Skip to main content

গরজের ধারাবাহিক সাহিত্য পত্রিকা - 'স্বরিত'

আন্তর্জাতিক সীমানাসংলগ্ন প্রান্তীয় শহর করিমগঞ্জ। দক্ষিণ অসমের বরাক উপত্যকার তিন জেলার অন্যতম জেলা করিমগঞ্জের সদর শহর। রাজ্যের মূলধারা থেকে বহু দূরে অবস্থানসূত্রে এ জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলসমূহের জনগণের জীবনযাত্রার অন্য নাম টানাপোড়েন। এই টানাপোড়েনের জের ছড়িয়ে যায় সাধারণ্যে, জন অরণ্যে। জীবন যাপনের মানোন্নয়নের হার নিতান্তই শ্লথ। এমনই এক পরিস্থিতি, পরিবেশের মধ্যে অবস্থান করেও যে কয়েকজন হাতে গোনা ব্যক্তি বা সংগঠন নিরলস সাহিত্য সাধনায় ব্রতী রয়েছেন দীর্ঘদিন ধরে - আজ তাঁদেরই হাত ধরে, তাঁদেরই পদাঙ্ক অনুসরণ করে প্রোথিত অঙ্কুর পর্যবসিত হচ্ছে চারা গাছে। এক গুচ্ছ তরুণ, নবীন কবি সাহিত্যিকের উত্থানে অনন্ত প্রত্যয় জাগে অন্তরে। এবং সেই প্রত্যয়ের ধ্বজাধারী যেসকল নমস্য সাহিত্য ব্যক্তিত্ব নিরন্তর রত রয়েছেন সাহিত্য সাধনায়, সৃষ্টিময়তায় তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন আলোচ্য ধারাবাহিক পত্রিকা ‘স্বরিত’-এর দুই সম্পাদক নারায়ণ মোদক এবং গৌতম চৌধুরী। এই দুই উদ্যমী সাহিত্য সাধকের হাত ধরে নিয়মিত এই প্রান্তীয় শহর থেকে প্রকাশিত হচ্ছে আরোও দু’দুটি সাহিত্য পত্রিকা - নিয়মিত।
সম্প্রতি বিশ্ব কবিতা দিবসে উন্মোচিত হলো ‘স্বরিত’ সাহিত্য পত্রিকার ১৪ তম সংখ্যা। আকারে ঢাউস না হলেও নিয়মিত ৮০ পৃষ্ঠার একটি পত্রিকা প্রকাশও হেলাফেলার কথা নয় নিশ্চিত। একটি ছোটপত্রিকার যাবতীয় শর্ত পূরণ করে ‘স্বরিত’-এর জয়যাত্রা অন্যথা দীর্ঘ ১৪ বছর ধরে সাহিত্যের আঙিনায় নিজের অস্তিত্ব জাহির করতে পারত না। নেপথ্যে নিশ্চিতই উপর্যুক্ত দুই হার না মানা সাহিত্য পূজারি।
আলোচ্য সংখ্যাটিতে আছে মোট ৪৬ টি কবিতা এবং ৬ টি গদ্য - যার মধ্যে আছে একটি স্মৃতিচারণ, তিনটি গল্প এবং দু’টি প্রবন্ধ। স্বভাবতই কবিতার পাল্লা ভারী। এই পত্রিকার সবচাইতে উল্লেখযোগ্য দিকটি হলো স্থানীয় উঠতি কবি লেখকদের উপযুক্ত মঞ্চ প্রদান করার তাগিদ যা আজকাল প্রত্যক্ষ করা যায় না সচরাচর এবং যা প্রকৃতপক্ষেই সর্বাপেক্ষা প্রয়োজনীয় কাজ। নামী, প্রতিষ্ঠিত কবি লেখকদের পাশাপাশি যখন উঠতি লেখকরা উপযুক্ত মঞ্চ পায় তখনই প্রতিভার স্ফুরণ অবশ্যম্ভাবী।
আলোচ্য সংখ্যায় একাধিক প্রতিষ্ঠিত কবিদের সাথে যেসব নবীন প্রবীণ কবি পাঠকের দরবারে নিজেদের উপস্থাপনে সর্বোচ্চ দক্ষতা প্রদর্শনে সক্ষম হয়েছেন তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন কবি - অভিষেক সেন, সুদীপ ভট্টাচার্য, ছন্দা দাম, পিনাক মাঝি, সুবল চক্রবর্তী, সুব্রত দেববর্মা, অনিন্দিতা চক্রবর্তী, মৌসুমী চক্রবর্তী, অনামিকা শর্মা প্রমুখ।
... নৌকা ভেসে যায় আদিগন্ত সীমারেখা ছেড়ে
এক শতাব্দীর পর অন্য শতকে
তুমি আবার জেগে ওঠো
কোন এক দেবদারু বনে কিংবা সর্ষের খেতে
এক পশলা বৃষ্টি হলে দাঁড়াই
দাঁড়াই অযথা রোদ্দুরের অপেক্ষায়
এর চেয়ে বেশি কী কাজ আছে পৃথিবীতে।
...
(সময় - অভিষেক সেন)
কিংবা -
... এ জন্ম আমার শ্যামের জন্ম; তাই
মননের প্রাচীন জটিলতায়
টের পাই, অধ্যাত্ম বিদ্যার পুনরাবৃত্তিতে
তোমার অস্পষ্ট অবয়ব
প্রতীত মাত্র; তোমার উদ্ভাসিত মুখ
