Skip to main content

প্রত্যয়িত পথ চলার অঙ্গীকার - ‘এবং হাঁটছি’


এক খেয়ালি কবির কবিতাযাত্রার বয়ান। ইচ্ছেরা তার ডানা মেলে এমন এক অনুষঙ্গের সৃষ্টি করে যা ‘শুধু কবিতার জন্য’। কবিতার জন্য কবি পথে নেমেছেন এবং পথ হাঁটছেন খেয়ালে, খুশিতে -
পৃথিবীর শেষ রাস্তা ধরে পৌঁছে যাবো
নিশীথ সূর্যের দেশে,
উত্তর মেরুর গায়ে হেলান দিয়ে
টানা বসন্ত জুড়ে রাত্রি উদ্যাপন করবো।
বসন্ত কেটে গেলে ধীরে ধীরে…
হিমবাহে সব ক্ষত খুলে রেখে,
সমুদ্রের জলে অস্তি বিসর্জন করে,
মহাপ্রস্থানের পথে যাত্রা করবো। (কবিতা - মহাপ্রস্থানের পথে)
কিংবা -
গাছ, মাটি আর জলের বন্দনা করি,
ঘুমের মন্ত্র উচ্চারণে নেমে আসুক
পুনর্জন্ম।
আমাকে পাতার দেশে নিয়ে চলো
বাতাস আমার অসুখ শুষে নিক,
আমি মাটির কাছে আনত হবো,
পাতার শরীরে এঁকে দেবো চুম্বন।
বীজ আহরণ করবো,
মন্ত্রপূত সূর্যকণা পুঁতে দেবো মৃত্তিকার
গর্ভাশয়ে। (কবিতা - পুনর্জন্ম হোক)
শেষোক্ত কবিতায় কবির নিরলস পথ চলার বাইরেও লক্ষ করলে দেখা যায় একগুচ্ছ শব্দাবলি যা কবির কাব্যমনষ্কতার পরিচায়ক। এক ঘোর লাগা পঙ্ক্তিসুখ খুঁজে পাওয়া যায় কবিতায়। এক পাগলপারা ইচ্ছেসুখের আবেগতাড়িত বয়ান, যেখানে পথ ও প্রকৃতিও এসেছে গভীর অনুষঙ্গ হিসেবে। এই কবিতায় আছে গাছ, মাটি জল, পাতা, বাতাস, বীজ, সূর্য আদি প্রাকৃতিক খুঁটিনাটির প্রতি এক সুগভীর ভালোবাসা ও প্রত্যয়ের অঙ্গীকার। আর শুধু এখানেই নয়, কবির একের পর এক কবিতায় এসব উঠে এসেছে অনবদ্য অনুষঙ্গ হিসেবে। কবিতায় ধরা আছে একাধারে বাস্তব ও কল্পনার সুষমামণ্ডিত বাখান যা মধুমিতার কবিতাকে পাঠকের কাছে এনে দেয় পঠনসুখের এক অনিবার্য তৃপ্তি।
পাকা বাঁধাইয়ের ভিতর ৯৬ পৃষ্ঠা জুড়ে যে ৯০টি কবিতা আছে এবং কবির সেইসব কবিতায় মূলত যেসব বিষয় উঠে এসেছে তার মধ্যে সর্বাপেক্ষা বেশি আছে তাঁর অনুভবের কথা। প্রতিদিনের চলার পথে আহৃত নানা বাস্তব অনুষঙ্গ অনুভব হয়ে ধরা আছে কবিতায়। উদাহরণ - জোনাকি, সবুজ বাতি, রোদ্দুর হারিয়ে গেছে, মাকড়সার জাল, জেগে আছি, ভোগের লোভ, বুনো হংসীর পালকে, পাতার ঘর, গোলাপি বৈধব্য, প্রলাপ, ঘাসফুল, দাবানল হবে, গাছের ভেতর গাছ, জননী, পাখিরা বেঁচে থাকুক, প্রতিবাদ, কথাগুচ্ছ, ওপারে, সব কথা গল্প নয়, ক্যাথারসিস, কথার পিঠে কথা, একাকার, এখনো