কবিতার ঘোর - মহন্ত সিরিজ
কবিতা এমনই এক শিল্প যেখানে শব্দেরা কথা বলে এক একটি বাক্য হয়ে। কবি তাঁর মনের কথাটি প্রতিটি শব্দে এঁকে দেন নিপুণ পটুয়ার মতো। কবিতার তাই অবয়ব নয়, শব্দের পারিপাট্যই মুখ্য। দারুহরিদ্রা পাবলিকেশন থেকে প্রকাশিত হয়েছে কবি তপন মহন্ত-এর কবিতা-বই ‘মহন্ত সিরিজ’। শুধুমাত্র একটি সিরিজ নিয়ে একটি আস্ত কবিতার বই - সচরাচর এমনটা খুবই কম দেখা যায় যদিও এই সংকলনটি এমন সাহসের যাথার্থ্য প্রকাশ করেছে নিশ্চিত। ৩২ পৃষ্ঠার বইয়ে আছে নেই নেই করেও ২৮টি কবিতা যেখানে শব্দেরা কথা বলেছে আপন খেয়ালে। তাই এখানে ভারের চাইতে ধারের পাল্লা ভারী। এবং স্বভাবতই এমন দুঃসাহস প্রকৃত অর্থেই ষোলোআনা সফল।
বইটি উৎসর্গ করা হয়েছে ‘মহন্ত মহারাজ’কে। কৃতজ্ঞতা স্বীকার করা হয়েছে টংলার অভিজিৎ চক্রবর্তীর উদ্দেশে। যেহেতু ‘মহন্ত সিরিজ’, তাই স্বভাবতই স্বগতোক্তির পয়োভার। মনের কথাকে কবিতায় করা হয়েছে সুষমামণ্ডিত। তা বলে পাঠকের দরবারে তা মোটেও ব্যক্তিগত মনে হবে না। কারণ কবিতার মাধুর্য, কবিতার স্বকীয়তা, কবিতার কবিতাময়তা ছাপিয়ে গেছে সব বিপত্তি।
অধিকাংশ (বোধ করি প্রতিটি কবিতাই) নেওয়া হয়েছে তাঁর ইতিপূর্বে প্রকাশিত কাব্য সংকলনগুলো থেকে। তবে বেশির ভাগ কবিতাই এবার স্থাপিত হয়েছে পরিমার্জিত এবং পরিশোধিত হয়ে। পালটে গেছে কিছু শব্দ, কিছু পংক্তি। ধার বেড়েছে কবিতার। এক ঘোর লাগা শব্দসম্ভারে নিটোল হয়ে উঠেছে কবিতা, কবিতার বাখান।
স্বল্প কথায়, কবিতার ভাষায় মনের ভাবটি প্রকাশ করায় কবি সিদ্ধহস্ত। তাই কিছু কবিতা প্রায় পৃষ্ঠাজোড়া হলেও অধিকাংশ কবিতাই অবয়বে খাটো। কিন্তু অসমাপ্ত নয় মোটেও। আবার অধিকাংশ কবিতায় নস্টালজিয়ার পাশাপাশি কোথাও এক অতৃপ্তির ছায়া, এক অপূর্ণ সত্ত্বার আভাস, এক দুঃখময় জীবনবোধের প্রকাশ। উল্লেখ্য -
আমি মরে গেছি
তবু রয়ে সয়ে
বয়ে চলি জীবনের লাশ
প্রিয়ার কর্কটপ্রাপ্তি
এক পা ঘর তো অপরটি ভরলির চরে,
প্রতিদিন মৃত্যু পলে পলে
মানসিক রোগে ভুগে ছেলেপুলে
এইভাবে প্রতিদিন মৃত্যুসহ বাস
শুয়ে থাকি নির্ধারিত শরশয্যায়
কবিতা-কোরামিন
যতটা বাঁচায়।
(কবিতা - কবিতাগ্রস্ত)
একাধারে দুঃখবোধ, অন্যদিকে কবিতায় বেঁচে থাকা, কবিতায় সমর্পণ। মনকে নাড়া দেয় স্বল্প দৈর্ঘের কবিতাগুলি। শব্দের জাগ্লারিতে মধুময় হয়ে ওঠে মন -
গুরুবোন বললেন
সুখাসনে বসো
জ্ঞানমুদ্রায় ধ্যান করো
মনের গহনে ওঙ্কার ধ্বনি
চোখ বুঝলেই
গেরুয়া হারিয়ে
নীলেতে বিলীন
ধ্যানে তোমার পদ্মকোরকের হাতছানি …
(কবিতা - অবচেতন)
কিংবা -
মহন্ত সম্বোধন শুনতেই অভ্যস্ত আমি
যদিও নিজেকে সন্ত ভাবি নাই কোনোকালে
যখন কেউ আমাকে ‘তপন’ বলে ডাকে
কেন যেন আজকাল ‘পতন’ শুনতে পাই
- - - - - - - (কবিতা - অবদমন)
আছে কিছু বিশদ কবিতাও। যেমন - ডাহুকি, দেখা হয় যদি, কাকতৃষ্ণা, স্বগত ইত্যাদি।
কিছু কবিতায় এখনো রয়ে গেছে কিছু শব্দ যা সচরাচর প্রকাশ্যে উচ্চারিত হবার নয়। হয়তো ইচ্ছে করলে এড়ানো যেত কিম্বা প্রতিশব্দে ভাব প্রকাশ করা যেত। কিন্তু কবি সে পথে হাঁটেননি। সোজাসাপটা উচ্চারণেই সাজিয়েছেন কবিতা।
প্রথম কবিতা থেকেই যে হতাশা, নিরাশার দোলাচল তা শেষ কবিতায় গিয়ে শেষ পর্যন্ত কাটিয়ে ওঠে এক নতুন জীবনবোধ, এক নতুন আশার কথা শুনিয়েছেন কবি। এখানেই একটি কবিতা-অধ্যায়ের সাফল্য। শেষের কবিতা ‘মানত বেঁধেছে’তে প্রত্যয়ে ভরপুর কবি নতুন করে গেয়েছেন জীবনের জয়গান -
……… আজ ভাবি -
বাঁচতে হবে আরও অনেককাল
…… অনাগত কবিতার চাঁদমুখ -
…… হে অগ্নি, হে বাতাস
ভরলির মরা স্রোত
প্রতীক্ষা করো
পঞ্চভূতে মিশে যেতে মহন্তর ঢের দেরি আছে
মানত বেঁধেছে ভাম শ্মশানের বটগাছে।।
এখানেও আরো সব কবিতার মতো অসাধারণ শব্দোচ্চারণ কবির। সব মিলিয়ে এক ‘কমপ্লিট প্যাকেজ’ যেন মহন্ত সিরিজ। সব কবিতায় এক ব্যঞ্জনা, এক ঘোর লাগা অনুভব যেন লেপ্টে আছে কবিতার শরীরে। ধরা দেয় কবিতাময়তায় - শব্দের কারিকুরিতে।
রাজদীপ পুরীর সুন্দর প্রচ্ছদ পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম। চমৎকার বর্ণসংস্থাপন এবং অলংকরণের দায়িত্বে আশু চৌধুরী। নিখুঁত মুদ্রণে শ্রীচৈতন্য প্রেস, শিলচর।
বিদ্যুৎ চক্রবর্তী।
‘মহন্ত সিরিজ’
তপন মহন্ত
মূল্য - ৮০ টাকা
যোগাযোগ - ৮৬৩৮৯৮৬২৪৮
Comments
Post a Comment