আর দীপ্তমান চোখের গোলোকে
আলোর সমান্তরাল সরণি পুঞ্জীভূত যে বিন্দুতে
তা আমার বিজ্ঞানের অতীত;
শুধু তা অবিভাজ্য -
অন্ধকার বর্ণালির অস্পষ্ট ইঙ্গিত।
(তুমি যদি রাধা হতে শ্যাম ... - পিনাক মাঝি)।
পত্রিকার সম্পদ কিছু নামী কবিদের কবিতা। উল্লেখযোগ্য - অমিত চট্টোপাধ্যায়, জ্যোতির্ময় রায়, আশুতোষ দাস, সুশান্ত ভট্টাচার্য, শতদল আচার্য, মমতা চক্রবর্তী, বনশ্রী চৌধুরী, দোলনচাঁপা দাসপাল, মিলন কান্তি দত্ত, মন্টু দাস, শিপ্রা দাস, জয়শ্রী ভট্টাচার্য, ঋতা চন্দ, নারায়ণ মোদক প্রমুখ। করিমগঞ্জের সাহিত্য মহলে রবিবারের সাহিত্য আড্ডা এক নিয়মিত নান্দনিক আসর। এই আড্ডার সাতকাহন কবিতায় বর্ণিত হলো অন্যতম সম্পাদক নারায়ণ মোদকের কলমে। পাশাপাশি আরো যাঁরা রয়েছেন কবিতায় তাঁরা হলেন - কবি - শিখা দাশগুপ্ত, শিবানী গুপ্ত, রঞ্জিতা চক্রবর্তী, প্রতিমা শুক্লবৈদ্য, সাগরিকা দাসপুরকায়স্থ, অরুণ চট্টোপাধ্যায়, সুচরিতা সিংহ বেবি, হর্ষবর্ধন চট্টোপাধ্যায়, শাশ্বতী ভট্টাচার্য, শুক্লা মিশ্র, কৃষ্ণা রাণী চন্দ, শুক্লা চন্দ, কস্তুরী হোম চৌধুরী, রতন চন্দ, পূর্ণিমা রাণী দে, শিপ্রা শর্মা মহন্ত, বিদ্যুৎ চক্রবর্তী, শঙ্করী চক্রবর্তী, মনমোহন রায়, বিপ্লব গোস্বামী, পূরবী নাথ, শ্রাবণী সরকার এবং সঞ্জীব বৈদ্য। গানের আদলে সম্পূর্ণ সাধু শব্দে প্রার্থনা সঙ্গীতের ধাঁচে নবীন কবি রঞ্জিতা চক্রবর্তীর কবিতা পাঠক মনে তৃপ্তিসুখের উদ্রেক করে। প্রায় সবার কবিতাই সুখপাঠ্য। আলাদা করে সব কবিতার আলোচনা স্বল্প পরিসরে অসম্ভব বলে সে প্রয়াস থেকে দূরেই থাকতে হলো।
গদ্য বিভাগে প্রথমেই রয়েছে ড. গীতা সাহার তথ্যিভিত্তিক প্রবন্ধ - ‘দেবেন্দ্রনাথের জীবনে রামমোহনের প্রভাব’। পড়ে জানা যায় অনেক কিছু। চমৎকার ছোট গল্প লিখেছেন অন্যতম সম্পাদক গৌতম চৌধুরী। যুব সমাজের উপর হাল আমলের রোজগার ক্ষেত্রের সমস্যার প্রেক্ষাপটে একটি সুখপাঠ্য গল্প - ‘গোলামের টার্গেট’। জয়ন্তী নাথ-এর ছোটগল্প ‘বঞ্চিতের জ্বালা’ - থীম যথাযথ হলেও বুনোটে কিছু ত্রুটি ধরা পড়ে। কিছু বানানবিভ্রাট ও কিছু গুরুচণ্ডালী শব্দের ব্যবহারে অধিক সচেতনতার প্রয়োজন ছিল। সুখপাঠ্য কাহিনিভিত্তিক নিবন্ধ ‘ব্রাহ্মণ’ - লিখেছেন সন্তোষ কুমার দত্ত। বিনোদলাল চক্রবর্তীর স্মৃতিচারণা - ‘আশ্রয়দাতা যখন আশ্রয়হীন’ সুলিখিত একটি রচনা যা পাঠক মনে ভাবনার উদ্রেক করে। এ বিভাগে শেষ রচনা নবীন লেখিকা চান্দ্রেয়ী দেব-এর অণুগল্প ‘বুড়িমাসী’। উপস্থাপনায় নতুনত্ব আছে। সংলাপসর্বস্ব গল্পটিতে প্রসঙ্গান্তরে যাওয়ার সময় চিহ্নসমূহের ব্যবহার (### অথবা ***) প্রয়োজন ছিল। সংলাপে চমৎকার একটি থীমকে উপস্থাপন করার প্রয়াস ধন্যবাদার্হ।
পরিশেষে সাহিত্য আড্ডার বিগত বর্ষসমূহের খতিয়ান আছে লিপিবদ্ধ। বানানের ক্ষেত্রে সম্পাদনা সমিতির হস্তক্ষেপ পরবর্তীতে পত্রিকার মানোন্নয়নে সহায়ক হবে। ছাপার ক্ষেত্রেও সজাগ দৃষ্টির প্রয়োজন। ছিমছাম প্রচ্ছদ মানানসই। সংক্ষিপ্ত সম্পাদকীয়ও যথাযথ।   
‘স্বরিত’-এর মতো একটি নিয়মিত পত্রিকা আঞ্চলিক সাহিত্য চর্চায় এক যুগান্তকারী প্রভাব ফেলে। সেই হিসেবে আলোচ্য সংখ্যাটিও সাহিত্যের অঙ্গনে তার ছাপ রেখে গেলো এবং পরবর্তী সংখ্যার অধিকতর উৎকর্ষতার দাবিও জানিয়ে রাখল।