ঘড়ি চলছে, এমন অনেক কথা আছে, একবুক আগুন, দুন্দুবুড়ি, একটা শার্ট, সবাই গেছে বনে, চোঁয়া ঢেকুর, অরণ্যে মিশে যাই, সমুদ্র, এবং হাঁটছি, আমার ইচ্ছে, বাউণ্ডুলে, আবরণ, গল্পরা রোজ জন্মায়, আয়না ইত্যাদি। এছাড়া রয়েছে একাধিক কবিতা যার মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হল প্রহসন, শ্লেষ, বিদ্রুপ, বাস্তব, কল্পনা, বিদ্রোহ, প্রতিবাদ, দুঃখ, যন্ত্রণা, প্রত্যয়, এলোমেলো ভাবনা, ইচ্ছে আদি। এ সবই নিক্তিধরা মুনশিয়ানায় ধরা আছে কবিতার শরীরে। 
কিছু কবিতার কিছু অনবদ্য পঙ্ক্তি কবিতাসমূহকে একদিকে যেমন করে তুলেছে মোহনীয় তেমনি অন্যদিকে ভবিতব্যের পাতায় উদ্ধৃতিযোগ্যও। কিছু উদাহরণ -
জোয়ার যখন জাগে/ নদীর বুকে,/ প্রেমের ঈশ্বর তখন/ ফাল্গুনী নক্ষত্রে রমণীয় নিশিযাপন করে,/ ভাঙা মনের অশরীরী সহবাস,/ দীর্ঘশ্বাস শুধু/ পড়ে থাকে -। (কবিতা - অনুভূতির প্রহসনে)।
সমস্ত পথের সীমা মাপা হয়ে গেলে -/ আয়না তার শেষ স্তবকে লিখে যাবে/ একলা হরিণীর জেগে থাকার গল্প। (কবিতা - আয়না)।
কতটা ঘাম ঝরালে মেরুদণ্ড তৈরি করা যায়/ জানি…/ ঘামের ওজন পরিমাপ হয় না।/ পিঠে পেরেক পুঁতে আছে,/ বুকে জ্বলন্ত কয়লা,/ ছাই দিয়ে মহাশ্মশানে লিখে যাব/ সাইক্লোন থেমে যাবার মন্ত্র। (কবিতা - সময়)।
এসব পঙ্ক্তি অনুভূতির ঝড় তোলে পাঠক হৃদয়ে, এসব পঙ্ক্তি কবিতাকে এনে দেয় অমরত্ব, চেনায় কবি ও কবিতার জাত। মধুমিতার কবিতা তাই অবিনশ্বর, সমাজের বুকে লিখে দেয় প্রশ্নচিহ্ন। গ্রন্থের ছাপা ও বর্ণসংস্থাপন যথাযথ। কিছু বানান বিভ্রাট রয়ে গেছে যদিও সংখ্যায় তা ব্যাপক নয়। যতিচিহ্নের ব্যবহার ও ক্রিয়াপদে অনাবশ্যক ও-কারের প্রবণতা অধিক পরিলক্ষিত হয়েছে কবিতায়। কবি গ্রন্থটি উৎসর্গ করেছেন তাঁর মা শ্রীমতী বিভা দে-কে যিনি বরাক উপত্যকার ভাষা সংগ্রামের একজন সেনানী। কবির ভাবনায় অঙ্কিত গ্রন্থের প্রচ্ছদ এক প্রত্যয়ের আভাস দেয়। আত্মপ্রত্যয়িত কবি তাই লিখেন -
আমি লিখে যাব আগুনের কথা,
যুদ্ধের কথা,
গ্রাম থেকে শহরের পথে
শহর থেকে অরণ্যে
বিনিদ্র রাতকে টেনে নেবো।
শব্দের চাবুকে নিজেকে চাবকে
নীরবতার বীজ রোপণ করবো কিরঘিজে,
মরুভূমির মশাল জ্বেলে দেবো
মানুষের মিছিলে।
হয় সব শ্মশান হোক
নয় হোক অরণ্য। (কবিতা - লিখে যাবো)।
বিদ্যুৎ চক্রবর্তী

