয় । এর জন্য প্রাথমিক শর্তই হচ্ছে নিজস্ব জ্ঞানার্জন । কালাবধি এই অঞ্চল থেকে প্রকাশিত উৎকৃষ্ট সাহিত্যকৃতির সম্বন্ধে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল না হলে তা সম্ভব নয় মোটেও । নিত্যানন্দ নিজেকে নিমগ্ন রেখেছেন গভীর অধ্যয়ন ও আত্মপ্রত্যয়কে সম্বল করে তা বলার অপেক্ষা রাখে না । আলোচ্য গ্রন্থের ভূমিকা লিখেছেন প্রতিষ্ঠিত কথাকার রণবীর পুরকায়স্থ । বস্তুত সাত পৃষ্ঠা জোড়া এই ভূমিকা এক পূর্ণাঙ্গ আলোচনা । ভূমিকা পাঠের পর আর আলাদা করে আলোচনার কিছু থাকে না । প্রতিটি নিবন্ধ নিয়ে পরিসরের অভাবে সংক্ষিপ্ত হলেও ...

শেকড়ের টানে নান্দনিক স্মরণিকা - ‘পরিযায়ী’

রামকৃষ্ণনগর । প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আবহে বরাক উপত্যকার এক ঐতিহ্যময় শহর । বিশেষ করে শিক্ষাদীক্ষার ক্ষেত্রে চিরদিনই এক অগ্রণী স্থান হিসেবে উচ্চারিত হয়ে আসছে এই নাম । বৃহত্তর রামকৃষ্ণনগরের গোড়াপত্তনের ইতিহাস বহুদিনের । দেশভাগের আগে ও পরে , উত্তাল সময়ে স্থানচ্যূত হয়ে এখানে থিতু হতে চাওয়া মানুষের অসীম ত্যাগ ও কষ্টের ফলস্বরূপ গড়ে ওঠে এক বিশাল বাসযোগ্য অঞ্চল । শুধু রুটি , কাপড় ও ঘরের স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রই নয় , এর বাইরে শিক্ষা অর্জনের ও শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে মমনশীলতার পরিচয় দিয়েছিলেন সেইসব মহামানবেরা । ফলস্বরূপ এক শিক্ষিত সমাজব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল যদিও উচ্চশিক্ষার জন্য পরবর্তী প্রজন্মকে বেরোতে হয়েছিল নিজ বাসস্থান ছেড়ে । শিলচর তখন এ অঞ্চলের প্রধান শহর হওয়ায় স্বভাবতই শিক্ষা ও উপার্জনের স্থান হিসেবে পরিগণিত হয় । এবং স্বভাবতই রামকৃষ্ণনগর ছেড়ে এক বৃহৎ অংশের মানুষ এসে পাকাপাকিভাবে থাকতে শুরু করেন এই শিলচরে । এই ধারা আজও চলছে সমানে । শিলচরে এসেও শেকড়ের টানে পরস্পরের সাথে যুক্ত থেকে রামকৃষ্ণনগর মূলের লোকজনেরা নিজেদের মধ্যে গড়ে তোলেন এক সৌহার্দমূলক বাতাবরণ । এবং সেই সূত্রেই ২০০০ সালে গঠিত হয় ‘ ...

কবির মজলিশ-গাথা

তুষারকান্তি সাহা   জন্ম ১৯৫৭ সাল৷ বাবা প্ৰয়াত নিৰ্মলকান্তি সাহা ও মা অমলা সাহার দ্বিতীয় সন্তান   তুষারকান্তির ৮ বছর বয়সে ছড়া রচনার মাধ্যমে সাহিত্য ভুবনে প্ৰবেশ৷ ‘ ছায়াতরু ’ সাহিত্য পত্ৰিকায় সম্পাদনার হাতেখড়ি হয় কলেজ জীবনে অধ্যয়নকালীন সময়েই৷ পরবৰ্তী জীবনে শিক্ষকতা থেকে সাংবাদিকতা ও লেখালেখিকেই পেশা হিসেবে গ্ৰহণ করেন৷ প্ৰথম ছড়া প্ৰকাশ পায় সাতের দশকে ‘ শুকতারা ’ য়৷ এরপর ‘ দৈনিক যুগশঙ্খ ’ পত্ৰিকার ‘ সবুজের আসর ’, দৈনিক সময়প্ৰবাহ ও অন্যান্য একাধিক কাগজে চলতে থাকে লেখালেখি৷ নিম্ন অসমের সাপটগ্ৰামে জন্ম হলেও বৰ্তমানে গুয়াহাটির স্থায়ী বাসিন্দা তুষারকান্তির এ যাবৎ প্ৰকাশিত গ্ৰন্থের সংখ্যা ছয়টি৷ এগুলো হচ্ছে নগ্ননিৰ্জন পৃথিবী (দ্বৈত কাব্যগ্ৰন্থ) , ভবঘুরের অ্যালবাম (ব্যক্তিগত গদ্য) , একদা বেত্ৰবতীর তীরে (কাব্যগ্ৰন্থ) , প্ৰেমের গদ্যপদ্য (গল্প সংকলন) , জীবনের আশেপাশে (উপন্যাস) এবং শিশু-কিশোরদের জন্য গল্প সংকলন ‘ গাবুদার কীৰ্তি ’ ৷ এছাড়াও বিভিন্ন পত্ৰপত্ৰিকায় প্ৰকাশিত হয়েছে শিশু কিশোরদের উপযোগী অসংখ্য অগ্ৰন্থিত গল্প৷ রবীন্দ্ৰনাথের বিখ্যাত ছড়া , কবিতা ও একাধিক ছোটগল্প অবলম্বনে লিখেছেন ...