বিদ্যুৎ চক্রবর্তী

‘স্বরিত’ সাহিত্য পত্রিকা
সম্পাদক - নারায়ণ মোদক ও গৌতম চৌধুরী।
মূল্য - ১০০ টাকা
যোগাযোগ - ৯৪৩৫০৭৬০৬৯

Comments

Popular posts from this blog

উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বাংলা গল্প : বিষয়ে বিশ্লেষণে

একক কিংবা যৌথ সম্পাদনায় বিগত কয়েক বছরে উত্তরপূর্বের বাংলা লেখালেখি বিষয়ক একাধিক গ্রন্থ সম্পাদনা করে এই সাহিত্যবিশ্বকে পাঠকের দরবারে পরিচিত করিয়ে দেওয়ার এক প্রচেষ্টা করে যাচ্ছেন নিবেদিতপ্রাণ তরুণ লেখক ও সম্পাদক নিত্যানন্দ দাস । হালে এপ্রিল ২০২৪ - এ প্রকাশিত হয়েছে তাঁর সম্পাদনা গ্রন্থ ‘ উত্তর - পূর্বাঞ্চলের বাংলা গল্প : বিষয়ে বিশ্লেষণে ’ ( প্রথম খণ্ড ) । প্রকাশক - একুশ শতক , কলকাতা । আলোচ্য গ্রন্থটিতে দুই ছত্রে মোট ২৮ জন বিশিষ্ট প্রাবন্ধিকের ২৮টি প্রবন্ধ রয়েছে । উপযুক্ত বিষয় ও আলোচকদের নির্বাচন বড় সহজ কথা নয় । এর জন্য প্রাথমিক শর্তই হচ্ছে নিজস্ব জ্ঞানার্জন । কালাবধি এই অঞ্চল থেকে প্রকাশিত উৎকৃষ্ট সাহিত্যকৃতির সম্বন্ধে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল না হলে তা সম্ভব নয় মোটেও । নিত্যানন্দ নিজেকে নিমগ্ন রেখেছেন গভীর অধ্যয়ন ও আত্মপ্রত্যয়কে সম্বল করে তা বলার অপেক্ষা রাখে না । আলোচ্য গ্রন্থের ভূমিকা লিখেছেন প্রতিষ্ঠিত কথাকার রণবীর পুরকায়স্থ । বস্তুত সাত পৃষ্ঠা জোড়া এই ভূমিকা এক পূর্ণাঙ্গ আলোচনা । ভূমিকা পাঠের পর আর আলাদা করে আলোচনার কিছু থাকে না । প্রতিটি নিবন্ধ নিয়ে পরিসরের অভাবে সংক্ষিপ্ত হলেও ...