প্রকাশক - দিগন্ত প্রকাশনী, ধর্মনগর
মূল্য - ১৮০ টাকা
যোগাযোগ - ৬০০৯৯৫৩২০১

Comments

  1. সমৃদ্ধ আলোচনা। ধন্যবাদ আপনাকে।

    ReplyDelete

Post a Comment

Popular posts from this blog

উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বাংলা গল্প : বিষয়ে বিশ্লেষণে

একক কিংবা যৌথ সম্পাদনায় বিগত কয়েক বছরে উত্তরপূর্বের বাংলা লেখালেখি বিষয়ক একাধিক গ্রন্থ সম্পাদনা করে এই সাহিত্যবিশ্বকে পাঠকের দরবারে পরিচিত করিয়ে দেওয়ার এক প্রচেষ্টা করে যাচ্ছেন নিবেদিতপ্রাণ তরুণ লেখক ও সম্পাদক নিত্যানন্দ দাস । হালে এপ্রিল ২০২৪ - এ প্রকাশিত হয়েছে তাঁর সম্পাদনা গ্রন্থ ‘ উত্তর - পূর্বাঞ্চলের বাংলা গল্প : বিষয়ে বিশ্লেষণে ’ ( প্রথম খণ্ড ) । প্রকাশক - একুশ শতক , কলকাতা । আলোচ্য গ্রন্থটিতে দুই ছত্রে মোট ২৮ জন বিশিষ্ট প্রাবন্ধিকের ২৮টি প্রবন্ধ রয়েছে । উপযুক্ত বিষয় ও আলোচকদের নির্বাচন বড় সহজ কথা নয় । এর জন্য প্রাথমিক শর্তই হচ্ছে নিজস্ব জ্ঞানার্জন । কালাবধি এই অঞ্চল থেকে প্রকাশিত উৎকৃষ্ট সাহিত্যকৃতির সম্বন্ধে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল না হলে তা সম্ভব নয় মোটেও । নিত্যানন্দ নিজেকে নিমগ্ন রেখেছেন গভীর অধ্যয়ন ও আত্মপ্রত্যয়কে সম্বল করে তা বলার অপেক্ষা রাখে না । আলোচ্য গ্রন্থের ভূমিকা লিখেছেন প্রতিষ্ঠিত কথাকার রণবীর পুরকায়স্থ । বস্তুত সাত পৃষ্ঠা জোড়া এই ভূমিকা এক পূর্ণাঙ্গ আলোচনা । ভূমিকা পাঠের পর আর আলাদা করে আলোচনার কিছু থাকে না । প্রতিটি নিবন্ধ নিয়ে পরিসরের অভাবে সংক্ষিপ্ত হলেও ...

শেকড়ের টানে নান্দনিক স্মরণিকা - ‘পরিযায়ী’