শেকড়ের টানে নান্দনিক স্মরণিকা - ‘পরিযায়ী’

রামকৃষ্ণনগর । প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আবহে বরাক উপত্যকার এক ঐতিহ্যময় শহর । বিশেষ করে শিক্ষাদীক্ষার ক্ষেত্রে চিরদিনই এক অগ্রণী স্থান হিসেবে উচ্চারিত হয়ে আসছে এই নাম । বৃহত্তর রামকৃষ্ণনগরের গোড়াপত্তনের ইতিহাস বহুদিনের । দেশভাগের আগে ও পরে , উত্তাল সময়ে স্থানচ্যূত হয়ে এখানে থিতু হতে চাওয়া মানুষের অসীম ত্যাগ ও কষ্টের ফলস্বরূপ গড়ে ওঠে এক বিশাল বাসযোগ্য অঞ্চল । শুধু রুটি , কাপড় ও ঘরের স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রই নয় , এর বাইরে শিক্ষা অর্জনের ও শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে মমনশীলতার পরিচয় দিয়েছিলেন সেইসব মহামানবেরা । ফলস্বরূপ এক শিক্ষিত সমাজব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল যদিও উচ্চশিক্ষার জন্য পরবর্তী প্রজন্মকে বেরোতে হয়েছিল নিজ বাসস্থান ছেড়ে । শিলচর তখন এ অঞ্চলের প্রধান শহর হওয়ায় স্বভাবতই শিক্ষা ও উপার্জনের স্থান হিসেবে পরিগণিত হয় । এবং স্বভাবতই রামকৃষ্ণনগর ছেড়ে এক বৃহৎ অংশের মানুষ এসে পাকাপাকিভাবে থাকতে শুরু করেন এই শিলচরে । এই ধারা আজও চলছে সমানে । শিলচরে এসেও শেকড়ের টানে পরস্পরের সাথে যুক্ত থেকে রামকৃষ্ণনগর মূলের লোকজনেরা নিজেদের মধ্যে গড়ে তোলেন এক সৌহার্দমূলক বাতাবরণ । এবং সেই সূত্রেই ২০০০ সালে গঠিত হয় ‘ ...

প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'স্বপ্নতরী'

  স্বপ্নতরী                         বিদ্যুৎ চক্রবর্তী   গ্রন্থ বিপণী প্রকাশনা  বাবা - স্বর্গীয় সুধীর চন্দ্র চক্রবর্তী মা - শ্রীমতী বীণাপাণি চক্রবর্তী               জনম দিয়েছ মোরে এ ভব ধরায় গড়েছ সযতনে শিক্ষায় দীক্ষায় জীবনে কখনো কোথা পাইনি দ্বন্দ্ব দেখিনি হারাতে পূত - আদর্শ ছন্দ বিন্দু বিন্দু করি গড়ি পদ্য সংকলন তোমাদেরই চরণে করি সমর্পণ প্রথম ভাগ ( কবিতা )   স্বপ্নতরী ১ স্বপ্ন - তরী   নিটোল , নিষ্পাপ কচিপাতার মর্মর আর কাঁচা - রোদের আবোল - তাবোল পরিধিস্থ নতুন আমি ।   আনকোরা নতুন ঝরনাবারি নিয়ে এখন নদীর জলও নতুন বয়ে যায় , তাই শেওলা জমে না ।   দুঃখ আমার রয়ে গেছে এবার আসবে স্বপ্ন - তরী চেনা পথ , অচেনা ঠিকানা ।         ২ পাখমারা   সেই উথাল - পাথাল পাখশাট আজও আনে আরণ্যক অনুভূতি । একটু একটু হেঁটে গিয়ে বয়সের ফল্গুধারায় জগৎ নদীর দু ’ পার ছাড়ে দীর্ঘশ্বাস - সময়ের কাঠগড়াতে আমি বন...