রামকৃষ্ণনগর । প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আবহে বরাক উপত্যকার এক ঐতিহ্যময় শহর । বিশেষ করে শিক্ষাদীক্ষার ক্ষেত্রে চিরদিনই এক অগ্রণী স্থান হিসেবে উচ্চারিত হয়ে আসছে এই নাম । বৃহত্তর রামকৃষ্ণনগরের গোড়াপত্তনের ইতিহাস বহুদিনের । দেশভাগের আগে ও পরে , উত্তাল সময়ে স্থানচ্যূত হয়ে এখানে থিতু হতে চাওয়া মানুষের অসীম ত্যাগ ও কষ্টের ফলস্বরূপ গড়ে ওঠে এক বিশাল বাসযোগ্য অঞ্চল । শুধু রুটি , কাপড় ও ঘরের স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রই নয় , এর বাইরে শিক্ষা অর্জনের ও শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে মমনশীলতার পরিচয় দিয়েছিলেন সেইসব মহামানবেরা । ফলস্বরূপ এক শিক্ষিত সমাজব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল যদিও উচ্চশিক্ষার জন্য পরবর্তী প্রজন্মকে বেরোতে হয়েছিল নিজ বাসস্থান ছেড়ে । শিলচর তখন এ অঞ্চলের প্রধান শহর হওয়ায় স্বভাবতই শিক্ষা ও উপার্জনের স্থান হিসেবে পরিগণিত হয় । এবং স্বভাবতই রামকৃষ্ণনগর ছেড়ে এক বৃহৎ অংশের মানুষ এসে পাকাপাকিভাবে থাকতে শুরু করেন এই শিলচরে । এই ধারা আজও চলছে সমানে । শিলচরে এসেও শেকড়ের টানে পরস্পরের সাথে যুক্ত থেকে রামকৃষ্ণনগর মূলের লোকজনেরা নিজেদের মধ্যে গড়ে তোলেন এক সৌহার্দমূলক বাতাবরণ । এবং সেই সূত্রেই ২০০০ সালে গঠিত হয় ‘ ...

কবির মজলিশ-গাথা

তুষারকান্তি সাহা   জন্ম ১৯৫৭ সাল৷ বাবা প্ৰয়াত নিৰ্মলকান্তি সাহা ও মা অমলা সাহার দ্বিতীয় সন্তান   তুষারকান্তির ৮ বছর বয়সে ছড়া রচনার মাধ্যমে সাহিত্য ভুবনে প্ৰবেশ৷ ‘ ছায়াতরু ’ সাহিত্য পত্ৰিকায় সম্পাদনার হাতেখড়ি হয় কলেজ জীবনে অধ্যয়নকালীন সময়েই৷ পরবৰ্তী জীবনে শিক্ষকতা থেকে সাংবাদিকতা ও লেখালেখিকেই পেশা হিসেবে গ্ৰহণ করেন৷ প্ৰথম ছড়া প্ৰকাশ পায় সাতের দশকে ‘ শুকতারা ’ য়৷ এরপর ‘ দৈনিক যুগশঙ্খ ’ পত্ৰিকার ‘ সবুজের আসর ’, দৈনিক সময়প্ৰবাহ ও অন্যান্য একাধিক কাগজে চলতে থাকে লেখালেখি৷ নিম্ন অসমের সাপটগ্ৰামে জন্ম হলেও বৰ্তমানে গুয়াহাটির স্থায়ী বাসিন্দা তুষারকান্তির এ যাবৎ প্ৰকাশিত গ্ৰন্থের সংখ্যা ছয়টি৷ এগুলো হচ্ছে নগ্ননিৰ্জন পৃথিবী (দ্বৈত কাব্যগ্ৰন্থ) , ভবঘুরের অ্যালবাম (ব্যক্তিগত গদ্য) , একদা বেত্ৰবতীর তীরে (কাব্যগ্ৰন্থ) , প্ৰেমের গদ্যপদ্য (গল্প সংকলন) , জীবনের আশেপাশে (উপন্যাস) এবং শিশু-কিশোরদের জন্য গল্প সংকলন ‘ গাবুদার কীৰ্তি ’ ৷ এছাড়াও বিভিন্ন পত্ৰপত্ৰিকায় প্ৰকাশিত হয়েছে শিশু কিশোরদের উপযোগী অসংখ্য অগ্ৰন্থিত গল্প৷ রবীন্দ্ৰনাথের বিখ্যাত ছড়া , কবিতা ও একাধিক ছোটগল্প অবলম্বনে লিখেছেন ...